বাড়তি শুল্ক ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্রাম্প একটি বোমাও খরচ না করে পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিলেন। চীন ছাড়া মোটামুটি সকল দেশই আমেরিকার বশ্যতা স্বীকার করে বাণিজ্য চুক্তি করেছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর শক্তির সঙ্গে কোন দেশই বাকবিতন্ডায় না গিয়ে বরং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর শর্তে শুল্কহার কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশও ৩৭ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশ, সেখান থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে।
বিশ্ব জুড়ে আমেরিকা কেন এত ক্ষমতাধর? তারা কি ব্রিটিশদের মত যুদ্ধ জয় করে বিভিন্ন দেশকে তাদের কলোনি বানিয়ে রেখেছে? নাহ, বরং তাদের ক্ষমতার উৎস ডলার। একবার চিন্তা করুন, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কিংবা রেমিট্যান্স এসব লেনদেন ডলার ছাড়া সম্ভব নয়। তবে চীন, রাশিয়ার মত শক্তিধর দেশগুলো ডলারের এই একক আধিপত্য মেনে নিতে চাইছে না। বিশ্বের গ্রোথ ইঞ্জিন হিসেবে খ্যাত চীনের ইউয়ান চাইছে ডলারকে পাল্লা দিতে।
ডলারের আধিপত্য আর কতদিন, এই প্রশ্ন যখন সামনে আসছে তখন আমেরিকা নেমেছে শুল্ক যুদ্ধে। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কথা বলে রপ্তানিকারক দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে অতিরিক্ত শুল্ক যা রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ নামে পরিচিতি পাচ্ছে। এর ভিতরে আসল উদ্দেশ্য কী? শুধুই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা নাকি অন্য কিছু? এমন প্রশ্ন থেকেই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে কেউ কেউ।
যদিও এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং সরকারের মুখপাত্র প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এতে দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়নি। বরং নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন, ভূ-রাজনৈতিক ফাঁদ এড়িয়ে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। তার মানে এটা স্পষ্ট যে, ট্রাম্পের এই শুল্ক শুধুই বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে আরো বিষয় জড়িয়ে আছে।
আর এখানেই ট্রাম্প কোন যুদ্ধাস্ত্র ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে বিশ্বকে। দুর্বল দেশগুলো বাণিজ্য যুদ্ধে শর্তযুক্ত আত্মসমর্পণ করলেও চীনকে বাগে আনতে পারেনি ট্রাম্প। ফলে দেশটির জন্য সময় বাড়ানো হয়েছে। বাণিজ্যের এই নীতিকে ব্যবহার করেই ট্রাম্প যুদ্ধের চেয়েও বেশি ফল পেয়েছেন, যেটা কিনা ব্রিটিশদের ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুদ্ধ করে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে জয়ের মাধ্যমে করতে হয়েছে। এখানে যে প্রশ্ন সামনে আসে তাহলো বিশ্বের সবগুলো দেশের বাণিজ্য কী শুধু আমেরিকার সঙ্গেই? অন্যান্য দেশগুলো কী নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য করতে পারে না?
যাই হোক, এবারে লাভ-ক্ষতির হিসেবে আসা যাক। ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কে আমেরিকা কী লাভবান হবে নাকি বাড়তি শুল্ক আরোপ করা দেশগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে? বাংলাদেশ দিয়েই উদাহরণ দেয়া যাক। আগে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকান আমদানিকারকরা ১০০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করলে এর সঙ্গে ১৫ ডলার যুক্ত হয়ে পণ্যের দাম পড়তো ১১৫ ডলার। এখন আরো ২০ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হয়ে পণ্যের দাম পড়বে ১৩৫ ডলার।
বাড়তি যে ২০ ডলার তা পরিশোধ করবে কে? গার্মেন্টস মালিকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি নীতি অনুযায়ী এটা আমদানিকারক তথা আমেরিকান ব্যবসায়ীরাই পরিশোধ করবে। কিন্তু ক্রেতা সব সময় বিক্রেতার উপর দাম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে যদি আমেরিকান ক্রেতারা বাড়তি শুল্ক কোনভাবে আমাদের উৎপাদকের ঘাড়ে চাপাতে চায়, তাহলে সমূহ বিপদ।
এবার আমেরিকার দিক থেকে চিন্তা করলে, ওই বাড়তি ২০ ডলার দেশটির ক্রেতাদের পকেট থেকে দিতে হবে। শুধুতো বাংলাদেশ নয় আরো বহু দেশ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে করে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আমেরিকান ক্রেতারা কেনাকাটা কমিয়ে দিবে। তাতে করে পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। আগে যদি মাসে ২টা শার্ট কিনতো এখন হয়তো দুই মাসে একটা শার্ট কিনবে।
এই পরিস্থিতি তৈরি হলে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এজন্যই অর্থনীতিবিদ এবং গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ বলেছেন, শুল্ক কমিয়ে আনলেও আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই। এখন আমাদের বিকল্প বাজারের দিকে নজর দিতে হবে। এর মধ্যে জাপান অন্যতম বড় বাজার।
ভারতেও রপ্তানি বাড়ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য রেষারেষিতে রপ্তানি কমছে। আগামী বছরের নভেম্বরে আমরা স্বল্পন্নোত দেশ থেকে চুড়ান্ত উত্তরণ করবো। তখন সম্ভাবনাময় বাজার গুলোতে বাণিজ্য সুবিধা সংকোচিত হয়ে আসবে। এজন্য প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি। আমরা এ বিষয়ে কতটুকু প্রস্তুত?
ওদিকে ইউরোপ আমাদের অন্যতম বড় বাজার। এখানেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর অপেক্ষা করছে চ্যালেঞ্জ। তবে আমাদের জিএসপি প্লাস সুবিধা দিবে ইইউ, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শ্রম অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা এসব ইস্যুও শর্ত হিসেবে থাকবে। সেগুলো আমরা কতটুকু পূরণ করে এলডিসি পরবর্তী বাণিজ্য সুবিধা ধরে রাখতে পারবো?
অবশ্য শ্রম অধিকারের বিষয়টি ফাঁস হওয়া বাণিজ্য চুক্তিতে আছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে বলছেন, কিছু চুক্তি থাক না গোপন। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করতে গেলেও তা গোপন রাখে আর এটাতো আন্তর্জাতিক একটি বাণিজ্য চুক্তি।
চুক্তির যে অংশটুকু ফাঁস হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা মূলত চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য কমিয়ে আনা ও তার সঙ্গে বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছে। বিশেষ করে সামরিক, জ্বালানি ও খাদ্য আমদানি বাড়ানোর কথা বলেছে। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত আমদানি নির্ভর। আর এই আমদানির মূল উৎস হচ্ছে চীন ও ভারত। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ফাঁস হওয়া চুক্তিতেই দেখা গেছে সেখানে দেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু নেই। ভবিষ্যতে এটি প্রকাশ করা হবে বলেও তিনি জানান।
আমেরিকার ওপর আমাদের নির্ভরতার মূলততো ডলার আয়ের জন্যই। এক্ষেত্রে আগেই বলেছি, রপ্তানির নতুন বাজার ও নতুন পণ্য বাড়াতে হবে। এক গার্মেন্টস এর উপর নির্ভরশীলতা আর কতো। এক্ষেত্রে চামড়া, পাট, ওষুধ, কৃষিপণ্য এগুলোর কথা বলা হলেও এসবের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। যদিও সম্প্রতি এ বিষয়ে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে।
ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগাদা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটি লাভের দিক। তবে খাদ্যপণ্য আমদানি বাড়ালে দেশের বাজারে দাম কিছুটা বাড়বে এটা বলাই যায়। আবার, সামরিক পণ্য আমদানি বাড়ালে হয়তো চীন ক্ষেপে যাবে। বাণিজ্য ইস্যুতে এই দুই পরাশক্তিকে মোকাবিলার মাঝখানে আমরা পড়ে যাবে কিনা সেই শঙ্কা থাকছে।
তবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিল আশ্বস্ত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির সময় ভূরাজনৈতিক ফাঁদ এড়াতে সচেষ্ট ছিল বাংলাদেশ। আমরা তার কথার ওপর আস্থা রাখতে চাই। যদিও ভবিষ্যতেই চুড়ান্ত উত্তর পাওয়া যাবে। আমেরিকার দিক থেকে যে ক্ষতিটি হবে তাহলো, তাদের সাধারণ নাগরিকের জীবনযাপন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। আমেরিকান জনগণ এ নিয়ে এপ্রিলেই বিক্ষোভ করেছে। আবারো সেই পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তবে ট্রাম্প তার জনণের আয় বাড়ানোর দিকটা নিশ্চিত করেই শুল্ক যুদ্ধে নেমেছেন। যেমন-বোয়িং এর উড়োজাহাজের ক্রয়াদেশ বাড়ছে। বাংলাদেশও ২৫টি বোয়িং কেনার চুক্তি করেছে। যদিও এই চুক্তি অনুযায়ী বিমানগুলো পেতে আরো ১০/১২ বছর সময় লাগবে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বোয়িং কেনার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে এভিয়েশন খাতকে শক্তিশালী করতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এটি আমেরিকার অতটা গুরুত্বই পায়নি। তাই বোয়িং এর বিনিময়ে বাংলাদেশ শুল্ক কমাতে পেরেছে এই ধারণাটি সত্য নয় বলে তিনি জানান।
ট্রাম্প আরেকটি জিনিস চাইছেন তা হলো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেন যুক্তরাষ্ট্রে এসে কারখানা স্থাপন করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের যেহেতু ৩০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা আছে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হোক। তবে শর্ত থাকুক যেন বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমেরিকায় যেতে পারে। তাহলে আমাদের ডলার আয়ের আরেক প্রধান উৎস রেমিট্যান্স বাড়বে। কিন্তু আমেরিকা কী ফেলে দেয়া টেক্সাইল শিল্প আবারে ফিরিয়ে আনবে?
যদি তা না করে তাহলে শুল্ক এমন এক অস্ত্র হিসিবে ট্রাম্প ব্যবহার করলেন যা এর আগে হয়তো কেউ এভাবে ব্যবহার করতে পারেনি।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, স্টার নিউজ ও সাবেক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ইআরএফ