ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ বছর পর টেস্ট ক্রিকেট। জিম্বাবুয়ের জন্য ম্যাচটা ঐতিহাসিক, হোক না সেটা চারদিনের। সেটা আর মিস করা যায় কী করে! পিএসএল ফেলে ইংল্যান্ডের ফ্লাইটে তাই চেপে বসা। ব্রায়ান বেনেটের ওই সেঞ্চুরির পর অবশ্য তার ৬৮ বলে ৬০ রানের ইনিংসটা খুব বেশি লাইমলাইট পায়নি। কারণ দিনশেষে মানুষ স্পোর্টসের মতো পারফর্মিং আর্টকে হার-জিতের ব্র্যাকেটে ফেলেই সরল অঙ্কটা কষে। নটিংহামের তিন দিনে শেষ হয়ে যাওয়া টেস্টে ওই ইনিংসের মাহাত্ম্য তাই জিম্বাবুয়ের ইনিংস ডিফিটটা একটু দেরিতে করানোতেই।
একটা দিন কম খেলা হলো। ওদিকে দল উঠেছে ফাইনালে। চড়ে বসলেন বিমানে। এরপর টানা একটা হেক্টিক জার্নি। ঠিক কতটা? বার্মিংহামে গতকালের ডিনার, দুবাইয়ে ব্রেকফাস্ট, আবু ধাবিতে লাঞ্চ, এরপর ফ্লাইটে করে লাহোরে এসে ডিনার। যদিও তখনও সিউর ছিলেন না, ম্যাচটা ধরতে পারবেন কিনা। টাইমলি পৌঁছাতে পারবেন কিনা। সেই অনিশ্চয়তায় থেকে কোয়েটার বিপক্ষে ফাইনালের জন্য লাহোর রেডি করল দুটো আলাদা টিম শিট। একটা তাকে রেখে, আরেকটায় সাকিবকে রেখে; যদি কোনো কারণে শেষ পর্যন্ত টাইমলি আসতে না পারেন। অবশেষে এলেন, টসের ঠিক দশ মিনিট আগে স্টেডিয়ামে। কোয়েটা ক্যাপ্টেন সৌদ শাকিলের হাতে আফ্রিদি তুলে দিলেন লম্বা ফ্লাইট ধরে উড়ে এসে জয়েন করা ক্রিকেটারের নাম-সহ টিম শিটটা। এরপর? দারুণ একটা গল্পই লেখা হলো লাহোরের ৩৪ হাজার দর্শকের সামনে।
২০ বলে তখন আরও ৫৭ রান দরকার ম্যাচ জিততে। মাত্রই আউট হয়ে ফিরে গেছেন ভানুকা রাজাপাকসে। মোহাম্মদ আমির যেন লিথাল। খেলাই যাচ্ছে না তাকে। খেলা যাচ্ছে না কে বলল? এসেই পুল করে দারুণ একটা চার। অ্যাঙ্গেল ক্রিয়েট আমির গেলেন এরাউন্ড দ্য উইকেটে। মিড উইকেট দিয়ে এবার ছয়। ক্লিন হিট। ২০ ওভার ফিল্ডিং, চার ওভার বোলিংয়ের পর জেটল্যাগ, ক্লান্তি কিছুই নেই। সেই দুই শটেই বোঝা গেল। আরও ক্লিয়ার হলো মোমেন্টাম এবার লাহোরের পক্ষে।
শেষ ওভারের চার নম্বর বলটা। অফস্টাম্পের অনেক বাইরে, ফুল লেংথে পড়ল। ফাহিম আশরাফ ছক্কা খেয়ে যাবেন এই আশায় অন্তন্ত করেননি। হলোও তাই। বটম-হ্যান্ডের পাওয়ার জেনারেটেড স্ল্যাশের পর ডিপ পয়েন্টের ওপর দিয়ে বল উড়ে গিয়ে পড়ল গ্যালারিতে। অবিশ্বাস্য! শেষটা তো দেখলেনই সবাই। লং অন দিয়ে চার। হাত ছুঁড়ে শূন্যে উড়তে চাইলেন। বাধা পড়লেন সতীর্থদের আলিঙ্গনে।
উড়তে তো চেয়েছিলেন ফাইটার জেটে চড়ে। পাকিস্তানেই রুট। সিয়ালকোটে জন্ম। কাশ্মীরি মুসলমান পরিবারে জন্ম, যেখানে পাঞ্জাবিটাও বলা হয়। শৈশব থেকেই স্বপ্ন ছিল ওই দেশের এয়ারফোর্সে জয়েন করবন, উড়বেন মেঘ ফুঁড়ে। পাকিস্তানের এয়ারফোর্সে কলেজে এডমিশনও ছিল। কিন্তু ভিশন টেস্টের রেজাল্টে আর ভাগ্যের শিকে ছিড়ল না।
সম্ভবত বাবার ব্যবসার কারণে পুরো ফ্যামিলি শিফট করেছিল জিম্বাবুয়েতে। সেখান থেকে স্কটল্যান্ড, ব্যর্থ ফাইটার পাইলটের একাডেমিক বিমান ল্যান্ড করল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রানওয়েতে। সে পাট চুকিয়ে আবার রিটার্ন ফ্লাইটে জিম্বাবুয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেট, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট। জিম্বাবুয়ের গার্ডিয়ান ফিগারদের একজন হয়ে ওঠা ধীরে ধীরে। এই যে একটা ফাইটার সত্তা দেখি, এর পেছনেও না হতে পারা ‘ফাইটার পাইলটের’ একটা বিশাল ভূমিকা আছে।
সাড়ে তিন বছরে তার ভেতর পাকিস্তান এয়ারফোর্স কলেজ গড়ে তুলেছে এক যোদ্ধাকে। আঙ্গুল ভাঙবে, গোড়ালি ফাটবে, ব্যথা পাবে; ওর্স্ট কেস সিনারিও, তবুও শেষ না দেখে ছাড়ছি না। ক্রিকেটেও এই ট্রেইটসগুলো তাকে হেল্প করেছে অনেক, নিজেও বলেছেন অনেক ইন্টারভিউতে। এসবের রিফ্লেকশনই দেখা গেছে অনেকবার। ছক্কা মেরে আইএল টি-টোয়েন্টি জেতানো, কোনো একটা ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফায়ারেও লাস্ট বলে সিক্সে ম্যাচ সিল করে দেয়া; এসবই জলজ্যান্ত উদাহরণ।
২২ বছর পর ইংলিশ সয়েলে টেস্ট খেলতে নেমে ইনিংস ডিফিট, তবুও সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি। তার টুইটটা এখনও টাটকা। মাত্র ১৩ ঘণ্টা আগের। অথচ সেই টুইটের ঘন্টা দুয়েক আগেও গায়ে ছিল সাদা জার্সি। খুব দ্রুতই আরেকটা টুইট হয়তো দেখা যাবে পিএসএল ট্রফি হাতে ছবি তুলে। ফাইটার পাইলট হতে পারেননি, তবে নিজের মধ্যে লালন করা ফাইটারকে লালন করেছেন। আকাশে উড়ার কথা ছিল এফ-সিক্সটিন বা আর কোনো জেট নিয়ে, কিন্তু উড়ে বেড়াচ্ছেন মাঠে। উড়ে আসছেন মাঠে। মাঝে বার্মিংহামে ডিনার, দুবাইয়ে ব্রেকফাস্ট, আবুধাবিতে লাঞ্চ, লাহোরে আবার ডিনার। আর ডেজার্টে? পিএসএল ট্রফি…