ভারত ও পাকিস্তান দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ বিগত কয়েক দশক ধরে একে অপরের সঙ্গে সামরিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিরোধে লিপ্ত। কাশ্মীর ইস্যু, জঙ্গি হামলা, সীমান্ত লঙ্ঘন ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কারণে এই উত্তেজনা প্রায়শই সংঘাতের রূপ নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা শুধু দুই দেশের নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
কাশ্মীর বিতর্ক এই বিরোধের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ২০১৯ সালে ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়। একইসাথে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘর্ষ, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপ এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা এ অবস্থাকে আরো ঘনীভূত করে তোলে। উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে জাতীয়তাবাদী প্রচার প্রচারণাও পরিস্থিতিকে শান্ত করার পরিবর্তে আরও ঘোলাটে করেছে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। আফগানিস্তান, চীন এবং ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এবং ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সম্প্রসারিত কূটনৈতিক তৎপরতা এই উত্তেজনাকে বহির্বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর সিপিইসি প্রকল্পে বড় বিনিয়োগ করেছে। চীনের স্বার্থ পাকিস্তানকেন্দ্রিক থাকায় উত্তেজনা বাড়লে চীন-ভারত সম্পর্ক আরও অবনতি হতে পারে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব কোয়াড ও আইপিইএফ -এ জড়িত। একইসাথে পাকিস্তানকেও সন্ত্রাসবাদ দমনে চাপ প্রয়োগ করছে দেশটি। রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে ভারতের ঘনিষ্ঠ হলেও বর্তমানে পাকিস্তানের সঙ্গেও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে। এই উত্তেজনা বিশ্বকে দুই ভাগে ভাগ করে দিতে পারে।
উভয় দেশের পারমাণবিক অস্ত্র এই উত্তেজনাকে আরো মারাত্মক করে দিতে পারে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের তথ্যমতে, পাকিস্তানের কাছে আনুমানিক ১৭০টি ও ভারতের কাছে ১৬৪টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। এটি যে কোনো উত্তেজনাকে বড় ধরণের বিপর্যয়ে রূপ দিতে পারে। যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা সীমান্তে উস্কানিমূলক আচরণ পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, যার প্রভাব শুধু এই অঞ্চলেই নয়, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক ভারসাম্যে অস্থিরতা দেখা দেবে এবং চার দেশের জোট ‘কোয়াড’বা চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মতো জোট ও প্রকল্পগুলো নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে হতে পারে। যুদ্ধ বা বড় ধরণের সামরিক সংঘর্ষ হলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মানবিক সংকট দেখা দিবে এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
যুদ্ধ বা সামরিক উত্তেজনা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে। ভারত-পাকিস্তানের মতো বৃহৎ বাজারের মধ্যে যুদ্ধ হলে দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উভয় দেশেই রপ্তানি ও আমদানি খাত সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়বে। দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রবাহকে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ করে দেবে। সার্ক এর মতো সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না, ফলে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এই অঞ্চলের উত্তেজনা মধ্যপ্রাচ্য এবং সেন্ট্রাল এশিয়ার জ্বালানি সরবরাহেও প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই জ্বালানির উপর উচ্চমাত্রায় নির্ভরশীল, তাই উত্তেজনা বাড়লে বিশ্ববাজারে তেলের দামও বেড়ে যেতে পারে, যা দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
সড়ক, রেল ও অর্থনৈতিক করিডোরের মতো প্রকল্পগুলো নিরাপত্তা শঙ্কায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা আঞ্চলিক একীকরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপাক্ষিক সংযোগ সম্ভাবনাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রভাব ও করণীয়
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়লে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে এটা নিশ্চত। তাছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ বাড়তে পারে। একইসাথে তৈরি পোশাক রপ্তানির বাজারে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে, বিশেষত ইউরোপ-ভারত-চীন সরবরাহ শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটলে। বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতিতে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে। ভারত বাংলাদেশের প্রধান কৌশলগত অংশীদার হলেও সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গেও বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো হয়েছে। সঠিক কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা না করলে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিবেশ কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে এই উত্তেজনা নিরসনে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক এবং বিমসটেক-এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে।
উত্তেজনা নিরসনে করণীয়
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সংলাপ পুনরায় চালু করাই হচ্ছে উত্তেজনা হ্রাসের প্রধান পথ। সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য উভয় দেশকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে। জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অন্যান্য শক্তিধর দেশ ও সংগঠনকে এই সংকট নিরসনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা নিতে হবে। নিরপেক্ষ ও গঠনমূলক মধ্যস্থতা দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাস গড়তে সহায়ক হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়। ভারত ও পাকিস্তান যদি সামরিক ব্যয়ের একাংশ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আঞ্চলিক উন্নয়ন খাতে ব্যবহার করে, তবে জনমানুষের জীবনমান অনেক উন্নত হবে।
ভারত-পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনা শুধু এই দুই দেশের সমস্যা নয়, এটি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বড় বাধা। একমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সংলাপ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান করা সম্ভব। বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উচিত শান্তির পক্ষে থাকা এবং কৌশলগতভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতিতে কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং আঞ্চলিক শান্তি উদ্যোগের মাধ্যমে সচেতনভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট