প্রধান শিল্পগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাকের পরেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প হলো চামড়া শিল্প। এর প্রধান কারণ হলো এই শিল্পের প্রধান উপাদান চামড়া আমাদের দেশেই প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে রপ্তানি পণ্যগুলোর উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপনণ ব্যবস্থা সুসংহত করা প্রয়োজন। কারণ রপ্তানি আয়ের উপরেই দেশের টেকসই অর্থনীতি নির্ভর করে। আমদানি নির্ভরতা দেশের অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি করে সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প। আর দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হলো চামড়া। চামড়া খাতের মূল্য সংযোজন শতভাগ। অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। বিশ্বব্যাপী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিসটিকা ও রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক চামড়া বাজারের আকার প্রায় ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে বেড়ে ৫৫০ থেকে ৬০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ধরা হচ্ছে প্রায় ৫.৫ থেকে ৬.২ শতাংশ।
রপ্তানি আয়ের অধিকাংশই আসছে চামড়ার জুতা থেকে। তথ্যে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১২৪ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলারের চামড়া ও চামড়া থেকে তৈরি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চামড়া রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। রপ্তানি পণ্য হিসেবে আমরা যখন শুধু পোশাক শিল্পের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছি এবং এখনও কার্যকর বিকল্প সামনে আনতে পারিনি তখন চামড়া শিল্পের অফুরন্ত সম্ভাবনা আমাদের সামনে। এর কাঁচামাল এবং প্রযুক্তি দুই-ই হাতের মুঠোয়। সাথে শ্রম তো আছেই। এরপরও কোনো অদৃশ্য কারণে চামড়া শিল্প কার্যকর রুপে বিকাশ লাভ করতে পারছে না। চলতি অর্থবছরে ১৪৪ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। সারা বিশ্বেই চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের চাহিদা রয়েছে। চামড়ার জুতা, ব্যাগসহ যাবতীয় সামগ্রী বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। চামড়া শিল্প কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় বড় কোম্পানি।
আমাদের দেশে সারা বছর তো বটেই কোরবানির ঈদের সময়ে আরও বেশি চামড়া সংগৃহীত হয়। বিশ্বে চামড়া শিল্পে প্রতিযোগীতাও লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় ভূমিকা এবং সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানি পণ্য হিসেবে চামড়ার সুনামও রয়েছে। কোনো রপ্তানি পণ্যে বাজার তৈরি এবং তা ধরে রাখা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। ক্রমাগত সেই খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে এবং গুণগত মানের ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যমে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। কারণ প্রতিটি খাত যেমন-পাট, চা বা পোশাক শিল্পে যেমন বহু মানুষের কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত থাকে চামড়া শিল্পেও চামড়া সংগ্রহের প্রান্তিক পর্যায় থেকে সবাই অনেকেই জড়িত থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে মোট রপ্তানি আয়ের গড়ে ৭৫-৮০ শতাংশ আসে আধা প্রক্রিয়াজাত চামড়া থেকে, যেখানে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ফিনিশড চামড়াজাত পণ্য; যেমন জুতা, ব্যাগ, ওয়ালেট বা বিলাসপণ্য থেকে মূল্য সংযোজনের হার হয় ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত, যা বাংলাদেশ এখনো উল্লেখযোগ্য হারে করতে পারছে না। তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে এখন ২০০টির বেশি ট্যানারি এবং ২৬০টির বেশি চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারী কারখানা রয়েছে। যদি এদের মধ্যে ২০-২৫ প্রতিষ্ঠান আধুনিক প্রযুক্তি, এলডব্লিউজি মানদন্ড এবং রপ্তানিযোগ্য ডিজাইন গ্রহণ করে, তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে মূল্য সংযোজনের হার ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো সম্ভব।
তৈরি পোশাক খাতের পর বাংলাদেশে রপ্তানির দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস চামড়া। বছরে এ খাতের রপ্তানি ১২০ থেকে ১৬০ কোটি ডলার। যথাযথ সহায়তা পেলে রপ্তানি আয় ৫০০ কোটি ডলার হতে পারে।
প্রতি বছরই কোরবানির ঈদের আগে ও পরে চামড়ার দরপতন বা দাম নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। দেখা যায়, প্রান্তিক ব্যবসায়িরা ন্যায্য দাম পায় না। চামড়া বিক্রিতে ন্যায্য দাম না পাওয়া বা দাম না পেয়ে চামড়া পুঁতে ফেলা বা ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। এটা এক ধরনের রুটিনে পরিণত হয়েছে। এর অর্থ চামড়া শিল্পের পিছনে কোনো অদৃশ্য হাত রয়েছে যার প্রভাবে এই প্রান্তিক বাজার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না।
প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য শিল্পের মতোই চামড়া শিল্পকে একটি অগ্রাধিকারযোগ্য শিল্প হিসেবে দেখতে হবে এবং প্রান্তিক পর্যায় থেকে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে পাকা চামড়ার পাশাপাশি এখন জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট বা মানিব্যাগ বিদেশে রপ্তানি হয়। এ সম্ভাবনাময় খাতকে আরও কাজে লাগিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। তবে গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, মূলত এখন যে সমস্যাটি চামড়া শিল্পকে বাধাগ্রস্ত করছে সেটি হলো এলডব্লিউজি সনদ। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে এলডব্লিউজি সনদ জরুরি। সেই সনদ আছে বাংলাদেশের মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের। ২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী মিলে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজি গঠন করে। সংস্থাটির লক্ষ্য হলো পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এই সনদ চামড়াজাত পণ্যের ভালো দাম পেতে সহায়তা করে। এছাড়া পরিবেশ সুরক্ষায়ও ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও পরিস্থিতি কিছুটা প্রতিকূলে থাকায় মাঝখানে এ শিল্প বিকাশ একটু বাধাগ্রস্ত হলেও সে পরিবেশ ক্রমেই কাটিয়ে উঠছে।
একটি শিল্পকে বাঁচাতে হলে সেই শিল্পের সম্ভাবনা যাচাই পূর্বক সমস্যার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করা প্রয়োজন। রিভাইজ করা প্রয়োজন। কেন সমস্যা বারবার সৃষ্টি হচ্ছে, কার জন্য হচ্ছে বা কিভাবে হচ্ছে, সম্ভাবনাকে কেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না ইত্যাদি বিষয় সমাধান করা দরকার। চামড়ার দাম না পাওয়া চামড়া শিল্পের ভবিষ্যতকেও দুর্বল করে দিবে। অথচ মাত্র এক দশক আগেও চামড়ার এ অবস্থা ছিল না। কেন প্রতি বছরই সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি না হওয়ার অভিযোগ আসে বা এরকম পরিস্থিতির তৈরি হয় সেটা খুঁজে বের করতে হবে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের সাথে দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান জড়িত। চামড়া খাত ঘুরে দাড়াতে হলে চামড়া সংগ্রহ থেকে রপ্তানি পর্যন্ত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্ব চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষত যে দেশগুলোকে আমরা প্রতিযোগী মনে করছি তারা। আমাদেরও তাদের সাথে সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ সামনের বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী চামড়ার বিশাল বাজার তৈরি হবে। বাংলাদেশের চামড়ার মান উন্নতমানের। বিদেশে ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার চেষ্টা করছে সরকার।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল ১২৩ কোটি ডলারের বেশি। ২০১৭-১৮ সালের অর্থবছরে তা কমে এসে দাড়ায় ১০৮ কোটি ডলারে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ১০২ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৮০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪১.৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাতে বেশি অগ্রগতি হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১,২২৩.৬২ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১২-১৩ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বলে জানা গেছে। অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান এখনও তুলনামূলকভাবে কম, কারণ দেশের রপ্তানির ৩.৮০ শতাংশ আসে চামড়া শিল্প থেকে আসে, আর জিডিপিতে খাতটির অবদান প্রায় ০.৬ শতাংশ। তিনি বলেন, বৈশ্বিক চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা প্রায় ৩ শতাংশ। খাতটির বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেই প্রবৃদ্ধি টেকসই উপায়ে হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। চামড়ার একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত রয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে এই বাজার আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। করোনা মহামারীর ভেতর অন্য সব খাতের সাথে চামড়া খাতও সংকটে পরে। শুধু কোরবানির ঈদেই দেশে কোটি কোটি পশু জবাই করা হয়। এই সময় লাখ লাখ মৌসুমি ব্যবসায়ী থাকেন চামড়া কেনার জন্য। এদের হাত ধরেই চামড়া পৌছে যায় চামড়া ব্যবসায়ীদের হাতে। চামড়া ব্যবসায়ে এসব মৌসুমি ব্যবসায়ীও এখন উৎসাহ হারাতে শুরু করেছে । আমাদের দেশে পাট, চা, তৈরি পোশাক এসব শিল্প দেশের অর্থনীতিকে সুসংহত করতে এবং অর্থনীতি এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ^ব্যাপী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও মূল্য বৃদ্ধি পেলেও আমাদের দেশে চামড়া নিয়ে প্রতি বছর এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন ঘটছে? আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ যদি পারে তাহলে আমরাও পারবো চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে যেভাবে পোশাক শিল্পে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছি। এই শিল্প এগিয়ে নিয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চার হবে। চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবশ্যই বিদ্যমান সমস্যাগুলোতে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক।
লেখক: কলামিষ্ট