Saturday 27 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শারদীয় দুর্গোৎসব: বাঙ্গালীর ঐতিহ্য, সম্প্রীতি, আবেগ ও শৃঙ্খলার নিদর্শন

সুমন বৈদ্য
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:৪৮

আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক-মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা। শরতের শীতল, স্নিগ্ধ ভোরে যখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহালয়ার এই পবিত্র বাণী যখন বেজে উঠে তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না, বছর ঘুরে আবারও মা দূর্গা এই সুন্দর ধমনীতে এসে পড়েছেন তার সন্তানদের কাছে।

শারদীয় দুর্গোৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণের মেলবন্ধন। দুর্গাপূজা বাঙালির হৃদয়ে সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটায়, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ থাকে। এই উৎসব আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত এক মহামিলনক্ষেত্র। আগামী ২৮শে সেপ্টেম্বর মহা ষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে বছর ঘুরে দেবী দুর্গার আগমন হবে এই ধরণীতে। শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু তাই শুধু ভক্তির অনুষঙ্গ নয়, এটি আমাদের সমাজে শুভশক্তির জাগরণ ও অসুরবিনাশের প্রতীক।

বিজ্ঞাপন

অতীত থেকেই দুর্গাপূজা উৎসবাকারে পালিত হয়ে আসছে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে। সবার মঙ্গল ও হিতকামনায় এমন বৃহত্তম আয়োজন খুবই গুরুত্ব বহন করে। সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে পূজার উৎসবে বয়ে আসুক সহযোগিতা, সহানুভূতি, সৌহার্দ্য ও সৌজন্যবোধ, আর এতেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন হয় অটুট। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির সব বিবেকবান মানুষ যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে যুগ থেকে যুগান্তরে- শারদীয় দুর্গোৎসবে এমন প্রত্যাশা থাকে দেশবাসীর। তাই সেই অর্থেই শারদীয় দুর্গোৎসবকে বলা হয়ে থাকে বাঙ্গালীর ঐতিহ্য, সম্প্রীতি, আবেগ ও শৃঙ্খলার নিদর্শন।

শ্রীশ্রী দুর্গাপূজা মাতৃভাবে ঈশ্বরের উপাসনা ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মানুষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত।পূজা ও উপাসনার অর্থ হলো ঈশ্বরকে অবলম্বন করে জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস। ঈশ্বরকে মাতৃভাবে পূজা ও উপাসনা করা সনাতন সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য।সব ধরনের বিপদ থেকে যিনি জীবকে রক্ষা করেন, জগতের কল্যাণ সাধন করেন ও মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করেন, তিনিই হচ্ছেন দেবী দুর্গা। তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও বিশেষণে অভিহিত হন। পুরাণে কথিত আছে, আদ্যাশক্তি মহামায়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের লক্ষ্যে ও সমগ্র জীবের কল্যাণার্থে যুগে যুগে ও কালে কালে বিভিন্ন রূপে ভিন্ন ভিন্ন নামে আবির্ভূত হয়েছেন। দেবী দুর্গা তারই বিশেষ সময়ের, বিশেষ যুগের এক বিশেষ রূপ।

দূর্গাপূজা প্রচলনের নানাবিধ উপাখ্যান আমরা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, দেবী ভাগবত পুরাণ, দেবীমাহাত্ম্য, রাজা সুরথের গল্প, মধু-কৈটভের কাহিনি, মহিষাসুরের কাহিনি, শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনি, কালিকা পুরাণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, শ্রীশ্রী চণ্ডী ইত্যাদি গ্রন্থে দেখতে পাই।

তবে মহিষাসুরমর্দিনীরূপে শরৎকালে দেবী দুর্গার অকালবোধনই বঙ্গদেশে সুপ্রচলিত। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়েছিল।

হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন, তাই এই সময় তাদের আরাধনার যথাযথ সময় নয়। অসময়ের পূজা বলে এই পূজার নাম হয় অকালবোধন। অন্যদিকে শ্রীশ্রী চণ্ডীর কাহিনি অনুসারে, পুরাকালে মহিষাসুর শতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে দেবতাদের পরাস্ত করে স্বর্গলোক অধিকার করেন। বিতাড়িত দেবগণ প্রজাপতি ব্রহ্মাকে মুখপাত্র করে মহেশ্বর ও বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন।

মহিষাসুরের অত্যাচারের কাহিনি শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন এবং তাদের মুখমণ্ডল থেকে মহাতেজ নির্গত হয়। একই সঙ্গে ইন্দ্র অন্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয় এবং সুউচ্চ হিমালয়স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজপুঞ্জ একত্র হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করে।

এই দেবীই কাত্যায়নী বা দুর্গা নামে অভিহিত হলেন। পরবর্তী সময়ে এই দুই রূপের মিলিত ধারায় মহিষাসুরমর্দিনীরূপে শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়।

আবহমান বাংলার অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। ব্রিটিশ বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। তবে অনেকের মতে, সম্ভবত মোগল আমল থেকেই ধনী পরিবারগুলোয় দুর্গাপূজা করা হতো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুর্গাপূজা স্বাধীনতার প্রতীকরূপে জাগ্রত হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারি হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। অবিভক্ত ভারতের খুলনা জেলার কপোতাক্ষ তীরবর্তী উথলী গ্রামে ১০৭৬ বঙ্গাব্দে দুর্গাপূজা প্রচলনের ইতিহাস স্বর্গীয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত এক প্রাচীন নথিতে লিপিবদ্ধ আছে।

এরই ধারাবাহিকতায় বিভক্ত বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশেও দুর্গাপূজার বহুল প্রচলন আরম্ভ হয় বলে ধারণা করা যায়।

পুরাণে উল্লেখিত আছে যে পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত বৈশ্য সমাধি মেধস মুনির আশ্রমে উপস্থিত হলে তার পরামর্শে উভয়ই দেবী দুর্গা বা ভগবতীর পূজা করেন। পূজায় তুষ্ট হয়ে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করেন দুর্গা।

পুরাণমতে, দুর্গা মহাদেব বা শিবের স্ত্রী। তার গায়ের রং অতসী ফুলের মতো সোনালি হলুদ। তিনি দশভুজা ও ত্রিনয়নী। তার বাহন সিংহ। দেবীপুরাণ, দেবী ভাগবত, কালিকাপুরাণ, দুর্গোৎসব বিবেক, দুর্গোৎসবতত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থে দুর্গা সম্পর্কে বর্ণনা আছে।

তারই ধারাবাহিকতায় শরতে দুর্গাপূজার প্রচলন। শাস্ত্রমতে, শ্রীশ্রী দুর্গাপূজায় সাতটি কল্প (প্রকার) থাকলেও আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত কল্পে (তৃতীয় কল্প) বিহিত পূজা সর্বাধিক প্রচলিত। বিবিধ অঙ্গানুষ্ঠানের বৈচিত্র্যময় সমাবেশ, বিশেষত স্নাপন (স্নান), পূজন, বলি ও হোম—এ চারটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যের আয়োজন, তাই এ পূজানুষ্ঠান মহাপূজা।

ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ কিন্তু অত্যাবশ্যক অঙ্গানুষ্ঠান—ষোড়শোপচারে (আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, স্নানীয়, বস্ত্র, ভূষণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য ও বন্দনা) পূজা হয়। গৃহে কোনো শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি এলে নানা আয়োজনে তাকে অভ্যর্থনা করা হয়, তার পছন্দের দ্রব্যাদি দিয়ে যত্নের সঙ্গে সেবা করা হয়, তাকে আনন্দ দেওয়ার ও তার প্রীতলাভের চেষ্টা করা হয়, জগন্মাতার আগমনে পূজায়ও যেন তদ্রূপ।

শাস্ত্রজ্ঞরা বলে থাকেন, ভক্তিসহকারে এসব উপচারদ্রব্য উপাস্য দেবতাকে সমর্পণ করলে তা সাধককে দেবসন্নিধানে নিয়ে যায় বা বাঞ্ছিত ফলকে নিকটে এনে দেয় বলে উল্লিখিত দ্রব্যাদিকে উপচার বলা হয়। পূজারি-সাধক বাইরে যেসব দ্রব্য প্রতিমাকে নিবেদন করেন, মনে মনেও সেসব চিন্ময়ী মাকে নিবেদন করেন।

অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজায় বলির অনুষ্ঠান। বলিতে সাত্ত্বিক, রাজসিক, স্থূল, সূক্ষ্ম (মনোবৃত্তি) ইত্যাদি প্রকারভেদ আছে। সাত্ত্বিক পূজারি বলির মাধ্যমে মনে মনে (সূক্ষ্মভাবে) কামাদি রিপুর বিনাশ চিন্তা করেন।

ভক্তের সাথে মায়ের সম্পর্কটা যেনো অনেকটা শিশুরই মতো। শিশু যেমন সর্বদা মায়ের কাছে যুক্ত থাকে। ভাবে, মা আছেন, সঠিক পথ দেখিয়ে দেবেন; মা আমার হাত ধরে আছেন, অতএব কোনো ভয় নেই। ভক্তের এই বিশ্বাসেই মায়ের সন্নিধানে যুক্ত থেকে জয় করেন ভয় ও বিপর্যয়কে। সাধারণের তত্ত্ব নয়, ফল প্রত্যাশিত। শাস্ত্র আশ্বস্ত করছে, এ পূজায় ধর্ম, অর্থ, কাম, মোহ— চতুর্বর্গ ফল লাভ হয়। শ্রীশ্রী চণ্ডীর আখ্যানে আছে, মহামায়ার কৃপায় রাজা সুরথ হৃত রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন।

সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে ‘দুর্গাষষ্ঠী’, ‘দুর্গাসপ্তমী’, ‘মহাষ্টমী’, ‘মহানবমী’ ও ‘বিজয়াদশমী’ নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় ‘দেবীপক্ষ’। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া; এই দিন সনাতনীরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে, অষ্টাদশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী উগ্রচণ্ডা তথা দশভুজার বোধন করা হবে কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, ষোড়শভুজা ভগবতী ভদ্রকালীর বোধন করা হবে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে এবং চতুর্ভুজা ও দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী বিগ্রহের বোধন করা হবে যথাক্রমে শুক্ল প্রতিপদে এবং শুক্লা ষষ্ঠীতে। আবার মহাকাল সংহিতার বিধানে প্রতিমাভেদে উগ্রচণ্ডার কৃষ্ণনবম্যাদিকল্পে, ভদ্রকালীর প্রতিপদাদি কল্পে ও কাত্যায়নী দুর্গার ষষ্ঠ্যাদি কল্পে পূজার অনুষ্ঠান বিধেয়।

এইদিন মা দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে মূলত ১৬টি উপচার (ষোড়শোপচার) প্রয়োজন হয়, যা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে থাকে। যা হলো আসন, বসন, ভূষণ, স্নান, পাদ্য, অর্ঘ্য, গন্ধ, পুষ্প, চন্দন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, পিত্তল বা মাটির পত্রে জল, পান-সুপারি, এবং ফল। এছাড়াও, পূজার সামগ্রীর মধ্যে ফুল, শাঁখা, সিঁদুর, আলতা, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য (ভোগ বা মিষ্টি), ফল, ও চন্দন অন্যতম।

অন্যদিকে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বয়সী মানুষদের বিভিন্ন রকম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। যদিও এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ পেয়ে থাকে প্রজন্মভেদে।

পুরাতন প্রজন্মের কাছে বয়োজ্যেষ্ঠদের স্মৃতিতে দুর্গোৎসব মানেই ছিল ভক্তি, আচার-অনুষ্ঠান ও পারিবারিক বন্ধনের এক মহোৎসব। তারা ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে মন্দিরে যেতেন, ভক্তিগীতি ও চণ্ডীপাঠ শুনতেন, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলিত হতেন, গ্রামের পূজামণ্ডপে বা শহরের অল্প কয়েকটি বড় আয়োজনেই তাদের আনন্দের কেন্দ্র ছিল। পূজা মানেই তখন ছিল আচার, ধর্মীয় গান, নাটক, যাত্রাপালা, সনাতনী সাজসজ্জা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলেমিশে আনন্দ ভাগাভাগি করা।গ্রাম থেকে শহরে কিংবা বিদেশ থেকে দেশে ফেরা—সব মিলিয়ে পূজা মানেই ছিল মিলনমেলা ও আত্মীয়তার পুনর্মিলন।

তবে, আজকের তরুণ প্রজন্ম পূজাকে দেখছে অনেকটা উৎসবের বহুমাত্রিক রূপে। তাদের কাছে পূজা মানে শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক অনুষ্ঠান, আড্ডা, সাজসজ্জা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিনোদনের ক্ষেত্র। তারা মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা ও থিমভিত্তিক প্যান্ডেল ঘুরে দেখায় আগ্রহী। ডিজিটাল যুগের প্রভাবে এখন পূজার আনন্দ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে—সেলফি, ছবি শেয়ার, লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে পূজার আবেগ ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে।

যদিও আগের প্রজন্মের ভক্তি ও বর্তমান প্রজন্মের বিনোদনের ধারা ভিন্ন, তবে মূল সুর একই—সবার মিলন, আনন্দ ও সম্প্রীতি। পূজা যেমন ধর্মীয় ভক্তির প্রতীক, তেমনি এটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবেরও প্রতীক। তাই প্রজন্মভেদে আগ্রহের পার্থক্য থাকলেও দুর্গোৎসব প্রতিনিয়ত বাঙালির মিলনমেলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।

কিন্তু আনন্দের এই উৎসবের মাঝেই অনেকের জন্য থেকে যায় এক গভীর বেদনা। শিক্ষার জন্য, কর্মজীবনের কারণে কিংবা জীবিকার প্রয়োজনে অসংখ্য মানুষকে দেশ-বিদেশে থাকতে হয় পূজার সময়। নিজের শহর বা গ্রামের পূজামণ্ডপ থেকে দূরে থেকে, অপর দেশে অবস্থান করে তারা বঞ্চিত হন পূজার উচ্ছ্বাস থেকে। প্রতিমা দর্শন, আরতির ধ্বনি, ঢাকের বাদ্য কিংবা বন্ধু-পরিজনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি—সবকিছু থেকে দূরে থেকে যায়। ফলে পূজার সময় তাদের হৃদয়ে আনন্দের চেয়ে বেদনার সুরই বাজে প্রবলভাবে।

এই প্রবাসী বেদনা পূজার সামাজিক তাৎপর্যকে নতুনভাবে তুলে ধরে। দুর্গোৎসব কেবল মণ্ডপে উপস্থিত মানুষের জন্য নয়, বরং যারা দূরে থেকেও মনে-মনে এ উৎসবকে বাঁচিয়ে রাখেন, তাদের সাথেও এক অদৃশ্য যোগসূত্র সৃষ্টি করে। আধুনিক প্রযুক্তি আজ অনেকটা সেই দূরত্ব ঘোচাতে সাহায্য করছে—ভার্চুয়াল সংযোগের মাধ্যমে তারা অংশ নিতে পারছেন মণ্ডপের পূজা-উৎসবে, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করতে পারছেন সেই আনন্দ। তবুও, পূজার প্রকৃত আবহ কেবল কাছের মানুষ, নিজের শহর ও সংস্কৃতির ভেতরেই অনুভব করা যায়।

বেশ কয়েকবছর ধরে দুর্গাপূজা আসলে প্রতিমা এবং মন্ডপ তৈরিতে ভিন্নরকম শৈল্পিকতা সাহায্যে নানারকম বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।ধারাবাহিকভাবে বলতে গেলে প্রথমেই আসা যাক দেবী দুর্গার প্রতিমা প্রসঙ্গ। খুব স্বাভাবিকভাবেই আগের তুলনায় দেবীর প্রতিমায় ভিন্নতা আসছে।আগে দেবীর প্রতিমা প্রায় একই ধাঁচে তৈরি হতো— লাল শাড়ি, সোনালি অলঙ্কার, হাতে অস্ত্র, সিংহে চড়া, আর মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধরত ভঙ্গি।

এখন সেই ধাঁচের বাইরে গিয়ে প্রতিমার সাজে নতুনত্ব আনা হচ্ছে। কখনো আধুনিক ঢঙে, কখনো স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতির ছোঁয়ায় প্রতিমা সাজানো হচ্ছে।নতুন প্রজন্মের প্রতিমাশিল্পীরা তাদের কল্পনা দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি, মুখশ্রী, রঙের ব্যবহার এবং সাজসজ্জা করছেন। ফলে প্রতিমা আরও শৈল্পিক ও আধুনিক মনে হয়।

তাছাড়াও এর পাশাপাশি বেশ কয়েকবছর ধরে পূজা আসলে পূজার আমেজের সাথে পূজামণ্ডপের থিম কেমন হবে তা নিয়ে সবার মধ্যে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু সৃষ্টি হয়। তাই প্রতিমা শিল্পী থেকে শুরু করে মন্ডপ তৈরির কারিগরদের মধ্যে আলাদা শৈল্পিকতার ভাবগাম্ভীর্য কাজ করে।

এক সময় পূজার আলোর অর্থ ছিল কেবল প্রদীপ জ্বালানো বা বৈদ্যুতিক বাল্বের সাজসজ্জা। এখন আর মণ্ডপ কেবল প্রদীপ জ্বালানো বা বৈদ্যুতিক বাল্বের সাজসজ্জা কিংবা একটি প্রতিমা রাখার স্থান নয়, বরং এটি একেকটি শিল্পকর্ম। কোথাও মণ্ডপ গড়ে উঠছে প্রাচীন মন্দিরের আদলে, কোথাও আবার বাংলার লোকসংস্কৃতিকে তুলে ধরা হচ্ছে। কোনো কোনো মণ্ডপে থাকে মহাভারত- রামায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ, বেহুলা-লক্মীণদর থেকে শুরু বিভিন্ন দেবদেবীর ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি, কোথাও দেখা যায় আধুনিকতার ছোঁয়া, আবার কোথাও দেখা যায় সমাজের সমসাময়িক বিষয়ের পটভূমি।
ফলে প্রতিমা শিল্পী থেকে শুরু করে মণ্ডপ তৈরির কারিগরদের মধ্যে বিশেষ শৈল্পিকতার প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। এতে পূজা যেন এক বিশাল শিল্প-উৎসবে রূপ নেয়। এতে সাধারণ মানুষ পূজা উপভোগ করার পাশাপাশি শিল্পীর নান্দনিক শিল্পকর্মের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ পায়। এতে ভক্তদের মনে সৃষ্টি হচ্ছে এক ধরনের ভক্তিভাব, শ্রদ্ধা ও আনন্দের সমন্বয়।

তবে এতো নান্দনিক শিল্পের সৌন্দর্যের মাঝে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠে অপ্রয়োজনীয় সাউন্ড সিস্টেম। অতিরিক্ত জোরে বাজানো ডিজে গান অনেক সময় দর্শনার্থীদের বিরক্তি সৃষ্টি করে। ধর্মীয় গান, কীর্তন বা চণ্ডীপাঠের পরিবর্তে অশ্লীল ও কর্কশ সুরের আধিক্য পূজার ভাবগম্ভীরতাকে ব্যাহত করে, যা অপসংস্কৃতির শামিল।

সঙ্গীত নিজে কোনো সমস্যার বিষয় নয়— বরং নাচ-গান পূজার আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। ধর্মীয় গান, কীর্তন বা চণ্ডীপাঠের পাশাপাশি মানানসই বাংলা বা হিন্দি গান পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে, পূজায় আগত দর্শনার্থীদের আনন্দ দেয়। কিন্তু যখন এই গানগুলো অশ্লীল শব্দ, কর্কশ সুর কিংবা অনুপযুক্ত কথায় ভরপুর হয়, তখন পূজার মূল ভাবগাম্ভীর্য ও ভক্তিভাব নষ্ট হয়।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালির চিরকালীন ঐতিহ্য। কিন্তু প্রত্যেক বছর সময় ঘনিয়ে আসলে কিছু একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ কৌশলে ধর্মীয় আচার ও উৎসবের মধ্যে বিরোধ স্থাপন করে উৎসব ও শান্তির পরিবেশকে বিঘ্নিত করার চেষ্টায় সদা নিয়োজিত থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অশুভ চক্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে প্রতিমা ভাঙচুরের মাধ্যমে অনৈতিক প্ররোচনা সৃষ্টি করছে। এ কর্মকাণ্ড শুধু ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করে না; বরং সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংহতিতেও ক্ষতি করে।তাদের ভুললে চলবে না যে ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।

তাই বাঙালির প্রাণের শারদীয় দুর্গোৎসবের ঐতিহ্য, সম্প্রীতি, আবেগ ও শৃঙ্খলার নিদর্শন বজিয়ে রাখতে হলে দুর্গোৎসবের আয়োজকদের সচেতন হতে হবে। গান বাজুক, নাচ হোক—কিন্তু তা যেন মানানসই হয়। পূজার মাহাত্ম্য রক্ষা করে আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করা আমাদের সবার দায়িত্ব। পূজা কেবল বিনোদনের উৎসব নয়, এটি ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা ও শৃঙ্খলার প্রতীক। তাই সঙ্গীতের মাধ্যমে যদি সেই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়, তবে তা এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি।

আমরা আবার ফিরে যেতে পারি আগের মতো সুস্থ পূজার্চনার সংস্কৃতিতে। ধুনুচি আরতি, শঙ্খধ্বনি, গীতাপাঠ, চণ্ডীপাঠ, ধর্মীয় কুইজ প্রতিযোগিতা ও ধর্মীয় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। কয়েক বছর আগেও কিন্তু এমন সুস্থ সংস্কৃতি সনাতনীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে চলমান ছিল, এখনো সারা দেশের অনেক জায়গায় চলে। পাশে থাকা অন্য পূজামণ্ডপের সঙ্গে কোনো প্রকার প্রতিযোগিতা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পূজার প্যান্ডেল, আলোকসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেমের বাজেট কমিয়ে দুস্থদের মধ্যে পূজাসামগ্রী (নারকেল, মুড়ি, চিড়া, গুড়, চিনি ইত্যাদি), বস্ত্রদান, মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনার মতো অনেক জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

দুর্গা পূজার মন্ডপকে বিভিন্ন শিল্পকর্মের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাকে কেন্দ্র করে এই শৈল্পিকতা যেন অকারণে প্রতিযোগিতার রূপ না নেয়—এ বিষয়টি মনে রাখা জরুরি। মণ্ডপ সাজানোর আড়ম্বর অনেক সময় পূজার আসল মাহাত্ম্যকে আড়াল করে দেয়। প্রতিযোগিতার মানসিকতা থেকে ব্যয়বহুল সজ্জা কিংবা অতিরিক্ত প্রদর্শনী আয়োজন পূজার ভক্তিভাব ও ভাবগাম্ভীর্যকে ক্ষুণ্ণ করে। পূজার আসল মাহাত্ম্য ভক্তি, সম্প্রীতি ও মিলনের বন্ধনে— এটিই হওয়া উচিত মূল আকাঙ্ক্ষা।

অতএব, দুর্গোৎসবের থিম ও শৈল্পিকতা আমাদের সংস্কৃতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য হোক ভক্তিকে গভীর করা, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সমাজে সম্প্রীতির আলো ছড়ানো।

সব থেকে বড় সচেতনতার দায়িত্ব পালন করতে হবে শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে কোনো অনাকাঙ্খিত বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয়। বিশেষ করে মূর্তি ভাঙা, মন্ডপ ভাঙা, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, পূজা পণ্ড করে দেয়ার প্রতিরোধে পূজা কমিটিকে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। যেমন:

১. প্রতিমা যেখানে তৈরী করা হয় সে জায়গায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, বিশেষ করে খোলা জায়গায় প্রতিমা না বানিয়ে একটা বড় কোন ঘরে বা আলং তৈরী করে চারিদিক বন্ধ করে প্রতিমা তৈরী করা।

২. প্রতিটি পূজা কমিটির সাথে ৫০ বা ততোধিক পরিবার সংশ্লিষ্ট থাকেন, পূজার সবকটা দিন পালাক্রমে সবাই মিলে পাহারার ব্যবস্থা করা।

৩. প্রতিটি পূজা শেষ হতে রাত প্রায় ১২টা, ১টা বেজে যায়, এ সময় পর্যন্ত মানুষের আনাগোনা থাকে এর পরের ৪/৫ ঘন্টা জোরদার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।

৪. যারা গভীর রাতে মূর্তি ভাঙতে আসে তারা কিন্তু দল বেধে আসে না, এক বা একাধিক ব্যক্তি আসে। তারা চোরা গুপ্তা হামলা বা ভাংচুর করে পালিয়ে যায়। এরা মূলত কারো টাকার বিনিময়ে এ কাজ করতে আসে। যা বিভিন্ন সময়ে সিসি টিভির ফুটেজ থেকে দেখা গেছে। এরা যখন দেখবে দলবদ্ধভাবে পূজা মন্ডপ বা প্যান্ডেল পাহারা দেয়া হচ্ছে তখন তারা এ কাজে আসবে না।

৫. এখন সিকিউরিটির জন্য বিভিন্ন কোম্পানী রয়েছে যারা অর্থের বিনিময়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। আর্থিক অবস্থা ভাল থাকলে এদের ভাড়া করা যেতে পারে।

৬. পূজা কমিটির সদস্যদের হোয়াটস আপ গ্রুপ, মেসেঞ্জার গ্রুপ তৈরী করা যাতে তথ্যের আদান প্রদান, জরুরি খবর, দুর্ঘটনাসহ যে কোন বিষয় তাৎক্ষণিকভাবে সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যায়।

৭. পূজা মন্ডপের পুরো এলাকা সিসি টিভির ব্যবস্থা করা এবং পূজা কমিটির প্রতিটি সদস্যকে অধিক দায়িত্বশীল এবং প্রতিটি বিষয় নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।সেইসাথে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, পাড়া, প্রতিবেশীদের সাথে পূজার ব্যাপারে যোগাযোগ ও মত বিনিময় করা। যাতে পূজা মন্ডপে কোন অপরিচিত ব্যক্তি/ব্যক্তিদের সন্দেহজনক চলাফেরা দেখামাত্র ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

৮. যে কোন বিষয় নিয়ে কারো সাথে ভূল বুঝাবুঝি হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা শেষ করতে হবে।

৯. পূজা মন্ডপে কোন সৌজন্য বক্তব্য, ভাষণ পরিতাজ্য তবে পূজা, ধর্ম বিষয়ক আলোচনা হতে পারে। অন্যদিকে পূজা মন্ডপে কোন রাজনৈতিক আলাপ, কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।

১০. পূজায় তামষিকতার পরিবর্তে আধ্যাত্মিকতা ও সাত্যিকতার উপর জোর দেয়া। আরতি প্রতিযোগিতার নামে অশ্লীল নাচ, অঙ্গভঙ্গি পরিতাজ্য এবং মাইকে উচ্চস্বরে হিন্দী গান, ডিজে বন্ধ করে পূজার গান, ভক্তিমূলক গান, কীর্তন প্রচার করতে হবে।

১১. শিশু কিশোরদের মধ্যে আরতি প্রতিযোগিতা, ধর্মালোচনা, গীতাপাঠের প্রতিযোগিতা করা। ব্যয়বহুল আলোকসজ্জা ও মন্ডপে বা প্যান্ডেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ না করে দরিদ্র নারায়ণের প্রসাদ খাওয়ার ব্যবস্থা করা।

১২.বিভিন্ন পূজা মন্ডপে দেখা যায় রাত বাড়ার সাথে সাথে এক শ্রেণীর উশৃঙ্খল তরুণ নেশা করে মাতলামি করে পূজার পরিবেশ নষ্ট করে এরা যেই হোক এদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। পূজা মন্ডপে এবং এর আশপাশ এলাকায় ধূমপান ও মদ্যপান নিষিদ্ধ করতে হবে। যারা এসব মাদক জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করবে তাদেরে মন্ডপ এলাকায় প্রবেশ নিষেধ করতে হবে।

আমাদের দেশে দূর্গাপূজাকে বলা হয় শারদ উৎসব। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, উৎসবের সম্মিলনে আমরা অর্জন করি ‘আমরা’ হওয়ার বোধ-উপলব্ধি। তাই সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে দুর্গোৎসব হয়ে ওঠে সর্বজনীন শারদ উৎসব। এই সর্বজনীনতা সব সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ ভুলে আমাদের একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তি দান করে। উৎসব তাই সবার জন্যই সতত সুখের ও আনন্দের।কারণ সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রবণতা। যে যার মতো ধর্মচর্চা করবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, ধর্মসাধনার মূলমন্ত্র হচ্ছে মনুষ্যত্বের সাধনা। জীবনের পবিত্রতা ও অপর মানুষের সুখ–সমৃদ্ধি কামনার মধ্যেই ধর্মসাধনার সারবস্তু নিহিত।

একইভাবে দুর্গাপূজার মতো ঈদ, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা প্রভৃতি ধর্মীয় আচারও হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে এসব উৎসব ঘোষণা করে মানুষে মানুষে মিলনের আহ্বান, পরস্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠার এক অমোঘ বার্তা।

অন্যদিকে উৎসবের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রয়েছে শান্তির। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহমর্মিতা থেকে যে সামাজিক শান্তির পরিবেশ তৈরি হয়, তা উৎসবের আনন্দকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আর ধর্মীয় উৎসব উদ্যাপনের মাধ্যমে জাগ্রত করতে পারি মানবধর্ম ও মানবিক মূল্যবোধ। তাই অশুভ শক্তির বিনাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে মুক্তচিন্তার মানুষদের। কারণ, মুক্তবুদ্ধি দৃষ্টিভঙ্গি উদার করে, ঐক্যে বিশ্বাস করতে শেখায়। দুর্গোৎসবের শুভ্র ও আনন্দজাগানিয়া পরশ শুধু বাঙালি হিন্দু ধর্মানুসারীদেরই নয়, এর চিরায়ত ঐকতান স্পর্শ করে প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়কে। নিজের ধর্মকে যেমন ভালোবাসতে হবে, তেমনি অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি থাকতে হবে অতল শ্রদ্ধা। আর এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর মৌলিক দর্শন এক ও অভিন্ন। অহিংসা, মৈত্রী ও সাম্যই যেকোনো ধর্মের মূল উপজীব্য। মানুষের কল্যাণসাধনই সব ধর্মের মূল শিক্ষা।কারণ, মুক্তবুদ্ধি দৃষ্টিভঙ্গি উদার করে, ঐক্যে বিশ্বাস করতে শেখায়।

তাছাড়াও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ধর্মজ্ঞান, শিক্ষা, সনাতনী রীতি ও সঠিক ইতিহাস পৌঁছাতে হবে। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। অন্যথায় তারা অনাচারকেই আচার হিসেবে আত্মস্থ করবে। খেয়াল রাখতে হবে, পূজা দেখা ও মনোরঞ্জনেই যাতে মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে না যায়। আমরা অপসংস্কৃতির ছোবল থেকে মুক্ত করে পূজাকে করতে চাই শুদ্ধ ও সাত্ত্বিক। তরুণ ও যুবসমাজকে বিপথে যেতে দেখলে মনটা আশঙ্কার মেঘে ঢাকা পড়ে। আমরা সেই অপসংস্কৃতির মেঘের ভয়কে জয় করতে চাই। ধর্মকে সমুন্নত রেখেই আমরা এগিয়ে চলব সমৃদ্ধির রথে, সম্প্রীতির পথে।

এভাবেই এবারের পূজা হয়ে ওঠুক আরো সুন্দর, আরো বর্ণিল, মানুষের মধ্যে জাগ্রত হোক মঙ্গলবোধ, কল্যাণ, ঐক্য, মনুষত্ববোধ, ইতিবাচক চেতনা। দুর্গোৎসবে আমরা শুদ্ধতার সন্ধ্যান পাই, চলুন আমরা সবাই শুদ্ধতায়, শুভ্রতায় স্নাত হই।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

আবেগ বাঙ্গালীর ঐতিহ্য মত-দ্বিমত শারদীয় দুর্গোৎসব শৃঙ্খলা সম্প্রীতি সুমন বৈদ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর