বিএনপি: রিয়েল বনাম স্পিরিচুয়াল ফিলোসফি
৩ জুলাই ২০১৮ ১৮:১৮
।। শরিফুল ইসলাম খান ।।
‘৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না গিয়ে ভুল করেছিল বিএনপি, এবার গিয়ে ভুল করবে’— সিদ্ধান্ত আর সম্ভাবনার মিশেল এ লাইনটি দু’জন সক্রিয় কর্মীর বাদানুবাদের অংশ। নিজেরা না জানলেও তাদের একজনের তাত্ত্বিক ভিত্তি ‘রিয়েল পলিটিক্যাল ফিলোসফি’; আরেকজনের ‘স্পিরিচ্যুয়াল পলিটিক্যাল ফিলোসফি’।
ত্বত্ত্ব কিংবা দর্শন বাদ দিয়ে এমনিতেই বলা যায়, দল গঠনের পর এতটা সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি বিএনপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে দলীয় নেতাকর্মীদের উপলব্ধিও ভিন্ন নয় খুব একটা। এমন পরিস্থিতির জন্য নানা কারণ আছে, সেসব কারণ নিয়ে আছে মত-দ্বিমতও।
ধরে নিচ্ছি, গত কয়েক বছরে নানামুখী দমন-পীড়ন, মামলা-হামলায় বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত বিএনপি। কিন্তু এত খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও কি দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল কমেছে? এখনও কি কমিটি গঠনে বন্ধ হয়েছে টাকার লেনদেন? পকেট ম্যানদের বদলে কি মূল্যায়িত হচ্ছেন ত্যাগী আর যোগ্যরা? অবসান হয়েছে কি বড় ভাই-কেন্দ্রিক রাজনীতির? এসব প্রশ্ন তুললেই আমাকে সরকারের দালাল বানানো হবে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সত্যি কি বিএনপি নামক সংগঠনটি এ ক’বছরে শক্তিশালী হয়েছে? প্রতিনিয়ত কি নতুন কর্মী তৈরি হচ্ছে? দল, আদর্শ ও দেশের জন্য কি জীবন বাজি রাখার মতো নেতাকর্মী আছে দলটিতে?
আচ্ছা, আরেকটা প্রশ্ন। যারা স্লোগান দিয়েছিল ‘আমার নেত্রী আমার মা, বন্দি হতে দেবো না, বন্দি থাকতে দেবো না’, তারা কি কথা রেখেছে? যে নেতারা স্বেচ্ছায় কারাবরণের কথা বলেছিলেন, তারা কোথায়? কোথাও কি খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন হচ্ছে? আন্দোলনের বদলে নেতাকর্মীরা কি কমিটি কমিটি খেলাতে কিংবা নির্বাচন নিয়ে বেশি ব্যস্ত নয়?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানেন বিএনপি নেতারাও। দৃশ্যমান বাস্তবতা হলো— নির্বাচনের বছরের মাঝামাঝি চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বিএনপি। দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে পরিস্থিতি। ফলে নির্বাচন-আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেই এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না দলটি। ফলে অন্ধকারেই আছেন নেতাকর্মী-সমর্থকরা। সব মিলিয়ে যত দিন যাচ্ছে ততই অস্থিরতা বাড়ছে দলীয় নেতাকর্মীদের, বাড়ছে হতাশা-নিরাশাও।
খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার পর আন্দোলনের ধরন ও তীব্রতা নিয়ে শুরু থেকেই বিপরীতমুখী অবস্থানে ছিল কেন্দ্র-তৃণমূল। সম্প্রতি কেন্দ্রের উপলব্ধিতে পরিবর্তন এসেছে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বদলে হার্ড লাইনে যাওয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। এখন বিএনপি বলছে, আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই তাদের হাতে। কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আন্দোলনের কতটা সামর্থ্য আছে বিএনপির? যদিও অনেকে মনে করেন, সামর্থ্যের বিষয়টা আপেক্ষিক।
কিন্তু জটিলতা অন্য জায়গায়— বলা যায় উভয় সংকটে বিএনপি। দাবি আদায়ে শক্ত আন্দোলনেও যেতে পারছে না, আবার অহিংস আন্দোলনে দাবিও পূরণ হচ্ছে না। এখন রাজপথে শক্তি দেখাতে গেলে আবার নতুন করে মামলা-হামলার শঙ্কা আছে। ফলে ব্যহত হবে নির্বাচনি প্রস্তুতি। আবার শক্ত অবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্পও দেখছে না বিএনপি।
কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপ-সমঝোতার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই, সম্ভাবনাও নেই খুব একটা। খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় আগ বাড়িয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে পারছেন না বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। কারণ, যারাই নির্বাচন কিংবা সমঝোতার কথা বলছেন, তাদের সবাইকেই সংশয়-সন্দেহের চোখে দেখছেন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে কেন্দ্র-তৃণমূলে টানাপোড়েনও আছে বেশ।
এর মধ্যে আছে বহুমাত্রিক সিদ্ধান্তহীনতা। শীর্ষ নেতাদের একজন কারাগারে আরেকজন লন্ডনে। ফলে, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া আগের চেয়ে অনক বেশি কঠিন বিএনপির জন্য। তাছাড়া, প্রতিনিয়ত সংকটের কথা বললেও সমাধান কোন পথে, জানেন না বিএনপি নেতারা।
নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন কি না, না পেলে চেয়ারপারসনকে কারাগারে রেখে নির্বাচন, নাকি আবারও বর্জন— এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই কারও কাছে। সব মিলিয়ে একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা অতিক্রম করছে বিএনপি।
চরম সংকটময় সময়েও আশার কথা, ভয়-ভীতি কিংবা নানা প্রলোভন থাকলেও দল ছাড়েনি বিএনপির বড় কোনো নেতা। ফলে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখছেন কেউ কেউ। কেউ ভাবছেন আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সরকারের পতন হবে; কারো ভাবনায় বিদেশি রাষ্ট্রের ভূমিকায় হতে পারে সুষ্ঠু নির্বাচন। তখন নিশ্চয় দেশ চালাবে বিএনপি। আবার কোনো কোনো নেতাকর্মী ভীষণ হতাশ, ত্যক্ত-বিরক্ত। তাদের ধারণা, সৃষ্টিকর্তার হস্তক্ষেপ ছাড়া দাবি পূরণ হবে না বিএনপির।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন
সারাবাংলা/টিআর