Sunday 21 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খাদ্যের সমাজতত্ত্ব: বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে খাওয়ার অর্থ

ড. মতিউর রহমান
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:৩৯

খাদ্য কেবল বেঁচে থাকার জন্য পুষ্টির উৎস নয়। কোনো সমাজে খাদ্যাভ্যাস সেই সমাজের মানুষের সামাজিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং প্রতীকী মূলধনকে তুলে ধরে। এটি কেবল আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করে না, বরং আমাদের পরিচয়, সামাজিক অবস্থান এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটায়। বাংলাদেশে, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈচিত্র্য এবং এক সমৃদ্ধ খাদ্যসংস্কৃতি বিদ্যমান, সেখানে খাদ্যাভ্যাস কেবল ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় নয়; এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বুরদিউ তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘ডিস্টিনকশন’-এ (Distinction) দেখিয়েছেন যে, সমাজে শ্রেণি বিভাজন কেবল অর্থনৈতিক মূলধনের ওপর নির্ভর করে না, বরং এটি সাংস্কৃতিক মূলধন এবং প্রতীকী মূলধন (symbolic capital) দ্বারাও নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাস এই তত্ত্বের এক জীবন্ত উদাহরণ। খাদ্য এখানে কেবল পুষ্টির উৎস নয়, এটি একটি সামাজিক বিভাজন রেখা যা মানুষের রুচি, শিক্ষা এবং সামাজিক অবস্থানকে প্রকাশ করে।

বিজ্ঞাপন

উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে খাদ্যাভ্যাস তাদের সামাজিক অবস্থানকে তুলে ধরে। তাদের খাদ্যতালিকায় থাকে বৈচিত্র্যময় খাবার: ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের পাশাপাশি বিদেশি বা ফিউশন কুইজিন। এই শ্রেণির মানুষেরা খাবারের উৎস এবং গুণগত মানের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। তারা অর্গানিক (জৈব) খাবার, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য এবং বিশেষ দোকান থেকে কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন।

উৎসবে বা বিশেষ আয়োজনে একাধিক পদের ‘এলাবোরেট মেনু’ তৈরি করা হয়, যেমন— পোলাও, বিরিয়ানি, রেজালা, কোফতা, রকমারি মিষ্টি এবং ফিরনি। এই খাবারগুলো কেবল পেট ভরানোর জন্য নয়, বরং পরিবারের প্রাচুর্য, রুচি এবং আভিজাত্য প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক রেস্তোরাঁ, কফিশপ বা বিশেষ ধরনের ক্যাফেতে যাওয়া তাদের শিক্ষিত ও বৈশ্বিক জীবনধারার প্রতীক। এই খাদ্যাভ্যাস তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে এবং একটি ‘উচ্চ রুচি’র পরিচয় দেয়।

অন্যদিকে, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভ্যাস মূলত খাদ্যনিরাপত্তার ওপর নির্ভরশীল। তাদের পাতে থাকে সীমিত উপকরণে তৈরি সাধারণ খাবার, যা তাদের দৈনন্দিন ক্যালোরি চাহিদা পূরণ করে। তাদের কাছে খাবার বিলাসিতা নয়, এটি বেঁচে থাকার সংগ্রাম। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা তাদের খাদ্য পছন্দকে সীমিত করে দেয়। যেমন, তারা প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য দামী মাছ বা মাংসের পরিবর্তে সস্তা মাছ, ডিম বা ডাল ব্যবহার করতে বাধ্য হন।

তাদের খাদ্যাভ্যাসকে সামাজিকভাবে ‘সাধারণ’ বা ‘নিম্ন’ হিসেবে দেখা হয়, যা তাদের প্রতীকী মূলধনকে আরও দুর্বল করে। এই শ্রেণিবৈষম্য কেবল খাবারের ধরনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি খাদ্যগ্রহণের পদ্ধতিতেও প্রতিফলিত হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারে নির্দিষ্ট সময়, সুন্দর টেবিল এবং পরিবেশন রীতি মেনে খাবার খাওয়া হয়। নিম্নবিত্ত পরিবারে এই ধরনের আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ কম থাকে, কারণ সেখানে খাবার একটি দ্রুত গ্রহণীয় বস্তু।

বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাস এই ভূখণ্ডের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের এক জীবন্ত উদাহরণ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব খাদ্যসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যা সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা এবং পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

নদীপ্রধান অঞ্চল: দক্ষিণের বরিশাল, খুলনা, এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাছ ও সামুদ্রিক খাবারের প্রাধান্য থাকে। ইলিশ, চিংড়ি এবং বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ তাদের খাদ্যতালিকায় প্রধান স্থান দখল করে। এই অঞ্চলের মানুষেরা মাছের বিভিন্ন ধরনের রান্না (যেমন—ভর্তা, ভাজি, ঝোল) তৈরিতে পারদর্শী।

উত্তরাঞ্চল ও শুষ্ক অঞ্চল: উত্তরের রাজশাহী, বগুড়া বা দিনাজপুর অঞ্চলে সরিষার তেল ও মাংসভিত্তিক রান্নার চল বেশি। বিশেষ করে বগুড়ার দই, বা বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি তাদের আঞ্চলিক পরিচয়ের অংশ। এখানে শুকনো খাবার ও পিঠার প্রচলনও বেশি।

সিলেট ও পাহাড়ি অঞ্চল: সিলেটের খাদ্যাভ্যাস কিছুটা ভিন্ন। এখানে সাতকরার মতো বিশেষ ফল এবং বিভিন্ন ধরনের মাংসের রান্না জনপ্রিয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস তাদের জাতিগত পরিচয়ের অংশ। যেমন, পাহাড়ি অঞ্চলে বাঁশের কোড়ল দিয়ে তৈরি খাবার তাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

এই আঞ্চলিক বৈচিত্র্য কেবল খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আঞ্চলিক পরিচয়বোধকেও শক্তিশালী করে। গ্রাম থেকে শহরে আসা অভিবাসীরা নতুন এক মিশ্র খাদ্যসংস্কৃতি তৈরি করেছে। তারা নিজেদের আঞ্চলিক ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করার পাশাপাশি শহরের আধুনিক খাদ্যাভ্যাসও গ্রহণ করছে। এই মিশ্রণ খাদ্যকে কেবল বেঁচে থাকার উপাদানে সীমাবদ্ধ না রেখে, তা ব্যক্তিগত পরিচয় এবং সামাজিক অবস্থান প্রকাশের একটি মাধ্যমে রূপান্তরিত করেছে।

খাদ্য কেবল শ্রেণি বিভাজন নয়, এটি লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক ভূমিকাও নির্ধারণ করে। পরিবারে নারীদের প্রধান দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো খাবার রান্না ও পরিবেশন করা। এই ভূমিকা তাদের জন্য কেবল একটি কাজ নয়, বরং পরিবারের প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং যত্ন প্রকাশের মাধ্যম। তাদের এই অবদানকে প্রায়শই অদেখা থাকে, তবে এটি পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গৃহিণী হিসেবে নারীরাই রান্নাঘরের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। তাদের ভালোবাসা, যত্ন এবং পারিবারিক দায়িত্ববোধ খাবারের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। খাবারের মান, পুষ্টি এবং স্বাদ নিশ্চিত করা তাদের সামাজিক কর্তব্যের অংশ। উচ্চবিত্ত পরিবারে গৃহকর্মী থাকলেও, নারীরাই খাবারের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করেন, যা তাদের গৃহিণী হিসেবে কর্তৃত্বের প্রমাণ। তবে, এই ভূমিকা অনেক সময় তাদের ওপর মানসিক চাপও সৃষ্টি করে, কারণ খাবারের মানের ওপর পরিবারের সদস্যদের সন্তুষ্টি নির্ভর করে।

অন্যদিকে, পুরুষরা সাধারণত পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ বা ক্রয় করেন, যা তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং বাইরের বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের প্রকাশ ঘটায়। অতিথি আপ্যায়ন বা পারিবারিক ভোজে পুরুষরা অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। খাবারের টেবিলে পুরুষদের বসার স্থান, খাবার পরিবেশনের ক্রম এবং আপ্যায়নের ধরন সমাজে তাদের প্রভাব ও মর্যাদাকে তুলে ধরে। এই লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন খাদ্যকে কেবল পুষ্টির মাধ্যম না রেখে, এটিকে সামাজিক কাঠামো এবং ক্ষমতার সম্পর্কের এক প্রতিফলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত ও তরুণ প্রজন্ম আধুনিকতা ও বিশ্বায়নের প্রভাবে নতুন এক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলছে। এই প্রবণতা ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে আরও বেগবান হয়েছে।

ডিজিটাল মিডিয়ার প্রভাব: ফুড ব্লগ, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো খাদ্যাভ্যাসকে এক নতুন সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কোনো নামকরা রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া বা আকর্ষণীয় খাবারের ছবি পোস্ট করা এখন কেবল একটি অভিজ্ঞতা নয়, এটি সামাজিক স্বীকৃতির মাধ্যম। এর মাধ্যমে মানুষ তাদের জীবনধারা, রুচি এবং আধুনিকতাকে অন্যদের সামনে তুলে ধরে। এটি এক ধরনের প্রতীকী প্রতিযোগিতা, যেখানে কে কতটা আধুনিক এবং বৈশ্বিকভাবে সংযুক্ত, তা খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।

ট্র্যাডিশন বনাম ট্রেন্ড: ঐতিহ্যবাহী খাবার, যেমন সর্ষে ইলিশ, বিরিয়ানি বা হাতে তৈরি পিঠা এখনও উচ্চবিত্ত পরিবারে নিজেদের শিকড়ের প্রতি আনুগত্য ও আর্থিক ক্ষমতার প্রতীক। কিন্তু একইসঙ্গে, ফিউশন ফুড বা কন্টিনেন্টাল কুইজিনের প্রতি তাদের আকর্ষণও বাড়ছে। অন্যদিকে, ‘স্ট্রিট ফুড’ এখন ক্যাফে এবং রেস্তোরাঁতেও পরিবেশন করা হচ্ছে, যা এই খাবারের সামাজিক মর্যাদা পরিবর্তন করছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সামাজিক পরিচয় ও শ্রেণি অবস্থান খাদ্যের মাধ্যমে কীভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও বিবর্তিত হচ্ছে।

খাদ্যের ভিন্নতা বা প্রাচুর্য ছাড়াও, এর সহজলভ্যতা বাংলাদেশের কাঠামোগত বৈষম্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। গ্রামীণ দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন বন্যা), এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যাভ্যাসকে সীমিত করে দেয়।

অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি: নিম্ন আয়ের পরিবারে শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা, কৃমি এবং নানা ধরনের রোগ দেখা যায়, যা মূলত অপর্যাপ্ত এবং ভারসাম্যহীন খাদ্যের কারণে হয়। এটি তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে বাধা দেয়, যা শিক্ষাসহ ভবিষ্যতের সব ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে।

খাদ্যের অভিগম্যতা: খাদ্যের অভিগম্যতা নিজেই একটি সামাজিক বৈষম্যের চিহ্ন। ধনীরা যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত এবং পুষ্টিকর খাবার কিনতে সক্ষম, সেখানে দরিদ্ররা প্রায়শই নিম্নমানের বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, খাদ্য কেবল সংস্কৃতি ও মর্যাদার প্রতীক নয়, বরং এটি একটি সমাজের বৈষম্য, দুর্বলতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবকেও প্রকাশ করে।

বাংলাদেশে খাদ্য কেবল একটি পুষ্টি উপাদান নয়, এটি একটি জটিল সামাজিক আয়না। এটি কেবল ব্যক্তিগত পছন্দ নয়, বরং শ্রেণি, আঞ্চলিক পরিচয়, লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা, এবং সামাজিক মর্যাদার এক প্রতীক। আধুনিকতা ও বিশ্বায়নের প্রভাবে খাদ্য আমাদের পরিচয় প্রকাশের এক নতুন মাধ্যম হয়ে উঠেছে, যেখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এর গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে, খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং বৈষম্য দেশের গভীর সামাজিক কাঠামোকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। খাদ্য, এইভাবে, বাংলাদেশের সমাজের সংস্কৃতি, পরিচয় এবং শ্রেণি-সংক্রান্ত বৈষম্য বোঝার এক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একটি প্লেটে পরিবেশিত প্রতিটি খাবারই কেবল একটি শারীরিক চাহিদা পূরণ করে না, বরং এটি একটি দীর্ঘ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসের গল্পও বলে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি

খাদ্যের সমাজতত্ত্ব ড. মতিউর রহমান মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আবেগ আর রঙিন আমেজে আসছে শারদীয় উৎসব
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর