Saturday 20 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অভিবাসনের শক্তিতে গড়ে উঠবে দরিদ্রতম জেলার সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধি

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:৩৬

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রাম দারিদ্র্য, বন্যা, নদীভাঙন ও কর্মসংস্থানের সংকটে দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে রয়েছে। অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি উৎপাদন স্থিতিশীল নয়। এর ফলে এখানে দারিদ্র্যের হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এই জেলাকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিতে অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে।

জেলার মোট আয়তন ২২৪৫.০৪ বর্গ কিলোমিটার এবং ২০২২ সালের জনগণনা অনুসারে কুড়িগ্রামের মোট জনসংখ্যা ২৩,৮৩,২৬৮ জন যার মধ্যে প্রায় শতকরা ৭৮.৩ জনসংখ্যা গ্রামাঞ্চলে বাস করে। জনসংখ্যার অধিকাংশ মুসলিম (৯৩.৮%) , হিন্দু (৬.৫৫%) এবং অন্য ধর্মাবলম্বীর লোকজনও বাস করে।জেলার বাসিন্দাদের ৭০.৪% শস্য উৎপাদন, মাছ ধরা, গবাদি পশু এবং হাঁস-মুরগি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে, ৯.৪৫% লোক বাণিজ্য এবং পরিষেবা খাতে ৪.৯৮% লোক কাজ করে ।

বিজ্ঞাপন

অভিবাসন একটি প্রাকৃতিক এবং সামাজিক-জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। মাইগ্রেশন শব্দের অর্থ অভিবাসন, স্থানান্তর ইত্যাদি। এটিকে সাম্প্রতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীনকালে অভিবাসন শুরু হয়েছিল যখন মানুষ স্বেচ্ছায় (খাদ্যের সন্ধানে) অথবা অনিচ্ছাকৃত (প্রাকৃতিক দুর্যোগ) কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হত (ইকবাল আহমেদ চৌধুরী এবং অন্যান্যরা, ২০১২)। অভিবাসন দুই প্রকার।যথা-(১) ইন্টারনাল অভিবাসন: যখন দেশের অভ্যন্তরে ঘটে থাকে।যেমন- কুড়িগ্রাম থেকে যদি লোকজন চট্রগ্রাম বা নারায়নগজ্ঞ কিংবা দেশের মধ্যে অন্য কোন অঞ্চলে যায়।(২) এক্সটারনাল অভিবাসন: যখন একদেশ থেকে অন্য দেশে মাইগ্রেশন ঘটে থাকে।যেমন- রোহিঙ্গারা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। মাইগ্রেশনের কারনও দুই প্রকার।যথা- (১) পুশ ফ্যাক্টর: প্রাকৃতিক দূর্যোগ,নদী ভাঙ্গন,জলবায়ু পরিবর্তন,রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদি। পুশ বলতে ধাক্কা দেয়া, বল প্রয়োগ করা ইত্যাদিকেও বোঝায়।সহজভাবে বলতে গেলে যে সকল কারণ কোন জনগোষ্ঠী বা কোন ব্যক্তিকে তার জন্মস্থান বা আবাসভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করে তাকে পুশ ফ্যাক্টর বলে।(২) পুল ফ্যাক্টর: পুল ফ্যাক্টর বলতে আকর্ষণ বা টানা বোঝায়। সহজভাবে বলতে গেলে উন্নত জীবন যাপনের আশায় মানুষ যখন একদেশ থেকে অন্যদেশে স্থানান্তরিত হয়, তখন তাকে পুল ফ্যাক্টর বলে। যেমন- উন্নত জীবন যাপনের জন্য অনেকে আমেরিকা,কানাডা,অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।

কুড়িগ্রামে প্রায় দিনের গড় তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ৩৬ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং রাতের গড় তাপমাত্রা ১৪ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ২৬ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এর মধ্যে থাকে। এখানে বছরে প্রায় ২০২ দিন বৃষ্টিপাত হয় এবং মোট বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৩৬৪৭ মিমি (আবহাওয়া এবং জলবায়ু)।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ভবিষ্যতে কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হিসেবে স্থানান্তরে বাধ্য হবে, যার বড় কারণ হবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। কুড়িগ্রামে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বিশেষত ধান, ভুট্টা, গমসহ প্রধান খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তীব্র গরমে পানি সংকট তৈরি হয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি (হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া) বাড়ে। গবাদি পশু ও মাছের উৎপাদনও প্রভাবিত হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জীবিকা হারানো পরিবারগুলোর বিকল্প আয়ের জন্য পুরুষ সদস্যরা শহরে চলে যাচ্ছে যা অস্থায়ী অভিবাসন তৈরি করছে।

বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত পারিবারিক আয় ও ব্যয় জরিপ (HIES) অনুসারে, কুড়িগ্রাম জেলার ৭০.৮৭% জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ২০১৪ সালে এটি ছিল ৬৩.৬৭ শতাংশ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে এই জেলার গড়ে ৭২.৯৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যার অর্থ দারিদ্র্যের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলার মধ্যে চর রাজিবপুরে দারিদ্র্যের হার ৭৯.৮% রৌমারিতে ৭৬.৪%, চিলমারীতে ৭৩.৫%, ভুরুঙ্গামারীতে ৭১.৯%, নাগেশ্বরীতে ৭২.৭৬%, কুড়িগ্রাম সদরে ৭২.৬%, ফুলবাড়িতে ৬৯%, উলিপুরে ৭০.৮% এবং রাজারহাটে ৭০.১%। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশের সকল উপজেলা দারিদ্র্য তালিকার (বিবিএস) মধ্যে রাজীবপুর সর্বোচ্চ স্থান অর্জন করেছে, বান্দরবান, দ্বিতীয় রৌমারি তৃতীয়, চিলমারী চতুর্থ, ভুরুঙ্গামারী পঞ্চম, নাগেশ্বরী ষষ্ঠ, কুড়িগ্রাম সদর সপ্তম, ফুলবাড়ী অষ্টম, উলিপুর নবম এবং রাজারহাট দশম স্থানে রয়েছে। বলা যেতে পারে যে, দ্বিতীয় স্থান (বান্দরবান) ছাড়া দারিদ্র্যের সর্বোচ্চ দশটি স্থানই কুড়িগ্রাম জেলায় অবস্থিত।

এক গবেষণায় দেখা গেছে যে স্থানান্তরিত হওয়া লোকদের মধ্যে অল্প শিক্ষিত লোকও রয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই এমন অভিবাসীদের সংখ্যা ২৩.২৩%, মাধ্যমিক শিক্ষিত লোকের অভিবাসীর হার ৪১.০৭%, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষিত লোকের অভিবাসীর হার ৩.৩২%, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অভিবাসীদের হার ৩.৩১% যা খুবই কম । কুড়িগ্রাম থেকে ইন্টারনাল অভিবাসনের হার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ % বা ২০,০০০ থেকৈ ২৫,০০০ ইন্টারনাল অভিবাসী এবং এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রাম থেকে বিদেশে কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা BMET-রেকর্ড অনুসারে প্রায় ১,৯৭৬ জন, আর অন্য সূত্রের রেকর্ডে প্রায় ৪৫৭ জন। ম্যাক্স ওয়েবার এর মতে পেশা হলো একটি নির্দিষ্ট কাজ বা দায়িত্ব যা মানুষ নিয়মিতভাবে সম্পাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং সমাজে অবদান রাখে।কিছু পেশা রয়েছে যেগুলো অভিবাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুড়িগ্রাম জেলা থেকে যে সকল পেশার মানুষ বেশি পরিমাণে অভিবাসনে গমণ করে তাদের মধ্যে হলো দিন মজুর সবচেয়ে বেশি ৩৮.৬%, পোশাক শ্রমিক ৩৪%, রিক্সা চালক ৮.৭%, চাকুরিজীবি ৪.৬%, দর্জি ৩.১%, শিক্ষার্থী ২.৯%, কৃষক ৫%এবং ব্যবসায়ী ৩.১%।

স্থানীয়ভাবে পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে কুড়িগ্রামে বিবাহিত ৩৯১ জন এবং অবিবাহিত ৭৮ জন অভিবাসনে গমন করেছে।বিবাহিতরা অবিবাহিতদের তুলনায় ৫ গুণ বেশি অভিবাসন করছেন। অভিবাসনের অন্যতম প্রধান পুশ ফ্যাক্টর বিবাহ (কবীর প্রমুখ, ২০১৮) কারণ বিবাহিত পুরুষকে তার স্ত্রী সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যয় বহন করতে হয়। ইন্টারনাল অভিবাসনের জন্য ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বয়সের লোকেরাই অভিবাসনে বেশি গমন করে।উন্নয়নশীলদেশ গুলিতে অভিবাসনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগই তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (UNDP, 2009)। ইন্টারনাল অভিবাসনের ক্ষেত্রে কুড়িগ্রাম থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ স্থানান্তরিত হয় ঢাকায় ৪৬%, কুমিল্লায় ১০.৬৪% এবং চট্রগ্রামে ৪.৪%। এছাড়াও মানুষ কামরাঙ্গীর চর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ এবং অন্যান্য স্থানেও স্থানান্তরিত হয়। মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা ৩.৫ গুন বেশি ইন্টারনাল মাইগ্রেশন করছে।

কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দারা ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ঘন ঘন বন্যা এবং তীব্র জলবায়ুগত ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, যা দারিদ্র্য বৃদ্ধির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। বন্যা এবং নদী ভাঙন কেবলমাত্র ফসল ধ্বংস করে না এবং মাটির উপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলে বরং ভাঙনের ফলে মানুষ আবাদযোগ্য জমি থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয়। (কার্তিকি, ২০১১)। কৃষির উপর নির্ভরশীলতার কারণে নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়া মানুষের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে, ফলে তারা যে কৌশল এবং রীতিনীতিগুলি সাধারণত গ্রহণ করে তা ব্যবহার করতে পারে না (রহমান, ২০১৮)। কুড়িগ্রামের কৃষকরা এরুপ নতুন পরিবেশ বুঝতে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং তাদের জমি কীভাবে পুনরুদ্ধার করবেন তা জানেন না (উজ্জামান প্রমুখ, ২০১৬)। শুধু আর্থিক সম্পদের অভাবই নয়, বরং তাদের নতুন জলবায়ুর নতুন অবস্থার সাথে আরও উপযুক্ত আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে (আল-মারুফ প্রমুখ, ২০২২)।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের পৈত্রিক ভূমিতে বসবাসে নানারুপ সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং বসতবাড়িতে টিকে থাকতে পারে না। এ অবস্থায় থেকে উত্তরণ জটিল হওয়ায় মানুষের কাছে তাদের নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প থাকে না। যখন মানুষের খাবার থাকে না ,সুপেয় পানির অভাবে দেখা যায় এবং চিকিৎসা সেবা সহ সকল প্রকার সেবা পেতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় তখন মানুষ শত কষ্টের মধ্য দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অভিবাসন সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক নয় এর অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে।তবে অভিবাসীরা যদি শিক্ষিত,দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন হয় এবং ইন্টারনাল অভিবাসনের তুলনায় যদি এক্সটারনাল অভিবাসনের হার বাড়ে তাহলে আর্থ-সামাজিক সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধি দু’টোই বাড়ে এবং টেকসই উন্নয়ন হয়।অভিবাসন শুধু কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য হ্রাসই করবে না, বরং এই জেলাকে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় অঞ্চলে রূপান্তর করতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে কুড়িগ্রাম অভিবাসনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম

সারাবাংলা/এএসজি

অভিবাসন জেলার সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধি প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

জাপানে রেকর্ড সংখ্যক নারী শতবর্ষী
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৯:১৩

আরো

সম্পর্কিত খবর