আমাদের শুরুটা সবসময়ই ভালো হয়, শেষটায় আর শেষমেশ পৌছানো হয় না। মাঝখানে গিয়ে কেমন করে যেন ল্যাজেগোবরে করে ফেলি সব। কেন করি নিজেও কি জানি? হয়ত জানি। আর জেনেশুনেই বিষ পান করার মত অবস্থার সৃষ্টি করি। আমাদের জাতীয় জীবনে ঘুরে দাঁড়াবার ঘটনা এসেছে মাত্র কয়েকবার। আমরা পুরোনো অবস্থা থেকে নতুন অবস্থায় যেতে যতবারই উদ্যোগী হয়েছি ততবারই কারা যেন কোথা থেকে বসে বসে রশি টানাটানি করে সব আয়োজন শেষমেশ ভণ্ডুুল করে দেয়। এ আমাদের দুর্ভাগ্য।
একাত্তর আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াবার, স্বয়ম্ভু হবার সুযোগ করে দিয়েছিলো। কিন্তু আমরা এক ব্যাক্তি ও এক দলীয় স্বাথের্র কাছে আত্মসমর্পনকেই পছন্দ করে নিয়েছিলাম। প্রকারান্তরে বাধ্যই হয়েছিলাম। নব্বাইয়ের গণ অভ্যুত্থান আমাদেরকে নতুন ভাবে উজ্জীবিত করেছিলো। সেটাও আমরা টেনে নিয়ে গিয়ে একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পারিনি। গেলো পনের বছরের স্বৈরশাসনে পিষ্ট হয়ে আমাদের হাপিত্যেস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো। অমিত তেজ ছাত্রদের হাত ধরে ছত্রিশে জুলাই আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতার দ্বারোদঘাটন হয়েছিলো। একটি গ্রুপ ছাড়া সকলেই রাজপথে এক হয়েছিলো অনেক বছর পর নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয় নিয়ে। আশা ছিলো সকল বৈষম্যের অবসান হবে, সমাজে ইনসাফ কায়েম হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। আইনশৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। চাঁদাবাজি, গুম, খুন, অপহরণ, জুলুম থাকবে না। সিণ্ডিকেট বিলুপ্ত হবে। আশাগুলো সবসময়ই বড় হয়ে থাকে। সবই যে ম্যাজিক মন্ত্রে এচিভ হয়ে যাবে এমন আশা কেউ করে না। তবে জনগণ এ লক্ষ্যে পদক্ষেপ দেখতে চায়, দৃশ্যমান একশন দেখতে চায়। এই একবছরে তার কতটুকু দেখা গেছে তার বিচার বিশ্লেষণের সময় হয়েছে এখন। কেউ বলছেন, সরকারের গৃহীত সুন্দর কিছু উদ্যোগ কোটারি গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে ভেস্তে যাচ্ছে। পরিকল্পিত পদ্ধতিতে গুজব ও অপপ্রচারের মাধ্যমে জনমনে বিদ্বেষ ও ভীতি ছড়ানো হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে ভুল বার্তা। কেউ কেউ বলছেন প্রাপ্ত বিপ্লব অংকুরেই বেহাত হয়ে গেছে ইত্যাদি।
সময়ের সাথে সাথে স্বাথের্র পুুরোনো রোগ আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ঐকমত্য কমিশনে বসে শব্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বাক্যের গঠন রীতি, ভবিষ্যতের ধান্ধা ইত্যাদি প্রায়শই দৃশ্যমান হচ্ছে। মুখে ঐক্যের ফেনা তুললেও ভেতরে ভেতরে নিজ নিজ এজেণ্ডা যাতে প্রাধান্য পায় সে চেষ্টায় ঘাটতি নেই। কেউ বলছেন সব কিছুতেই ঐক্য হওয়া যাবে না। আশা করাও ঠিক না। বহু মতের গণতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিক। কথা সহীহ। কেউ বলছেন এগুলোকে আইনগত ভিত্তি দিতে হবে। সেটাও যৌক্তিক। কেউ বলছেন আইনী কাঠামোর দরকার নেই, নির্বাচিত সরকার এগুলো করবে। তাছাড়া আইনগত ভিত্তি দেবে সংসদ। কেউ বলছেন অন্তত দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার কথা লেখা থাক। ছাত্ররা বলছেন, দু’বছর লম্বা সময়, এতদিন লাগবে কেন? নির্বাচন প্রক্রিয়া আর জুলাই সনদ বাস্তবায়ন একযোগে চলতে বাধা নেই। এটাকেও তো ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কথা ছিলো জুলাই সনদ জুলাইয়ের মধ্যেই হবে। সে আর হলো কই? এখন টার্গেট ছত্রিশে জুলাই। সেটাতেও হয় কিনা জানি না। আমরা সাধু পানির দেশের মানুষ। আমাদের মস্তিষ্ক বড়ই উবর্র। কেউ কেউ এরিমধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন রাজনীতিতে ডানপন্থীদের উত্থান হতে পারে। হলে দোষের কি? আমরা সবাই তো অহরহ বলে থাকি, জনগণ সব কিছুর মালিক। তাদের আকাংখা যদি সেরূপই হয় তাতে হোয়াইট কলারদের অসুবিধে কোথায়? তারাও তো মুখ ভরে জনগণের নাম জপতে জপতে রাজনীতি করছেন। যারা বড় এক্টর তারা ক্ষণে ক্ষণে প্রান্ত বদল করছেন। কখনো মুখোমুখি, কখনো পাশাপাশি, কখনো অভিমানী।
ছত্রিশে জুলাইয়ের মধ্যে ঐকমত্যের জুলাই সনদ কী চেহারা নিয়ে উপস্থাপিত হবে কে জানে? এরপর কী? কেউ কি মানিনা, মানবো না বলে রাজপথে বসে পড়বেন? কতিপয় বাম নেতা কি ইতোমধ্যে এমন ইঙ্গিতই দিয়ে রাখলেন? ছাত্ররা কি চায় তা স্পষ্ট না। তারা যা চায় তা কি সময়ের ট্রেন ফেল করে যথাসময়ে লক্ষ্যে পৌছানোর পক্ষে সম্ভব? টানেলের ও প্রান্তে আলোর রেখা ঘন ঘন উঁকি মেরেই পরক্ষণেই হারিয়ে যাচ্ছে। আলো-আধারির এ খেলা দেখে ভয় জাগে। আমাদের জাতীয় জীবনে এরকম আরো কয়েকবার মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছিলো। কিন্তু সম্ভাবনাময় অবস্থা সৃষ্টি করে আবার যে লাউ সে কদুতেই ফিরে গেছে।
বাংগালী শংকর জাতি। এর মধ্যে আমাদের চরিত্রগত বৈপরীত্য অন্যতম। নির্মলেন্দু গুণের ‘স্ববিরোধী’ কবিতাটি এ ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক: “আমি জন্মেছিলাম এক বিষণন্ন বর্ষায়/কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত/ আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে/ কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল/ আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে/কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি/ আমি জন্মেছিলাম ছায়াসুনিবিড় গ্রামে/ ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা/ জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম/এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায়”।
জুলাই বিপ্লবের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই এক বছরের অর্জনের হিসাব কিতাব করা কোন জটিল কিছু না। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে টাউট-বাটপার, হোয়াইট কলারড বসন্তের কোকিল, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, খুচরো ও পাইকারী ব্যবসায়ী, অলিগার্ক ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক গোষ্ঠী, মিডিয়া প্লেয়ার, গিরগিটি বুদ্ধিজীবি শ্রেণী সবাই সব কিছু প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে। এরপরেও পর্দার আড়ালে হয়ত অনেক কাটাকুটি, সাপলুডু আর পাশা খেলা হয়েছে, হচ্ছেও। ওগুলো তো ভিআইপি বুড়োদের বদ খাসলত। তাই সাধারণের তা জানার ক্ষমতাও নেই, অধিকারও নেই।
এখন সর্বশেষ পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে বলা মুশকিল। আমরা গুজবের আর হুজুগের বাংগালী। তাই মনের মাধুরি মেশানো নানা গসিপ সত্যের মত করে ব্রেকিং নিউজ আকারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর চ্যানেলের প্রাইম নিউজে ঘুরছে। কেউ বলছেন আরেকটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার হবে, যারা নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কেউ বলছেন একাজের জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারই যথেষ্ট। কেউ বলছেন তাহলে উপদেষ্টা পরিষদের পুনর্গঠন অবশ্যম্ভাবী। কেউ কেউ আশংকা করছেন অন্য কিছুর। এত কিছু ইফস এণ্ড বাটস-এর মধ্যে পতিত শক্তি সংগঠিত হচ্ছে জোরেশোরে। গেরিলা প্রশিক্ষণের আয়োজনও নাকি হয়েছে একাধিক। বিভিন্ন সেক্টরের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা পরাজিত প্লেয়াররা টানেলের প্রান্তে দূরবীন ফিট করে রেখে সারাক্ষণ তাতে চোখ রাখছেন। কোথাও এতটুকু আলোর ছটা দেখা যায় কিনা? দরকার হলে ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে হবে, আক্রোশটা এমন। এরি মধ্যে হুক্কা হুয়ার মত সব শেয়ালের এক রা উঠছে: আগেরটাই ভালো ছিলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডাহা মিথ্যার চাষাবাদ হচ্ছে, অত্যাধুনিক প্রযুুক্তির ব্যবহারও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই বলে অন্য গ্রুপও বসে নেই। তারাও প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে তাদের মত করে। জনগণ বিনে পয়সায় সার্কাস উপভোগ করছে। ভাগযোগের এই কামড়াকামড়িতে তারা বরাবরের মত নির্লিপ্ত।
যে যার মত দাবী নিয়ে রাস্তায় নামছে, সড়ক-মহাসড়ক দখল করে পাবলিকের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। এ নিয়ে পাবলিকের সাথে ক্যাচাল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কে শোনে কার কথা? আন্দোলনের নামে ডাইরেক্ট একশন খুব পপুলারিটি পেয়েছে। যে কেউ দল বেধে এসে যমুনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, শাহবাগ দখল করে তর্জন-গর্জন করছে, কেউ কেউ আগ্রাসী হয়ে সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছে, গেইট ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করছে, তছনছ করছে গাড়ী, সরকারি সম্পত্তি। যে যেমন করে পারছে দাবী আদায় করে নিয়েও যাচ্ছে। কোমলমতি ছাত্র বলে যাদেরকে আমরা বাবা সোনা বলে ডাকি তারাও আসে, হম্বিতম্বি করে, সবশেষে ভাংচুর করে দাবী আদায় করে নিয়ে চলে যায়। তাদের দেখাদেখি সরকারি-বেসরকারি, পেশাজীবিরাও অনুরূপ কাজ করছে। সম্প্রতি এনবিআরের কর্মকর্তা ও সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবীর নামে সরকারকে কয়েকদিন জিম্মি করে রেখে যা করলেন তা কয়েকশ’ বছরের প্রশাসনে অকল্পনীয়। পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে এদেরকে প্রতিহত করার মত কোন ব্যবস্থাই কাজ করছিলো না। এর নেপথ্যে কারা গুটিবাজি করেছে তা আর কেউ তালাশ করে নি। আরেকটি অধ্যাদেশ জারি করে পরিস্থিতির সাময়িক সামাল দেওয়া গেছে। এখন পুলিশের সামান্যতম ক্রেডিবিলিটি নেই। তাদের মনোবল বলে কিছু নেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাই সেনাবাহিনী হুটহাট দৌড়ে আসে। কিন্তু এটা তো কোন কার্যকরী সমাধান না।
মব কালচার এখন মূর্তিমান আতংক। কখন কি কারণে এর উদ্ভব হবে আগে থেকে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায় না। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, সাহস করে হাত বাড়ালেই, কর্কশ কন্ঠে আওয়াজ দিতে পারলেই কোটি কোটি টাকা নগদে বা চেকে মিলে যাচ্ছে। লোভনীয় এই বাস্তবতাকে কাজে লাগাতে কামেলিয়েরা ব্যস্ত। এক্ষেত্রে ছোটদের আর বড়দের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ট্র্যাজেডি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে যে, অবনমনের এ যুগে ছোটরাও এখন বড়দের গ্রাসে হাত ভরে দিচ্ছে। ভাবটা এমন যে, নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, নীতির কথা আপাতত তোলা থাক। ভাষণে, বয়ানে, মিছিলে, টক শোতে যারা যা-ই বলেন বাস্তবে তাদের অনেকের চেহারা চিত্র কিন্তু ভিন্ন। অথচ সবাই পাবলিকলি চাচ্ছি দেশটা সোজা হয়ে দাঁড়াক, সব কিছু সুন্দরভাবে চলুক। দুষ্টু যারা, তারা নিপাত যাক। শিষ্ট যারা, তাদের কদর হোক। কিন্তু আমি আমার জায়গা থেকে এক চুলও নড়ছি না। উপর থেকে ফেরেশতারা এসে দেশটাকে সোনার বাংলা করে দিয়ে যাবে এই আশা এখন আমাদের মননে-মগজে। বৈপরীত্য আর কাকে বলে?
দেখতে দেখতে এক বছর চলে গেলো। পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিলো সে তিমিরেই থেকে যাচ্ছে, নাকি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে? বেহাত বিপ্লব কি তবে হাতছাড়াই হয়ে যাচ্ছে? এর পরে কি? কেউ জানে না। অতি উৎসাহীরা এরিমধ্যে ননস্টপ কোরাস গাইতে শুরু করেছে, ‘আগেরটাই ভালো ছিলো- এই এসে গেলো বলে’ ইত্যাদি। আমাদের চরিত্রগত বৈপরীত্য নিয়ে আর যাই হোক ভালো কিছু আশা করা কষ্টকর। তবু আশাবাদী মন আশায় বুক বাধে। ভালো কিছু দেখলেই তা উজ্জীবিত হয়, আবার পরমুহুর্তেই প্রবঞ্চনার কথা ভেবে হতাশ হয়।
জুলাই বিপ্লব অভাবনীয় বেশ কিছু ঘটনার স্বাক্ষী। স্বাধীনতার পর দেশে, বোধকরি পৃথিবীতেও, এটাই এখন পর্যন্ত একমাত্র যে, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী ১৫ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতাসীন থেকেও প্রচণ্ড জনরোষের কারণে পুরো দলকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে পালিয়ে গেছে। দেশের পুরো পার্লামেন্টের সলিল সমাধি হয়েছে। এক বছর হতে চললো পার্লামেন্টের স্পীকার কোথায় কেউ জানে না। ডেপুটি স্পীকার এখন জেলে। পুরো মন্ত্রী পরিষদের বেশির ভাগ মন্ত্রী হয় জেলে না হয় পালিয়ে দেশান্তরি হয়েছে। পুলিশের অন্তত গণ্ডাখানেক আইজির বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের অভিযোগ তদন্তাধীন, তাদের মধ্যে দু’জন আইজি জেলে, এদের মধ্যে একজন সম্প্রতি রাজস্বাক্ষী হয়েছেন। অন্যরা দেশে-বিদেশে পলাতক। জুলাই বিপ্লবের পর পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে গিয়েছিলো। বেশিরভাগ থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। অনেকে এখনো কর্মস্থলে ফিরে আসে নি। তাদেরকে সেনাবাহিনীর পরিবেষ্টিত অবস্থায় অফিস করতে হয়েছে। এখনো পুলিশ সিনা শক্ত করে দাঁড়াতে পারেনি। রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত তারা মার খাচ্ছে বা অপদস্থ হচ্ছে। এমন অবস্থা এদেশে তো বটেই, পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখা গেছে কিনা কে জানে?
বেসরকারি প্রশাসনের অবস্থাও অনেকটা অনুরূপ। পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনেকেই অসহায় হয়ে সেনা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন মুখ্যসচিব সহ অনেক সচিব এখন জেলে, কেবিনেট সেক্রেটারিদের মধ্যে কারো কারো পরিণতি অনুরূপ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডিসিদেরকেও ছাত্রদের হাতে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। বদলী করে, পরিবর্তক কর্মকর্তা পদায়ন করে প্রশাসনকে এখনো আস্থাভাজন করে গড়ে তোলা যায় নি। বেসামরিক প্রশাসনের আড়াই শ’ বছরের ইতিহাসে এর অযুতাংশ চিত্রও দেখা যায় নি।
মিডিয়া টাইকুনরা ঝাঁকে ঝাঁকে কারাগারে, অনেকে কট হওয়ার পথে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভনর্রদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনরোষে প্রহৃত হয়ে জেলে, আরেকজন আদালতে চরম অপদস্ত হয়েছেন। বাকীদের বিষয়েও অনুরূপ অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি এখন কোথায় কেউ জানে না। আরেকজন, যিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন, ছিলেন দেশের যথেচ্ছাচারী প্রধান বিচারপতি তিনিও জেলে। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এজলাসে মুখোমুখি হয়ে তার মুখ থেকেই তাকে শুনতে হয়েছে সুকর্ম মানুষকে সম্মান দেয়, আর দুষ্কর্ম বয়ে আনে চরম অসম্মান ও অকল্পনীয় ভোগান্তি। বিচার বিভাগের ইতিহাসে আমাদের দেশে তো নয়ই, পৃথিবীর আর কোথাও এমনটি এত ব্যাপক আকারে হয়েছে কিনা জানা নেই।
জাঁহাবাজ সি-িকেটেড ব্যবসায়ীদের অনেকেই পলাতক, কেউ কেউ দেশান্তরি আর অনেকেই প্রহর গুনছেন আইনের মুখোমুখি হওয়ার। এক ঝাঁক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবি-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- অর্থনীতিবিদ এখন জেলে। অনেকে গা ঢাকা অবস্থায় আছেন। অনেকে হয়ত সীমান্ত অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছেন। এরকম চিত্র তো আমাদের কাছে একেবারেই নতুন ও অভাবনীয়। এগুলো সবই জুলাই বিপ্লবের অর্জন। কেউ ভাবতেও পারেনি এতসব সম্ভব হবে এদেশে। স্বৈরশাসন, দু:শাসন, বিচারহীনতা, লুটপাট, অলিগাকের্র আগ্রাসনে নিমজ্জিত পুরো একটা সিস্টেম এভাবে অকার্যকর হয়ে যাবে তা কারো কল্পনাতেও ছিলো না, অথচ সেটাই আজ নির্মম বাস্তবতা। জুলাই বিপ্লব এটাই চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ভবিষ্যতে যারা এরূপ জোর-জুলুম-অনয়ায়-অবিচার করবেন তারা কোন না কোন সময় আইনের আওতায় আসবেনই।
বিপ্লবোত্তর কোন দেশেই শৃঙ্খলা রাতারাতি পুন:স্থাপিত হয় না। সময় নেয়। গেলো একবছরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি, বৈষম্য নিরসন করা যায় নি, প্রশাসনের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় নি। তার কারণ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর পরই বেহাত হয়ে যাওয়া। বহু হাতের কারুকাজ এখানে এখনো ক্রিয়াশীল। আরেকটি কারণ হলো বিপ্লবের অগ্রদূত ছাত্রদের কোন অভিভাবক না থাকা, বা যারা ছিলেন তারা পদ, পদবী নিয়ে তাদের পরিত্যাগ করে সরে গেছেন অথবা ছাত্ররা নিজেরাই স্টিয়ারিং হাতে এডভেঞ্চারিজমে মত্ত থাকায় তাদের মধ্যে অনেকেই নীতিতে, কীর্তিতে, আচরণে বিপথগামী হয়ে গেছেন। যার নেগেটিভ ইম্পেক্ট পড়েছে জনমানসে, তাদেরকে নিয়ে তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট। ছাত্ররা যত তাড়াতাড়ি নিজেদেরকে সুসংগঠিত করে তুলতে পারবে আর দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদরা যত দ্রুত দেশের স্বার্থে একতাবদ্ধ হয়ে সমদ্রুতিতে চলা শুরু করবেন বিপ্লবের অভীষ্ট অর্জন তত বেশি স্পষ্ট হবে ও অর্জন তত সহজ হবে। জুলাই বিপ্লবের অভূতপূর্ব ঘটনা জাতীকে ঘুরে দাঁড়াতে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এটুকু প্রাপ্তিই বা কম কিসের? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: কলামিস্ট