Saturday 05 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রসিকের ‘ওয়েক আপ কল’টা শুনবে কী আ’লীগ?


২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৯:২৩
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গত ২১ শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। রসিক নির্বাচনে মেয়র পদে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার ৪’শ ভোট পাওয়া বিজয়ী প্রার্থী মোস্তফা প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকার প্রতীকের প্রার্থী, সাবেক মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে। নির্বাচনী প্রচারকালেই বুঝা যাচ্ছিলো মোস্তফা বিজয়ী হতে যাচ্ছেন, কিন্তু সেটা যে এমন ভূমিধস বিজয় হবে সেটা কেইবা অনুমান করতে পেরেছিলো? তাছাড়া গত নির্বাচনে লাখের উপর ভোট পাওয়া সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর ভোট ৬২ হাজারে নেমে আসাটাও অবাক করার মতো বৈকি। এসব বিষয় আলোচনার জন্যই এই লেখার অবতারণা।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে রসিক নির্বাচনের ফলাফল হয়তো সেভাবে প্রভাব ফেলবে না। এই নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকেও সেভাবে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়নি। তাছাড়া রংপুর অঞ্চল জাতীয় পার্টির ভোটব্যাংক হিসেবেও পরিচিত। তবুও এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর এমন করুণ পরাজয় আওয়ামীলীগের জন্য একটা সতর্কবার্তাও বটে।

আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী ঝন্টুর শত্রুরাও স্বীকার করবেন যে উনি মেয়র থাকাকালীন রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অর্থাৎ উন্নয়ন করে এবং সরকার দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েও আরেকটি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারলেন না ঝন্টু। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গেলেই শুনতে পাওয়া যায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের চাপা ক্ষোভ ও হতাশার গল্প। মেয়র থাকাকালীন পাঁচ বছর দলীয় নেতাকর্মীদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন রংপুর জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা সরফুদ্দিন আহমেদ। দলীয় নানা কর্মসূচিতেও তাকে সেভাবে পাওয়া যায়নি। তাই আওয়ামীলীগ প্রার্থী হিসেবে ঝন্টুকে বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারেননি। ফলে সতস্ফূর্তভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় দলীয় লোকজন সম্পৃক্ত হয়নি। আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পরাজয়ের মূল কারণ এটিই। এটা যতটা আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পরাজয় তার থেকে বেশি ব্যক্তি ঝন্টুর পরাজয়। নির্বাচনোত্তর আলোচনায় এই কথাই এখন বেশি করে উচ্চারিত হচ্ছে।

কিন্তু তাই বলে আওয়ামীলীগের দায়মুক্তি হচ্ছে না। নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকবেই। পরাজিত হবার মাঝে দোষের কিছু নেই। কিন্তু দোষের হলো হারার আগেই হেরে যাওয়া। নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরেও যদি ভোটারদের সমর্থন পাওয়া না যায় তাহলে সেটা মেনে নেয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ কি তার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেছে কিংবা করতে পেরেছে? প্রার্থী মনোননের ব্যাপারে তৃণমূলের মতামত কতটা প্রাধান্য দেয়া হয়েছিলো? যদি তৃণমূলের মতামতের উপর ভিত্তি করেই প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়ে থাকে তাহলে নির্বাচনী প্রচারে তার প্রতিফলন কেন দেখা গেল না? আর যদি তৃণমূলের মতামত অগ্রাহ্য করেই মনোনয়ন দেয়া হয়ে থাকে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে প্রার্থীর দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য কেন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলো না?

ফিরে যেতে চাই কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। গত ৩১ শে মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়া কুসিক নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মনিরুল ইসলাম সাক্কু ১১ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী আনজুম সুলতানা সীমাকে। সেই নির্বাচনের উল্লেখ্যযোগ্য দিক ছিলো কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সর্বাত্মকভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলো। স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটা অংশও প্রাণপন চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ফলাফল অনূকুলে আনা যায়নি। নির্বাচন পরবর্তী বিশ্লেষণে সেই পরাজয়ের কারণ হিসেবে উঠে এসেছিলো স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ, দলীয় নেতাকর্মীদের একাংশের বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রার্থী মনোনয়ন যথাযথ না হওয়া। আওয়ামীলীগ কি সেই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেয়নি? ভুল করা ভুল না, কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা না নেয়া রীতিমতো অপরাধ।

কুসিক এবং রসিক এই দুইটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে আরেকটি বিষয়ে মিল পাওয়া যায়। এই দুটি সিটি নির্বাচনেই মেয়র পদে আওয়ামীলীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীরা পরাজিত হলেও নির্বাচিত হওয়া কাউন্সিলরদের বেশিরভাগই আওয়ামীলীগ সমর্থক। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স। তারমানে কি আওয়ামীলীগের লোকজন আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছে না? নাকি তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় প্রতীকের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থই মুখ্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে?

বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ প্রায় ৯ বছর ধরে শাসনক্ষমতায় আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার এই নয় বছরের শাসনামলে দেশের সার্বিক উন্নতি ঘটিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে একটি সমীহ জাগানিয়া স্থানে পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু প্রদীপের নীচেও অন্ধকার থাকে। দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে দল হিসেবে আওয়ামীলীগ সমানতালে এগিয়ে যেতে পারছে না। কান পাতলে এখন তৃণমূল আওয়ামীলীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের অপ্রাপ্তি ও হতাশার দীর্ঘশ্বাসই বেশি শোনা যায়। সেই সাথে রয়েছে দলীয় কোন্দল এবং এক পক্ষকে অন্যপক্ষ ঘায়েল করার মানসিকতা। মোদ্দাকথা তৃনমূল নেতাকর্মীরা ভাল নেই। স্বাভাবিক সময়ে বুঝা না গেলেও কুসিক এবং রসিক নির্বাচন এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এখনই এটার একটা সুরাহা করতে পারলে ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগকে আরো বেশি দাম চুকাতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের কিন্তু মাত্র আর এক বছর বাকি।

আওয়ামীলীগকে আরেকটা বিষয় বুঝতে হবে। উন্নয়নের রাজনীতি এবং ভোটের রাজনীতি এক না। যদি উন্নয়ন দিয়েই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যেত তাহলে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে দেশের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগিয়েও ২০০১ এর নির্বাচনে শোচনীয় ভাবে পরাজয় বরণ করতে হতো না। ব্যক্তি জনপ্রিয়তা এবং ভোটপ্রাপ্তি সবসময় একই সরলরেখায় চলে না। এই কথাটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয় কমবেশি বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশের জন্যই প্রযোজ্য। উদাহরণের জন্য খুব বেশি দূর যেতে হবে না। ভারতের গুজরাটে সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকালেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। নির্বাচনীপূর্ব সময়ে তিন তরুণ তুর্কি অল্পেশ ঠাকুর, হার্দিক পাটেল এবং জিগনেশ মেবানীর সাথে জোট বেঁধে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কংগ্রেস জোটের জনসভায় যেখানে লাখো মানুষেরও সমাগম হয়েছিলো সেখানে নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় চেয়ার কমিয়ে ফেলতে হয়েছিলো জনসমাগম কম হওয়ায়। তারপরও শেষ হাসি হেসেছে বিজেপিই। এর কারণ কি? কারণ বিজেপির নির্বাচনী পরিকল্পনা ছিলো খুবই সুসংগঠিত। বলা হয়ে থাকে যে বিজেপি নেতা অমিত সাহ গুজরাটকে নিজের হাতের তালুর মতোন চেনেন। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটার তালিকা ধরে ধরে পরিকল্পনা সাজিয়েছিলো বিজেপি। আর তাতেই মার খেয়েছে প্রতিদ্বন্দী দলগুলো। শুধু গুজরাট নির্বাচন নয়, এই চমৎকার নির্বাচনী পরিকল্পনার জোরেই পুরো ভারত জুড়ে বিজেপির জয় জয়কার হয়েছিল। বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ী হবার ব্যাপারটাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। সন্দেহাতীতভাবেই ট্রাম্পের চেয়ে অনেক জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও হিলারীর ভাগ্যের শিকে ছিড়েনি। নির্বাচনী প্রচার এবং পরিকল্পনায় একের পর এক ট্রাম্প কার্ড খেলে বাজিমাত করে হোয়াইট হাউজে পৌঁছে গিয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নির্বাচন বিজয়ের মূল অনুঘটকই হলো কানেক্টেভিটি। যে প্রার্থী ভোটারদের সাথে নিজের এবং তার দলের বেশি সংযোগ ঘটাতে পারবে সেই প্রার্থীই বিজয়ী হবে। একেক এলাকার মানুষের সমস্যা, সুবিধা-অসুবিধা, চিন্তা চেতনা একেক রকম। একেক এলাকার মানুষের চাহিদাও একেক রকম। তাই নির্বাচনী পরিকল্পনার কোন সাধারন কাঠামো তৈরি করা সম্ভব না। বরং আসনভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে। তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই আওয়ামীলীগের নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি করা দরকার। প্রার্থী মনোনয়ের ব্যাপারে এখন থেকেই নিবিড়ভাবে কাজ শুরু করা দরকার। তবে সবার আগে দরকার তৃণমূলের নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে কিভাবে নির্বাচনী পরিকল্পনায় সর্বতোভাবে শরিক করা যায় সেই উপায় বের করা। জাতীয় নির্বাচনে তিনশো আসনে একইদিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে স্থানীয় নির্বাচনে বিজয়ের জন্য স্থানীয় নেতাকর্মীদের উপরই নির্ভর করতে হবে। তাছাড়া তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকার মানুষের পালসটা বুঝতে পারেন, কাকে কিভাবে বলে ভোট নিজের দলের প্রার্থীর পক্ষে আনা যায় সেটা বুঝেন। কিন্তু আশঙ্কার ব্যাপার এই যে আওয়ামীলীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিভিন্নভাবেই অবমূল্যায়নের স্বীকার হয়েছেন এবং দল থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে কুমিল্লা এবং রংপুর সিটি নির্বাচনে। এই দুই নির্বাচনের ফলকে আওয়ামীলীগ একটি ওয়েক আপ কল হিসেবে ধরতে পারে। এখনই জেগে উঠতে না পারলে সামনে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।

আওয়ামীলীগ এদেশের গণমানুষের দল, শতভাগ গণতান্ত্রিক মানসিকতা ধারণকারী একটি দল। এই দলের প্রার্থীর পরাজয়ের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারন মানুষদের পাশে নিয়ে এই দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হলেই বরং গণতন্ত্র সুসংহত হয়। আওয়ামীলীগের তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এমনটাই বিশ্বাস করে থাকেন।

সারাবাংলা/এমএম

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই কলামের সকল মত লেখকের নিজের।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর