৩০ অক্টোবর এক ফেসবুক পোস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট: ২০৩৪ সালের মধ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ট্রিলিয়ন-ডলারের অর্থনীতি গড়ে তোলা, যা লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে- যেখানে প্রতিটি নাগরিক, বিশেষ করে নারী, গর্বের সঙ্গে দেশের প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।’
অর্থাৎ আগামী ৮ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্বিগুণ করার কথা বুঝিয়েছেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাময়িক হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট অর্থনীতির আকার তথা জিডিপি ছিল ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। ট্রিলিয়ন (১০০০ বিলিয়ন) ডলারে পৌঁছাতে গেলে আরো প্রয়োজন ৫৩৮ বিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে পর্যায়ে (এর মধ্যে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরে জিডিপি ১০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়) এসেছে তা আগামী ৮ বছরে দ্বিগুণ করার সাহসী স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি। এই স্বপ্নপূরণে আগামী দিনগুলোতে আমাদের কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। বিদেশি ঋণের বোঝা কমানো, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো তথা কর-আহরণ বৃদ্ধি এবং বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা।
বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হলে অর্থনীতির হৃদপিন্ড হিসেবে খ্যাত ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সরব করতে হবে পুঁজিবাজারকে। যেখান থেকে নতুন বিনিয়োগে পুঁজির যোগান আসবে। এসব ক্ষেত্রেই আগামীতে আসা রাজনৈতিক সরকার যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং সেখান থেকে উত্তরণে করণীয় কী হতে পারে সেসব বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে এই আলোচনায়।
ঋণের চাপ
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১১ লাখ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সরকারের ঋণ প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকা। গেল অর্থবছরে (২০২৪-২৫) শুধুমাত্র ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ হবে দেড় লাখ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এর হিসেবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল ৪১ শতাংশ, যা ২০৩০ সালে বেড়ে হবে ৪৪.২ শতাংশ। যদিও ২০২৪ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রণালয় ঋণ-জিডিপি অনুপাত বলেছে ৩৭.৬২ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকার যেসব ঋণ করে গিয়েছে তা পরিশোধে আগামীতে আসা নির্বাচিত সরকারের ঘাড়েই চাপ পড়বে। অন্যদিকে নতুন সরকারও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনতুষ্টির প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইবে। তাই এদিকে ঋণ পরিশোধের চাপ অন্যদিকে নির্বাচনী ওয়াদা রক্ষা, এই দুইয়ের মাঝে টানাটানির চ্যালেঞ্জ থাকবে নতুন সরকারের জন্য। এক্ষেত্রে সরকারকে জনতুষ্টির চেয়ে অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে এমন কিছু সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে যা দিয়ে ডলার আয় বাড়বে। অর্থাৎ রপ্তানিমুখী শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এমন প্রকল্প বেশি বেশি বাস্তবায়ন করতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন স্থাপন করা। এতে ওই অঞ্চলে দ্রুত শিল্পায়ন হবে। উৎপাদিত পণ্য মোংলা ও পায়রা বন্দর ব্যবহার করে দ্রুত রপ্তানি করা যাবে। কিংবা পদ্মা সেতু ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরেও দ্রুত পাঠানো যাবে। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে তা বাসাবাড়িতে ব্যবহার না করে বরং উৎপাদনমুখী খাতে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা। সেক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী শিল্পকে প্রাধান্য দেয়া। যেহেতু রূপপুরের সঞ্চালন লাইন ভিন্ন হবে তাই এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
নতুন সরকারকে ডলার আয়ের দিকে বেশি নজর দিতে হবে এজন্য যে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছে ২.৬১ বিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি)। অর্থমন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদী সামস্টিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২৭-২৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ঠেকবে ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলারে। সুতরাং আগের সরকারের রেখে যাওয়া ঋণ নতুন রাজনৈতিক সরকারকে কতটা চাপে ফেলবে তা বলাই বাহুল্য।
কর আহরণ বাড়ানো
অর্থনীতির আকার বাড়াতে হলে অবশ্যই নতুন সরকারকে কর আহরণ তথা ট্যাক্স আদায় বাড়াতে হবে। যাকে অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আহরণ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ থাকলেও গত অর্থবছরে এ হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এই হার সবচেয়ে কম। কর-জিডিপি অনুপাত এত কম হওয়ার পিছনে কারণ কী? নাগরিক হিসেবে যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই জীবনের চলার পথে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোন না কোন ভাবে আমরা কর দিই। তাহলে এত টাকা যায় কোথায়? হয় সরকারি কোষাগারে জমা হয় না কিংবা করযোগ্য নাগরিকরা কর দিচ্ছেন না। অর্থাৎ যারা কর আদায় করছেন এবং যারা কর দিচ্ছেন বা দিবেন দুদিক থেকেই দুর্নীতি হচ্ছে। এখানে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এটা করা যে কতটা চ্যালেঞ্জ তাই সবগুলো সরকারই কমবেশি জানেন।
অন্তবর্তী সরকার যদি সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে যায় তাহলে নতুন সরকারকেও সেই বাড়তি অর্থের যোগান দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কর আহরণ বাড়ানোর বিকল্প নেই। কারণ, সরকার যে কর আহরণ করে তার প্রায় পুরোটাই চলে যায় পরিচালন ব্যয়ে। তাই নতুন সরকারকে অবশ্যই কর আদায় বাড়াতে অনিয়ম, দুর্নীতিকে ব্যাপকহারে কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন পড়বে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সেই সদিচ্ছা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ ব্যক্তিদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
বিনিয়োগ বাড়ানো
কর ব্যবস্থায় দুর্নীতি কমাতে পারলে ব্যবসা শুরুর খরচ কমবে। এতে করে দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠবেন নতুন ও বিদ্যমান উদ্যোক্তারা। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সরকার আসলে একটি দীর্ঘ মেয়াদী (৫ বছর) নীতি কৌশল পাওয়া যাবে। এতে বর্তমানে চলমান বিনিয়োগ ভাটায় জোয়ার আসবে নি:সন্দেহে।
দেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চাঞ্চল্য আসলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও দলে দলে আসবেন। তবে আগের সরকারের রেখে যাওয়া জ্বালানি সংকট নিরসনে বড়সর উদ্যোগ নিতে হবে। তাই নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিয়েই সাগরে ও ভূমিতে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদারে কাজে হাত দিতে হবে।
এছাড়া ব্যবসায়ীরা বরাবরই তাদের ব্যবসা শুরুর খরচ বাড়ার কারণ হিসেবে প্রশাসনের মধ্যে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষকে তুলে এনেছেন। শুধুমাত্র নতুন নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমেই লাখ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব। তাই বিনিয়োগকে সহজ করতে উপরোক্তা দুর্নীতি নির্মুলে হাত দিতে হবে। না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। সেখান থেকে হবে জনরোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা।
ডলার সংকট
যেহেতু বর্তমানে বিনিয়োগ কম তাই ডলার খরচ অতটা হচ্ছে না। যে রিজার্ভ এখন জমা হচ্ছে তখন সেটি কাজে লাগবে। তবে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ও নতুন বিনিয়োগের জন্য আমদানি বাড়ায় প্রচুর ডলার খরচ হবে। তাই রিজার্ভ কমে তখন আবারও ডলার সংকটের আশঙ্কা থাকবে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে, বিদেশি বিনিয়োগ তথা দেশে ডলার আসার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিডা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা অব্যাহত রাখার প্রয়োজন। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চলে থাকা সমস্যাগুলো নিরসনে নতুন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভাতেই ব্যবস্থা নিতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে বন্দরের কনটেইনার জট কমানোর, তথা বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো।
ব্যাংক ও পুঁজিবাজার
বিনিয়োগের জন্য অর্থের যোগান দিবে ব্যাংকগুলো। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে এই ব্যাংকখাতে। বেশির ভাগ ব্যাংক এখন মূলধন হারা। এগুলোকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা বার বার ওঠে আসছে। নতুন সরকারকে সেই সদিচ্ছা পূর্ণমাত্রায় দেখাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন তার স্বাধীনতা বজায় রেখে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। দলের বড় বড় নেতাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিংবা আর্থিকখাতের অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের মত নয়-ছয় সুদের হার বেঁধে দেয়ার মত অনর্থনীতি নেয়া যাবে না। ব্যাংকে জমা করা স্বল্প মেয়াদি আমানতের টাকা দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ঋণ হিসেবে দেয়া হয়। এই কাঠামোগত সমস্যা নিরসনে পুঁজির উৎস হিসেবে শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। এই বাজারে অতীতে যেসব জালিয়াতি হয়েছে তা আর হবে না চুড়ান্ত ভাবে সেই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিতে হবে। অনিয়মের দায়ে কেউ শাস্তির মুখোমুখি হলে তার রাজনেতিক পরিচয়কে বিবেচনায় নেয়া যাবে না। নতুন কোম্পানি শেয়াবাজারে তালিকাভুক্ত করতে করছাড়সহ পদক্ষেপ নিতে হবে।
এলডিসি উত্তরণ
এছাড়াও নতুন সরকারের সামনে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে এলডিসি উত্তরণ। এই উত্তরণের ফলে সরকার চাইলেও অনেক শিল্পকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। এতে শিশুর মত আগলে রাখা অনেক শিল্পখাত হয়তো ক্ষতির মুখে পড়বে যা প্রভাব ফেলবে কর্মসংস্থানে। তবে সুরক্ষা উঠে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এক্ষেত্রে সরকারকে হয়তো এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ব্যবসায়ী, শ্রমিকসহ সবপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সময় বাড়ানোর আবেদন করা যেতে হবে।
পরিশেষে
এসব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলেই বাংলাদেশ আগামী এক দশকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারবে। যেমনটি হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। ওই সময় স্বৈরাচার হটিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করার পর অর্থনীতিতে বেশি কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতেও সেই সংস্কার অব্যাহত থাকে। ফলাফল হিসেবে জিডিপির অনুপাতে রপ্তানি, রেমিট্যান্স থেকে শুরু করে প্রায় সবগুলো অর্থনৈতিক সূচক ২০০৭ সালের দিকে অনেক উপরে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে তাতে আবারও পতন শুরু হয়।
কারণ মহাজোট সরকার, চারদলীয় জোট সরকারের সময় রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়। এসব ঋণ প্রকল্পের নামে ব্যবহারে করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। যার বড় উদাহরণ, পারমাণবিক বালিশ। দেশের অর্থনীতি এই ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি আর সইতে পারবে না। তাই নতুন সরকারকে কৌশলী হয়ে পদক্ষেপ নেয়ার দিকেই এগুতে হবে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, স্টার নিউজ ও সাবেক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ইআরএফ