রম্যরঙ্গ: পেঁয়াজের মত ভালোবাসা
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ২০:৩১
ক’দিন ধরে বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনছে না স্বামী। স্ত্রী ব্যাপারটা খেয়াল করে জানতে চাইল-পেয়াজ কিনছ না কেন? দাম অনেক বেড়েছে বলে? স্বামী ঝটপট উত্তর দিল- দাম কোনো ব্যাপারই না! তোমাকে খুব ভালোবাসি ডার্লিং। পেঁয়াজ কাটতে বসে তোমার চোখ থেকে পানি পড়–ক, তুমি কাঁদ, সেটা আমি কিছুতেই চাই না সোনা!
এটা যদি বাংলাদেশের পেঁয়াজের গল্প হয় তবে ভারতেরটা কেমন?
বোম্বে কাম তামিল নায়ক রজনীকান্ত যতোই জনপ্রিয় হোক তার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে ব্যঙ্গ করে এমন মানুষও ভারতে কম নেই। এরা একটা কৌতুক বাজারে ছড়িয়েছে। কৌতুকটা এমন- পেঁয়াজ কাটার সময় রজনীকান্তের মুভি ছেড়ে রাখা হয় কেন? উত্তর- পেঁয়াজের ঝাঁজ যতোই থাকুক রজনীকান্তের অভিনয় দেখে পেঁয়াজ নিজেই কাঁদে! তখন পেঁয়াজ কাটতে আর কোন অসুবিধাই হয় না! আশা করি এই কৌতুকটা কেউ নায়ক (!) অনন্ত জলিলের নামে এই দেশে ছড়িয়ে দেবেন না!
রিক্সাওয়ালার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে নাকি ইউনিভার্সিটি শব্দটাই বেশি পরিচিত। কারণ বোধ করি এই যে ছাত্র-ছাত্রীদের রিক্সায় নিতে নিতে রিক্সাওয়ালাদের ভেতরেও শিক্ষার বাতাস লাগে, ইউনিভার্সিটিটাই তার কাছে ‘সাউন্ডস গুড’ মনে হয়। (এখন ‘সাউন্ডস গুড’এর যুগ। আগে সিনেমা হলে লেখা থাকতো প্রক্ষালন কক্ষ। তারপর লেখা হতো টয়লেট। এখন লেখা থাকে ওয়াশরুম। আগে বলা হতো বান্ধবী বা প্রেমিকা। এখন বলা হচ্ছে জিএফ বা গার্লফ্রেন্ড)।
সত্তর ও আশির দশকে যারা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের দেশে কাজের সন্ধানে যেত পেঁয়াজ তাদের কাছে ‘সাউন্ডস গুড’ ছিল না। তারা তাদের পেশা বলতো ওসি এন্ড ডিসি। মানে হচ্ছে ওনিয়ন কাটার এন্ড ডিস ক্লিনার! যাই হোক পেঁয়াজ মনে হয় আমাদের কাছে ইদানিং ‘ওনিয়ন’ হয়ে দাড়িয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পেঁয়াজই একমাত্র ‘জিনিস’ হঠাৎ হঠাৎ করে যার দাম বেড়ে যায়! আমাদের দেশে একবার বেড়েছিল লবনের দাম। গল্পের রাজাকে রাজকন্যা বলতে পেরেছিল বাবা তোমাকে লবনের মতো ভালোবাসি। বাবা তাকে তাড়িয়ে দিলেও রাজকন্যা এক সময় বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে লবনের মতো ভালোবাসা আসলে কেমন, রাজাও রাজকন্যাকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। লবনের ভালোবাসার মতো পেঁয়াজের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণও আমরা দিয়েছি। এক দেড়শ টাকা দিয়ে এক কেজি পেয়াজ কিনেছি… কিনছি!
ঢাকার খিলগাঁওয়ের এরিস্টন ফুডের কর্নধার রবি খান ফেসবুকে মজার এক অফার দিয়েছিলেন। তার অফার ছিল-এক কেজি পেঁয়াজ দিন, বার্গার নিন! সাংবাদিকরা তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন- এরিস্টন বার্গারের দাম একশ টাকার বেশি। আমরা দশ ভাগ কমিশনে এটা বিক্রি করছি। কেউ এক কেজি পেঁয়াজ দিলে তাকে আমরা বার্গার দেব ভাবছি আর সেই পেঁয়াজ নব্বই টাকায় বিক্রি করব! পেঁয়াজের প্রতি ভালোবাসা না জন্মালে এমন অফার কী কেউ দিতে পারে?
পেয়াজকে বাঙ্গালি বহুদিন আগে থেকেই ভালোবাসে। আর তাই পেঁয়াজের কী কী গুণ সেটা বাঙালির মুখে মুখে ফেরে। পেঁয়াজ শুধু তরকারি কিংবা সালাদের সাথেই ব্যবহৃত হয় না, মুড়ি-মুড়কির মতোই নাকি বাঙ্গালি পেঁয়াজ খায়। গরুর মাংসের সাথেও খায় আবার পুরি-সিঙ্গারার সাথেও খায়। ছোলা মুড়ি চানাচুরের সাথেও খায় আবার নাকি শরীরের জন্যও খায়। বিশ্বাস না হলে পত্রিকায় আসা বিজ্ঞাপনগুলো পড়–ন কিংবা নিজেই প্রয়োগ করে দেখুন।
দেশ-বিদেশের লাইফস্টাইল পেজগুলোতে ইনিয়ে বিনিয়ে আজকাল অনেকটা সরাসরি এখন খবর আমরাতো দেখিই- পেঁয়াজ খেলে নাকি যৌবন সতেজ থাকে। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন একগ্লাস পেঁয়াজের জুস খেতে হবে।
পেঁয়াজের আরো গুন আছে। সাধারণ মাপের একটি বড় পেঁয়াজে ৮৬.৮ শতাংশ পানি, ১.২ শতাংশ প্রোটিন, ১১.৬ শতাংশ শর্করা জাতীয় পদার্থ, ০.১৮ শতাংশ ক্যালসিয়াম, ০.০৪ শতাংশ ফসফরাস ও ০.৭ শতাংশ লোহা থাকে। এছাড়া পেঁয়াজে ভিটামিন এ, বি ও সি রয়েছে।
পেঁয়াজ ডায়াবেটিস কমায়, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে আনে। পেঁয়াজে প্রচুর পরিমান কোয়ারসেটিন থাকে। এই কোয়ারসেটিন রক্তের খারাপ কোলস্টোরেলের পরিমান কমায় এবং ভালো কোলস্টোরেলের পরিমান বাড়ায়, রক্ত চলাচল ও জমাট বাধতে সহায়তা করে। পেঁয়াজ শরীরকে বিষমুক্ত করে এবং পেঁয়াজের রসের কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে না। হৃদপিন্ডের জন্যও পেঁয়াজ ভালো উপকারি। কাঁচা পেঁয়াজের এমনই শক্তি যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা অনেক সময় ওষুধ সেবনকালে কাঁচা পেঁয়াজ খেতে মানা করেন। কাঁচা পেয়াজ নাকি ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে! চুল এর গোড়া পেঁয়াজ যেভাবে শক্ত করে তুলতে পারে অন্য কোন কিছু তা পারে না।
লম্বা চুল দিয়ে গাড়ি টেনে এক লোক বিশ্ব রেকর্ড করেছিল। এমন শক্ত চুল কীভাবে বানালেন এই প্রশ্নের জবাবে লোকটি বলেছিল- ‘পেঁয়াজ’!
এতোগুনের পেঁয়াজ হয়তো নিজের মতোই খামখেয়ালি। হুটহাট করে তার দাম বেড়ে যায়। পেঁয়াজের দাম বাড়াতে এইদেশের একমন্ত্রী বলেছিলেন- পেঁয়াজ না খেলে কী হয়? বাঙালি সম্ভবত পেঁয়াজবিহীন বাচবে না। বাঙালির এই পেঁয়াজ আসক্তির কারণেই বাংলাদেশ ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ে। পেঁয়াজের দাম নিয়ে নাকি ষড়যন্ত্র হয়। পেঁয়াজের ফলন ভালো না হলেও আমদানির ব্যবস্থা আছে। আমদানি যে পরিমানে করা হয় তাতে পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তারপরও পেঁয়াজের দাম বাড়ে। আড়তে পেঁয়াজের দাম কমলেও খুচরা বাজারে কমে না। আবার বেশিরভাগ পেঁয়াজ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। চীন কিংবা মিসর থেকে আমদানি করা হলে ভারত আবার পেঁয়াজের দাম কমিয়ে দেয়। চীন বা মিসর থেকে যারা আমদানি করে তখন তারা পথে বসে। পেঁয়াজ নিয়ে এই যে ষড়যন্ত্র তার নাম সিন্ডিকেট। রাজা যায় রাজা আসে সিন্ডিকেটের তাতে কিছু যায় আসে না। তারা নির্দিষ্ট বিরতিতে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েই চলে। একটা মুরগি কিংবা বার্গারের সমান হয়ে দাঁড়ায় পেঁয়াজের দাম। আগে পেঁয়াজ কিনে রাখা হতো রান্না ঘরে, এখন শোভা পায় খাবার টেবিলে। আঙুর, আপেল, কমলা আর পেঁয়াজের এখন একই ক্লাশ। আগে বেড়াতে যাবার সময়ে মিষ্টি কেনার রেওয়াজ ছিল। এখন কেনা হয় পেঁয়াজ। কী আর করা? এখন আর চুলায় গ্যাস না থাকলেও চলে। পেঁয়াজ নিজে জ্বলে এবং অন্যকে তুমুল জ্বালায়।
পেঁয়াজের এই জাতে ওঠার কারণে গল্পর ধরণও বদলে গেছে। আগে গল্পের নাম হতো লবনের মতো ভালোবাসা। এখন নাম হয় পেঁয়াজের মতো ভালোবাসা। এক রাজা। তার চার স্ত্রী। রানীদের মনে সুখ নেই। রাজাকে নিয়ে তারা সুখী নন। রাজা রাজ্যশাসনে এবং যুদ্ধ বিগ্রহে যতোটা সাহসী ও শক্তিশালী বউদের কাছে তিনি ততোটাই দুর্বল। একদিন চার বউকে ডাকলেন রাজা। জানতে চাইলেন কে তাকে কতোটা ভালোবাসে? প্রথম বউ বললো রাজাকে সে আকাশ ও সমুদ্রের মতো ভালোবাসে। দ্বিতীয় বউ বললো সে রাজাকে নদী ও বনের মত ভালোবাসে। তৃতীয় বউ বললো রাজাকে সে হীরা জহরতের মত ভালোবাসে। ছোট বউ শুধু বললো রাজাকে সে রাজ্য ও পেঁয়াজের মতো ভালোবাসে! রাজা ক্ষেপে গেলেন। রাজা ছোট বউকে গহীন এক দূর বনে নির্বাসনে পাঠালেন।
গল্পটা এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু শেষ করা যাচ্ছে না। পাঁচ বছর পর যুদ্ধ বিগ্রহ ও রাজ্য নিয়ে রাজা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তার মনে সুখ নেই। কোন স্ত্রীই তার কোন উত্তারাধিকারের দিতে পারেন নি। তার পরে কে হবে রাজা এটা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এরপরে এক যুদ্ধে শত্রুদের তাড়া করতে যেয়ে তিনি এক গহীন বনে পথ হারিয়ে ফেললেন। খাওয়া নেই পানি নেই। শত্রু আর বাঘ সিংহ সাপের ভয়। তিনি রাতে এক পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। তাকে যিনি আশ্রয় দিলেন তিনি রূপবানের মতো রাজাকে গান শোনালেন। রাজার মনে হলো এই কন্ঠ তার অনেক দিনের চেনা। এরপর আশ্রয়দাত্রী রাজাকে পেয়াজের শরবত খাওয়াতে লাগলেন। গান শুনে আর পেয়াজের শরবত খেয়ে রাজার ক্লান্তি দূর হলো। যিনি আশ্রয় দিয়েছেন, শরবত খাইয়েছেন আর গান শুনিয়েছেন রাজা তাকেই কামনা করে বসলেন!
রাজার আদেশ শিরোধার্য। আধো আলো অন্ধকারে রাজার কাছে যিনি এলেন তাকে দেখে রাজা চমকে গেলেন। ছোট বউ।
এরপর রাজা ছোট বউকে নিয়ে রাজ্যে ফিরলেন। কয়েকদিন পর সারা রাজ্যের প্রজারা আনন্দে মেতে উঠলো। জানা গেল ছোট রানীমাতা সন্তান সম্ভবা!
যতোই দাম বাড়–ক কিংবা কমুক, আসুন আমরা পেঁয়াজের মতো ভালোবাসা কী সেটা বুঝতে শিখি!
আহসান কবির : লেখক ও অভিনেতা।
দ্রষ্টব্য: এই কলামের সকল মতামতের দায়িত্ব লেখকের নিজের।