Sunday 04 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমাজবিজ্ঞান: সম্ভাবনা, শঙ্কা এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

মো. বজলুর রশিদ
৪ মে ২০২৫ ১৮:০১

প্রযুক্তির জয়যাত্রা মানব সমাজকে প্রতিনিয়ত নতুন পথে চালিত করছে, আর এই যাত্রার সাম্প্রতিকতম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী চালিকাশক্তি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)। একসময় যা ছিল কেবল বিজ্ঞানী ও গবেষকদের গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ, সেই এআই আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। স্মার্টফোনের ব্যক্তিগত সহকারীর নির্দেশনা থেকে শুরু করে জটিল রোগের নির্ণয়, শেয়ার বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে অপরাধ প্রবণতার পূর্বাভাস – এআইয়ের ব্যবহার মানব সমাজের কাঠামো, সংস্কৃতি এবং পারস্পরিক সম্পর্ককে মৌলিকভাবে বদলে দিতে শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

এই গভীর ও ব্যাপক পরিবর্তনকে কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। তাই এআইয়ের সামাজিক প্রভাবকে অনুধাবন করার জন্য সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমাজবিজ্ঞান কেবল এআই কী করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করে না, বরং এআই সমাজে কী করছে, কেন করছে, কার জন্য করছে এবং এর ফলে মানুষের জীবন ও সামাজিক কাঠামোর কী পরিবর্তন ঘটছে – এসব গভীর প্রশ্ন নিয়ে অনুসন্ধান করে।

বিজ্ঞাপন

সমাজবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তি এবং সমাজের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে চাকার ব্যবহার, মুদ্রণযন্ত্র থেকে শুরু করে ইন্টারনেট – প্রতিটি বড় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন মানব সমাজকে নতুন পথে চালিত করেছে, সামাজিক শ্রেণি, ক্ষমতা বিন্যাস, যোগাযোগ পদ্ধতি এবং মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনেছে। সমাজবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে প্রযুক্তি নিজে থেকে ভালো বা মন্দ নয়, বরং এটি সমাজে কীভাবে গ্রহণ করা হয়, কে এটি ব্যবহার করে, কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় এবং এর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকে – এসব সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এর প্রভাব নির্ধারিত হয়। এআইয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এআই কেবল একটি হাতিয়ার নয়, এটি এমন একটি সামাজিক শক্তি যা আমাদের বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা, ক্ষমতা কাঠামো এবং বৈষম্যকে প্রভাবিত করে, আবার নিজেও এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় এআইয়ের ইতিবাচক সামাজিক প্রভাবগুলো প্রথমে উল্লেখ করা যাক। এআইয়ের সবচেয়ে বড় অবদান হলো এর দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির ক্ষমতা। বিভিন্ন শিল্প ও সেবা খাতে এআই ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও মান উন্নত করা সম্ভব হচ্ছে। যেমন, স্বাস্থ্যসেবা খাতে এআই রোগ নির্ণয়ে ডাক্তারদের সহায়তা করতে পারে, যা দ্রুত ও নির্ভুল চিকিৎসার পথ খুলে দেয়, বিশেষ করে যেখানে বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে। ওষুধ আবিষ্কার এবং ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসায় এআইয়ের ভূমিকা বাড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এআই শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠ্যক্রম সাজাতে পারে এবং শিক্ষকদের প্রশাসনিক কাজ কমাতে সাহায্য করতে পারে।

এআই তথ্যের অ্যাক্সেস এবং সহজলভ্যতা বাড়াতে পারে। ভাষা অনুবাদ, লেখা বা কথার সারসংক্ষেপ তৈরি, এবং ডেটা বিশ্লেষণ এআইয়ের মাধ্যমে অনেক সহজ হয়েছে। এটি জ্ঞান অর্জন এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে, বিশেষ করে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে। এআই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবন সহজ করতে পারে বিভিন্ন সহায়ক প্রযুক্তির মাধ্যমে।

জটিল সামাজিক সমস্যা সমাধানেও এআইয়ের ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের মডেলিং, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস ও ব্যবস্থাপনা, ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ বা জননিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রে বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করে এআই কার্যকর সমাধান বা পূর্বাভাস দিতে পারে। এটি নীতিনির্ধারকদের আরও ডেটা-নির্ভর এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে।

এআই মানুষের সৃজনশীলতা বাড়াতেও সহায়ক হতে পারে, যেমন শিল্পকলা, সঙ্গীত বা লেখালেখির ক্ষেত্রে নতুন টুলস সরবরাহ করে। এটি মানুষকে রুটিন ও পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে আরও সৃজনশীল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে, এআই-চালিত প্ল্যাটফর্মগুলো ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে মানুষকে সংযুক্ত করছে, নতুন ভার্চুয়াল কমিউনিটি তৈরি করছে এবং নির্দিষ্ট আগ্রহের মানুষকে একত্রিত হতে সাহায্য করছে।

কিন্তু এআইয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনার পাশেই রয়েছে এর গভীর এবং জটিল নেতিবাচক সামাজিক প্রভাবগুলো, যা সমাজবিজ্ঞানের জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয়। প্রথম ও প্রধান উদ্বেগ হলো পক্ষপাত এবং বৈষম্য (Bias and Discrimination)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এআই ডেটা থেকে শেখে, আর ডেটা সমাজের বিদ্যমান বৈষম্যকে ধারণ করে। ফলে এআই সিস্টেমে পক্ষপাত তৈরি হয়। এই পক্ষপাত শুধু তাত্ত্বিক সমস্যা নয়, এর বাস্তব জীবন প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। যেমন, মুখের শনাক্তকরণ সিস্টেমে যদি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ডেটা কম ব্যবহার করা হয়, তবে সেই সিস্টেম অন্যদের তুলনায় তাদের শনাক্ত করতে ভুল করবে, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা নজরদারির ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করতে পারে।

নিয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট এআই ঐতিহ্যগতভাবে পিছিয়ে পড়া নারী বা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ সীমিত করতে পারে। ঋণ অনুমোদন বা বীমার প্রিমিয়াম নির্ধারণে এআই যদি ভৌগোলিক, জাতিগত বা আর্থ-সামাজিক ডেটা ব্যবহার করে পরোক্ষ বৈষম্য সৃষ্টি করে, তবে তা সমাজে ধনী-গরিবের বা সুবিধাবাদী-সুবিধাবঞ্চিতের ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দেবে। এই ‘অ্যালগরিদমিক বৈষম্য’ প্রায়শই স্বচ্ছ নয়, এর কারণ নির্ণয় করা কঠিন, এবং ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া আরও জটিল হয়ে পড়ে।

এআইয়ের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান এবং কাজের ভবিষ্যতের উপর প্রভাব। স্বয়ংক্রিয়তা অনেক কাজকে অপ্রচলিত করে তুলছে। উৎপাদন শিল্প, ডেটা এন্ট্রি, গ্রাহক পরিষেবা, পরিবহন এমনকি কিছু পেশাদার সেবাও এআইয়ের কারণে পরিবর্তিত হচ্ছে। যদিও নতুন চাকরি তৈরি হবে, তবে সেই চাকরিগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বর্তমান শ্রমশক্তির অনেকের কাছে নাও থাকতে পারে। এটি সমাজে দক্ষতা ভিত্তিক বিভেদ (skill gap) তৈরি করবে এবং যারা নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না, তারা কর্মহীন বা স্বল্প বেতনের কাজের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হবে।

গিগ অর্থনীতির প্রসার শ্রমিকদের নিরাপত্তা (চাকরির স্থায়িত্ব, স্বাস্থ্য বীমা, পেনশন) কমিয়ে দিচ্ছে এবং শ্রম শোষণ বাড়াতে পারে, কারণ এআই প্ল্যাটফর্মগুলো কর্মীদের উপর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এটি ট্রেড ইউনিয়ন এবং সম্মিলিত দর কষাকষির ক্ষমতাকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সমাজে আয় বৈষম্য আরও বাড়তে পারে, যেখানে এআই তৈরির সুবিধা সীমিত সংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে।

গোপনীয়তা (Privacy) এবং নজরদারি (Surveillance) এআইয়ের অন্ধকার দিকগুলির মধ্যে অন্যতম। এআই সিস্টেমগুলো মানুষের আচরণ, পছন্দ এবং ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার বিশাল ক্ষমতা রাখে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে অনলাইন কেনাকাটা, স্মার্ট ডিভাইস থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা – সবকিছু থেকে ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই ডেটা ব্যবহার করে ব্যক্তির ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি করা হয়, যা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে (টার্গেটেড বিজ্ঞাপন) বা রাষ্ট্রের নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। সর্বব্যাপী নজরদারির ভয় মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনতে পারে, ভিন্ন মত প্রকাশে বাধা দিতে পারে এবং নাগরিক স্বাধীনতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কে আমার ডেটা দেখছে, কীভাবে ব্যবহার করছে এবং এই ডেটা কতটা সুরক্ষিত – এই প্রশ্নগুলো সমাজে অবিশ্বাস তৈরি করতে পারে।

এআইয়ের মাধ্যমে তথ্য বিকৃতি (Misinformation) এবং অপপ্রচার (Propaganda) সহজ হয়ে উঠেছে। ‘ডিপফেক’ প্রযুক্তির মতো এআই টুলস ব্যবহার করে বাস্তবসম্মত কিন্তু সম্পূর্ণ মিথ্যা ছবি, ভিডিও বা অডিও তৈরি করা সম্ভব। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত ভুল তথ্য, গুজব বা রাজনৈতিক অপপ্রচার ছড়ানো যেতে পারে, যা জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এআই অ্যালগরিদমগুলো যেহেতু ব্যবহারকারীর আগ্রহ অনুযায়ী কন্টেন্ট সাজায়, তাই এটি সহজেই মানুষকে একটি নির্দিষ্ট তথ্যের জালে আটকে ফেলতে পারে, যেখানে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সুযোগ থাকে না।

এআই মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অ্যালগরিদমের কারণে মানুষের সম্পর্ক অনেক সময় অগভীর এবং সংখ্যাভিত্তিক (লাইক, ফলোয়ার) হয়ে যায়। মানুষ হয়তো সরাসরি যোগাযোগের চেয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে এআই মেডিয়েটেড যোগাযোগে বেশি সময় ব্যয় করবে, যা একাকীত্ব বাড়াতে পারে। এআই যদি স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষকের মতো ভূমিকা পালন করে, তবে মানবিক স্পর্শ, সহানুভূতি এবং ব্যক্তিগত সংযোগের অভাব দেখা দিতে পারে, যা সামাজিক বন্ধন দুর্বল করতে পারে।

এই ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবগুলি বিশ্বজুড়ে পরিলক্ষিত হলেও, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এগুলোর তাৎপর্য এবং প্রকাশ ভিন্নতর। বাংলাদেশ একটি জনবহুল এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে ডিজিটাল রূপান্তর দ্রুত গতিতে ঘটছে। স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে এবং এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর দিকে এগোচ্ছে, যেখানে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের জন্য এআইয়ের ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা। টেলিমেডিসিন, দূরশিক্ষণ বা স্মার্ট ফার্মিংয়ের মতো ক্ষেত্রে এআই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে উন্নত সেবা পৌঁছে দিতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এআইয়ের ব্যবহার জীবন ও সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ই-গভর্নেন্স বা ডিজিটাল সেবাদানে এআই যুক্ত হলে নাগরিক পরিষেবা সহজ ও দ্রুত হতে পারে।

তবে বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এআইয়ের নেতিবাচক প্রভাবগুলো আরও তীব্র হতে পারে। বিদ্যমান বৈষম্য (Inequality) এআইয়ের মাধ্যমে আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ডিজিটাল বৈষম্য এখানে একটি বড় সমস্যা। ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, স্মার্ট ডিভাইস বা ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব অনেক মানুষকে এআইয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করবে এবং নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। শহুরে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি এআইয়ের সুযোগগুলো সহজে গ্রহণ করতে পারলেও, গ্রামীণ বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এটি আরও একটি বঞ্চনার কারণ হতে পারে। ডেটার অভাব এবং স্থানীয় ডেটায় পক্ষপাতের ঝুঁকি বাংলাদেশে বেশি। এখানে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পক্ষপাতগুলো ডেটাতে প্রতিফলিত হতে পারে, যা এআই সিস্টেমের মাধ্যমে বৈষম্য তৈরি করবে। যেমন, লিঙ্গ বৈষম্য, নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রতি উন্নয়নের অভাব বা প্রচলিত সামাজিক বিভেদ ডেটার মাধ্যমে এআই সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারে।

বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য কাজের বাজারে এআইয়ের প্রভাব অত্যন্ত সংবেদনশীল। তৈরি পোশাক শিল্প (RMG) বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং এখানে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কাজ করেন, যাদের বেশিরভাগই নারী এবং তাদের অনেকেরই হয়তো উচ্চ শিক্ষা বা বিশেষ দক্ষতা নেই। এই শিল্পে স্বয়ংক্রিয়তা বাড়লে অনেক শ্রমিকের চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে। কৃষি খাতেও একই সমস্যা দেখা যেতে পারে। অনানুষ্ঠানিক খাত, যেখানে দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, সরাসরি স্বয়ংক্রিয়তায় কম প্রভাবিত হলেও, আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান কমলে এখানে চাপ বাড়বে। নতুন এআই সম্পর্কিত চাকরির জন্য যে ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতা প্রয়োজন, তা বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা দ্রুত সরবরাহ করতে পারবে তা একটি বড় প্রশ্ন। অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কাজের সুযোগ তৈরি এবং তাদের নতুন দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ দেওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল সামাজিক চ্যালেঞ্জ।

গোপনীয়তা এবং নজরদারির বিষয়টিও বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ। ডেটা সুরক্ষা আইন এখনও অনেক উন্নত দেশের মতো শক্তিশালী নয়। জনগণের ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব থাকতে পারে। এআই-চালিত নজরদারি যদি বাড়ে, তবে তা ভিন্ন মতাবলম্বী বা সমালোচকদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং সমাজে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে পারে।

ভুল তথ্য এবং অপপ্রচারের বিস্তার বাংলাদেশে দ্রুত হতে পারে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমগুলির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে। এআই ব্যবহার করে তৈরি ‘ডিপফেক’ বা মিথ্যা খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে তা সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে বা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে পারে।

সমাজবিজ্ঞানীরা এই জটিল পরিস্থিতিগুলো বিশ্লেষণ করে নীতি নির্ধারক, প্রযুক্তি নির্মাতা এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের গবেষণার মাধ্যমে বোঝা যায় এআই কীভাবে সমাজে ক্ষমতা বন্টন করছে, নতুন বৈষম্য তৈরি করছে বা পুরনো বৈষম্যকে শক্তিশালী করছে, এবং এর ফলে সামাজিক সংহতি বা সংঘাতের সম্ভাবনা কতটা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এআইয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানকে কাজে লাগানো অপরিহার্য। প্রযুক্তি গ্রহণ করার সময় এর সামাজিক প্রভাবগুলো নিয়ে আগেভাগে চিন্তা করতে হবে। এআই নীতি তৈরির সময় অবশ্যই ডেটা সুরক্ষা, অ্যালগরিদমিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে শিক্ষার্থীদের এআই যুগের জন্য প্রস্তুত করতে হবে এবং যারা কর্মসংস্থান হারাবে তাদের জন্য বিকল্প কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও জ্ঞানের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এআই যেন কেবল সুবিধাভোগী শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়ে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যবহৃত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব সমাজের জন্য একই সাথে অমিত সম্ভাবনা এবং গভীর শঙ্কা নিয়ে এসেছে। এটি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে, জীবনযাত্রা সহজ করতে পারে এবং অনেক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু একই সাথে এটি বৈষম্য বাড়াতে পারে, কর্মসংস্থান কমাতে পারে, গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দিতে পারে। এআইয়ের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর যেমন নির্ভর করে, তেমনি নির্ভর করে সমাজ কীভাবে এটিকে গ্রহণ করে, ব্যবহার করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে তার উপর।

সমাজবিজ্ঞান এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রক্রিয়াটি বুঝতে এবং বিশ্লেষণ করতে আমাদের সাহায্য করে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এআইয়ের সামাজিক প্রভাবগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন করা এবং এর ইতিবাচক দিকগুলোকে কাজে লাগিয়ে নেতিবাচক দিকগুলো মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা সময়ের দাবি। কেবল সচেতন সামাজিক প্রচেষ্টা এবং গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে এআই প্রযুক্তি সমাজের সকল মানুষের জন্য একটি উন্নত ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ তৈরি করবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মত-দ্বিমত মো. বজলুর রশিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর