আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব আজ নানা ধরনের সংঘাত, সহিংসতা এবং অস্থিরতায় জর্জরিত। বর্তমান বাস্তবতায় নৈতিকতা দুর্বলদের জন্য, শক্তির দুনিয়ায় নীতি চলে না। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র বা তার মিত্রদের জন্য সবকিছুই প্রযোজ্য কিন্তু অন্য কোন রাষ্ট্র সেটি করতে হলে সে দেশকে বা সেদেশের জনগণকে অনিবার্য ধ্বংসযজ্ঞের চরম মূল্য দিতে হয়। তারা প্রচার মাধ্যমে যা প্রচার করবে সেটাই সত্য আর অন্য সব অসত্য। গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো ‘তোতাপাখির মতো ইসরাইলি প্রচারণা’ ছাড়া আর কিছুই করেনি। প্রতি একজন ইসরাইলির মৃত্যুর জন্য বিবিসি ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ৩৩ গুণ বেশি কাভারেজ দিয়েছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিবিসির ৩৫ হাজারেরও বেশি সংবাদ ও কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ করে এ ফলাফল পেয়েছে সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং। বিবিসি Brutal, atrocities, slaughter, barbaric, deadly –এর মতো শব্দগুলো ইসরাইলি ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে চারগুণ বেশি ব্যবহার করেছে। massacre শব্দটি ইসরাইলিদের জন্য ১৮ গুণ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। ইসরাইলিদের ক্ষেত্রে ২২০ বার murder বলা হয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের জন্য বলা হয়েছে মাত্র একবার। Butchered, butcher এবং butchering-এর মতো শব্দগুলো কেবল ইসরাইলিদের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১২ হাজার ১০০-এর অধিক পরমাণু বোমা রয়েছে যার সিংহভাগই পৃথিবীর দু’টি প্রধান শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দখলে। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইসরাইল এবং উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারি। তাদের মতে এসকল দেশের কাছে পারমানবিক বোমা থাকলেও তাদের থেকে বিশ্ব নিরাপদ। অন্যদিকে, অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীনভাবে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। পারমানবিক অস্ত্রধারী কয়েকটি দেশ ও তাদের অনুগত আন্তর্জাতিক সংস্থা মনে করে যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য পারমাণবিক উপকরণ সমৃদ্ধ করছে। মধ্যপ্রাচ্যে একচেটিয়া প্রভাব ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলসহ বেশ কয়েকটি দেশ ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে যুদ্ধ বাধানোর পাঁয়তারা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে লোক দেখানো উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। তাদের অভিযোগ ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য পারমাণবিক উপাদান সংগ্রহ করছে যদিও ইরান সবসময়ই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিপ্রায় অস্বীকার করে আসছে। ইরান দাবি করে যে তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে যেমন- বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক চুল্লি চালানোর জন্য এবং পারমাণবিক গবেষণা করার জন্য। ইরানকে মানসিকভাবে চাপে রাখতে বিভিন্ন সময়ে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা ও জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা IAEA ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছে এবং কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক উপকরণ সমৃদ্ধকরণের ভিত্তিহীন বানোয়াট অভিযোগ তুলেছে।
মুসলিম দেশগুলোর বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যেকার অনৈক্য এবং বিভাজন ইসরাইলকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরও আগ্রাসী হতে উৎসাহিত করেছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং স্বার্থের সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে ইসরাইল নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবতে শুরু করেছে। ইস মূলত: ইসরাইল ও তার প্রশ্রয়দাতা আমেরিকা এবং পশ্চিমা কিছু দেশ মনে করে একমাত্র ইরানকে ধ্বংস করতে পারলে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একচেটিয়া দখলদারিত্ব ও খবরদারি বজায় থাকবে।
গত ১২ জুন তারিখে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) সুনির্দিষ্ট কোন প্রকার তথ্য বা প্রমাণ ছাড়াই অন্যায়ভাবে প্রস্তাব পাস করেছে যে, ‘তেহরান পারমাণবিক সুরক্ষায় তার প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে মেনে চলছে না’। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আণবিক শক্তি সংস্থা এক যৌথ বিবৃতিতে এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানায় এবং এটিকে ‘রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিহিত করে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই প্রস্তাব IAEA-এর বিশ্বাসযোগ্যতা, অখণ্ডতা এবং গ্রহণযোগ্যতাকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধ কোন কিছুর সমাধান নয় বরং তার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল প্রজন্মব্যাপী সংকট সৃষ্টি করে। ইসরাইল কোন প্রকার উসকানি ছাড়াই একতরফাভাবে ইরানের বিরুদ্ধে ১৩ জুন/২০২৫ তারিখে যুদ্ধ শুরু করে। এ যুদ্ধে ইসরাইলকে আগ্রাসনকারি দেশ আর ইরানকে প্রতিরোধকারি দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
IAEA এর বিবৃতিদানের পরের দিনই অর্থাৎ ২০২৫ সালে ১৩ জুন প্রথম প্রহরে ইসরাইল ইরানের পরমাণু ও বিভিন্ন সামরিক স্থাপনার ওপর অপারেশন রাইজিং সান নামক কোডে হামলা শুরু করে। হত্যা করে ফেলা হয় ইরানি সামরিক বাহিনীর প্রধানসহ বিভিন্ন সামরিক শাখার বিশ জনেরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেলদের হত্যা করা হয়। কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীও নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। ইরানের এত বড় ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যেই ইরান ঘুরে দাঁড়ায় এবং ইসরাইলের ওপর মিসাইল বৃষ্টি বর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ইরানের এমন পাল্টা হামলা ইসরাইলকে বিস্মিত করে তোলে। ইরানি হামলার ভয়াবহতায় ইসরাইল যে ভুল হিসাব-নিকাশ কষেছিল তা প্রতীয়মান হয়। পরবর্তী দিনগুলোতে যুদ্ধের গতি ও মাত্রা যতই তীব্র হয়েছে ইসরাইলের অসহায়ত্ব ততই ফুটে উঠেছে। ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থানে-ফোর্ডো, নাতানজ ও ইস্পাহানে পুরাদস্তুর হামলা চালায় যা ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০৯তম বোমারু উইংয়ের সাতটি বি-২ বোমারু উড়োজাহাজ মিসৌরির হোয়াইটম্যান এয়ারফোর্স বেস থেকে অবিরাম উড়ে এসে এই হামলা চালায় । এতে ৭৫টি নির্ভুল বোমা নিক্ষেপ করা হয় যার মধ্যে ১৪টি ছিল ‘বাংকার বাস্টার’। পরদিন ইরান কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালায় এবং ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুতে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিশোধ নেয়। এটি ছিল যুদ্ধের ঐতিহাসিক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। প্রথমবারের মতো ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের দাম্ভিকতা চূর্ণ করে।
ইসরাইলের ২০০ টিরও বেশি যুদ্ধবিমান সমগ্র ইরান জুড়ে ১০০ টিরও বেশি পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা এবং আবাসিক এলাকাগুলিতে আঘাত হানে। ইরানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে, শত শত মানুষ নিহত হয়েছে এবং সাধারণ অধিবাসীদের বাড়িঘর সহ সরকারি অনেক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলের আক্রমণে মোট আহত হয় ৪,৭৪৬ জন, যার মধ্যে ১৮৫ জন মহিলা। মোট নিহত ৯৩৫ জন, যার মধ্যে ৪৯ জন মহিলা এবং ১৩ জন শিশু। সবচেয়ে ছোটটির বয়স ছিল দুই মাস। আহত স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ২০ জন, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নিহত ৫ জন, ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাম্বুলেন্স ৯টি, ক্ষতিগ্রস্ত হাসপাতাল ৭টি , স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট ৪টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত জরুরি ঘাঁটি ৬টি।মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ঝুঁকি বিশ্লেষণকারী লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এমইএনএ অ্যানালিটিকার পরিচালক আন্দ্রিস ক্রেইগ বলেন, ‘যুদ্ধে ইরানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৪০০ কোটি ডলার থেকে তিন হাজার ৫০০ কোটি ডলার, যা ইরানের ৩৮ হাজার কোটি ডলারের জিডিপির ৬.৩ থেকে ৯.২ শতাংশ। যুদ্ধের কারণে দেশটির তেল রপ্তানির পরিমাণ কমেছে।
১৪ জুন/২০২৫ গভীর রাতের হামলায় ইসরাইল তার অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে বেশির ভাগ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র রুখে দিলেও বেশ কয়েকটি ইরানের মিসাইল আঘাত হানে ইসরাইল ভূখণ্ডে। ইরান ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ-থ্রি ’তে প্রথমবারের মতো দূর পাল্লার অত্যাধুনিক সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এতে কঠিন জ্বালানির ব্যবহার। এই প্রযুক্তির কারণে এটিকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে উৎক্ষেপণ করা সম্ভব হয়। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সক্ষম। ইরানের অস্ত্রভান্ডারে রয়েছে হোভেইজেহসহ বিভিন্ন ধরনের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। ইসরাইলের বিরুদ্ধে চলমান হামলায় এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে দেশটি। ইরান ইসরায়েলে ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রায় ১১০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। আলজাজিরার বিশ্লেষক গ্যাটোপুলোস বলেন, ইরানের হাতে এখন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ক্রমাগত উন্নত ও পরিণত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থারই প্রত্যক্ষ ফলাফল। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো রাডারে ধরা পড়লেও প্রতিহত করা কঠিন বলেও জানান তিনি। কিছু হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে হাইপারসোনিক গ্লাইড ভেহিকল -এইচজিভি সংযুক্ত থাকে। এটি একটি যুদ্ধাস্ত্র, যা শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুত গতিতে উড়তে ও দিক পরিবর্তন করতে সক্ষম। ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, ঘণ্টায় তুলতে পারে ১৭ হাজার কিলোমিটারের বেশি গতি। এ ছাড়া ২ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম খাইবার এবং ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে পারা হাজ কাশেম রয়েছে।ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) এক জ্যেষ্ঠ কমান্ডার জানিয়েছেন, ইসরাইলের আগ্রাসনের জবাবে ইরান তাদের প্রতিরক্ষা শক্তির মোটে ৫ শতাংশেরও কম ব্যবহার করেছে। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরাইলের প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ইসরাইলের আনুমানিক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির এ তথ্য উঠে এসেছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন বলছে, ইরান প্রায় দুই সপ্তাহের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিল। যার ফলে ইসরাইলি অবকাঠামোর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি হিসাব করলে ইসরাইলের ক্ষতি দাঁড়ায় ২০ বিলিয়ন ডলার।
ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কর্পস অ্যারোস্পেস ফোর্স অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি-এর অংশ হিসেবে ইহুদিবাদী সরকারের (ইসরাইল) বিরুদ্ধে ২২টি প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার ফলে ইসরাইলি শহরগুলোতে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।ইরানের ছোঁড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৯ জন। জুন মাসের এই ১২ দিনের সংঘাতের সবচেয়ে প্রবীণ নিহত ব্যক্তি ছিলেন ৯৫ বছর বয়সী যিনি হোলোকাস্ট বা ইহুদি গণহত্যা থেকে জীবিত ফিরেছিলেন। ইরান যে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তাতে ইসরাইলকে সহায়তা কার্যক্রমে ১২ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই প্রণালি দিয়েই বিশ্বের শতকরা ২০ ভাগ তেল পরিবহন করা হয়। ২৩ জুন ২০২৫ তারিখে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশন মিডনাইট হ্যামারের প্রতিক্রিয়ায় কাতারের আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। এই হামলার ব্যাপারে গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’–এর অন্যতম জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আলি ভায়েজ এএফপিকে বলেন, ‘এটি এমন পরিকল্পনামাফিক চালানো হয়েছে, যাতে কোনো মার্কিন হতাহতের ঘটনা না ঘটে এবং উভয় পক্ষের জন্যই (সংঘাত থেকে) সরে আসার পথ খোলা থাকে। যুদ্ধের বিস্তৃতি রোধ ও বিশ্ব বাণিজ্যের বিপর্যয়কর ধাক্কা সামলাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মত ও মনোভাব পরিবর্তন করেন এবং ২৪ জুন/২০২৫ তারিখ ইরানের ওপর চাপানো অন্যায় যুদ্ধের সাময়িক বিরতি ঘটান।
১২ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের মাঠে নামাতে সক্ষম হলেও কোন বিজয় অর্জন করতে পারেনি বরং সম্মিলিতভাবে তাদের অবস্থা দাড়িয়েছে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি’। নেতানিয়াহু তেহরানে সরকার পরিবর্তন করতে পারেননি, যা তার বহু বছরের চেষ্টা এবং আসল লক্ষ্য ছিল। বরং তিনি একটি দৃঢ়, ঐক্যবদ্ধ ইরানের মুখোমুখি হন, যারা নিখুঁত ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ইসরাইলকে প্রতিহত করেছে। ইরান এই সংঘর্ষ থেকে যে ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তা এখন বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণিত।মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ব ইরানকে ব্যবসার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। এটি ইসরায়েলের জন্য একটি পরাজয় ও ইরানের জন্য একটি বিজয়। তেহরান টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকা সাহার ইমামি বোমা হামলার মাঝেও সংবাদ পাঠে দৃঢ়তা এবং বিপদের মাঝেও শান্ত থাকার যে মানসিক শক্তি দেখিয়েছেন, তা শত সহস্র নারীর সাহস জোগায়। এ মুহূর্তটি কেবল একটি সম্প্রচারের সময়ের গল্প নয়। এটি একজন নারীর নীরব বিপ্লব। যুদ্ধ, বিস্ফোরণ, আতঙ্কের মধ্যেও একজন নারী নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন। তার কণ্ঠ শুধু শব্দ উচ্চারণ করেনি, সে কণ্ঠ ছিল মনোবলের সেই প্রতিধ্বনি-‘আলো নিভে গিয়েছিল, সাহস নিভেনি’। আজ সেই কন্ঠই সমগ্র ইরানির চেতনার শক্তির উৎস।
মার্কিন ও ইসরাইলি চেষ্টার পরও তার পারমাণবিক ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ ও কার্যকর রয়েছে। তেহরান কেবল ইসরাইলি শহরে নয়, পুরো অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতেও আঘাত হানতে সক্ষম। এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানের অভ্যন্তরীণ জাতীয় ঐক্যের উত্থান ঘটেছে। আরব ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আত্ম বিশ্বাসের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এবং ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে।বহু বছর ধরে ইসরাইল ও তার মিত্ররা ইরানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে, এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও দেশটিকে পরিত্যক্ত হিসাবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রও এই যুদ্ধে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা পড়ে ৪১%-এ নেমে এসেছে। বিশেষ করে যারা ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি শুনে তাকে ভোট দিয়েছিলেন, তারা হতাশ।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান এর পার্লামেন্টে গৃহীত একটি আইন স্বাক্ষর এবং এর ফলে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে। ইরান দাবি করছে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দ্বারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলায় IAEA পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। এই স্থগিতাদেশের ফলে IAEA ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে পরিদর্শন ও নজরদারি চালাতে পারবে না, যা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলবে। ইরানের এ ধরণের পদক্ষেপ আর্ন্তজাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে বলে জার্মানী ও রাশিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে ইরানকে পুর্নবিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছে। ইরানের এ ধরণের পদক্ষেপে ইসরাইলের তথাকথিত ‘সাফল্য’ অর্থহীন হয়ে যাবে। সব সামরিক হিসাব-নিকাশ ও ভূরাজনৈতিক নাটকের মাঝে একটি সত্য স্পষ্ট : প্রকৃত বিজয়ী হলো ইরানের মানুষ। যখন সবচেয়ে জরুরি ছিল, তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল। তারা বুঝেছিল বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বকে এবং নিজেদের স্মরণ করিয়ে দিল যে সংকটের মুহূর্তে মানুষ ইতিহাসের পার্শ্বচরিত্র নয়, তারা তার রচয়িতা।
আন্তর্জাতিক পরিম-লে এখন এমন একটি উদ্যোগের প্রয়োজন যা যুদ্ধের বিপরীতে সংলাপকে বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কূটনীতি, সহমর্মিতা এবং দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই শান্তির সন্ধান সম্ভব। রাষ্ট্রগুলোর উচিত হবে নিজেদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল বিশ্ব গঠনের দিকে অগ্রসর হওয়া। যুদ্ধ নয়,শান্তি একটি মানবিক এবং সামাজিক প্রযুক্তি যা মানবজাতির অগ্রগতি এবং সামাজিক সমন্বয়ে একটি মহৎ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের সাহায্যে তথ্যপ্রযুক্তি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি হয় না বরং এটি বিপজ্জনক প্রযুক্তির প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনার কারণে ধ্বংস এনে দেয়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২ কোটি লোক মারা গিয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৫ থেকে ৮ কোটি ৫০ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মূলত সামরিক হতাহতের সংখ্যা বেশি ছিল, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ছিল অনেক বেশি। এভাবে দেখা যায় পৃথিবী সৃষ্টি থেকে অদ্যাবধি যুদ্ধে মানুষ শুধু মারাই যাচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধে পৃথিবীর কোন লাভ হয়েছে তার কোন প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক উইলফ্রেড ওয়েনের একটি অসাধারণ যুদ্ধবিরোধী কবিতা রয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন- ‘যদি তুমি দেখতে পারতে / কেমন করে রক্তে ভেসে যায় তার ফুসফুস,/ কেমন করে সে হেঁচকি তোলে,/ মৃত্যু ঠেকাতে ব্যর্থ এক জীবন্ত দগ্ধ শরীর তার/তবে তুমি বলতে না-যুদ্ধের জন্য জীবন দেওয়াটাই মহৎ কাজ!’
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম