Saturday 01 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অ্যান্টিব্যায়োটিকের কুফল থেকে মুক্তি: ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মারবে ভাইরাস

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
১ নভেম্বর ২০২৫ ১৫:৫২

১৮৯৭ সালে জার্মান রসায়নবিদ ফেলিক্স হফম্যান বেয়ার কোম্পানিতে কাজ করার সময় উইলো গাছের ছাল থেকে অ্যাসপিরিন প্রস্তুত করেন এবং এটিই পৃথিবীতে প্রথম আবিস্কৃত ওষুধ। এই ওষুধ চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। এসপিরিন প্রথম নিরাপদ ব্যথানাশক ও জ্বর নাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে চিকিৎসকরা ব্যথা ও জ্বর নিয়ন্ত্রণে নতুন পথ পান। পরবর্তীতে গবেষণায় জানা যায়, এটি রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে, ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অ্যাসপিরিনের কার্যপদ্ধতি বুঝে বিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের ওষুধ যেমন প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন তৈরি করতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে আধুনিক ফার্মাকোলজির বিকাশ ঘটে এবং সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসা আরও সহজলভ্য হয়।

বিজ্ঞাপন

ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা যে ভুল করি তাহলো উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ না নেয়া। অনেক সময় নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা করি,কখনো আত্মীয়,কখনো বন্ধুর পরামর্শ নেই। অমুক ওষুধে তমুক ভালো হয়েছে, তাই আমিও ভালো হবো-এমন গুজবেও আমরা গুরুত্ব প্রদান করে থাকি। অধিক সংখ্যক মানুষ যে ভুলটি করে থাকে সেটি হলো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকেই ওষুধ বিক্রেতার পরামর্শ অনুযায়ী শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ ওষুধ গ্রহণ করে থাকে। আর ওষুধ বিক্রেতারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে না বুঝে,না জেনে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করে থাকে।

অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক মহান বৈজ্ঞানিক অর্জন, যা অসংখ্য প্রাণ বাঁচিয়েছে এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছে।এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, ভাইরাস, এমনকি ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও ওষুধ তৈরি করতে আগ্রহী হন। অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতক মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। অস্ত্রোপচারের পর ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণই ছিল প্রধান সমস্যা। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে অপারেশন পরবর্তী সংক্রমণ অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হয়,ফলে বড় বড় সার্জারি করাও নিরাপদ হয়ে ওঠে।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বলতে বোঝায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা, সঠিক ডোজে না খাওয়া বা রোগের কোর্স শেষ হওয়ার আগেই ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া। এই অপব্যবহারের প্রধান এবং সবচেয়ে মারাত্মক পরিণতি হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি হওয়া।অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের ফলে জীবাণুগুলো (যেমন ব্যাকটেরিয়া) নিজেদের এমনভাবে পরিবর্তন করে যে তাদের ওপর অ্যান্টিবায়োটিকের আর কোনো কার্যকারিতা থাকে না। জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে বাড়ছে প্রাণনাশের ঝুঁকি। অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে পড়ছে। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে এক সময় অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণ সর্দি-জ্বরেও কাজ করবে না। তখন সামান্য অসুখ-বিসুখেই প্রাণ হারাতে হবে।

এন্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার সম্ভাব্যভাবে আয়ুষ্কাল হ্রাস করতে পারে, মূলত অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের সাথে এর সম্পর্ক থাকার কারণে। গবেষণাগুলি দীর্ঘমেয়াদী বা অত্যধিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের এবং অকাল মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে একটি যোগসূত্র খুজে পেয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে হাত ধোয়া ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমেই এর বিস্তার কমানো সম্ভব বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে আইসিডিডিআরবির গবেষণার মাধ্যমে। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, ‘কিছু অ্যান্টিবায়োটিক আছে যেগুলোকে একেবারে শেষ ধাপ হিসেবে রিজার্ভ করে রাখা হয়েছে। সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একান্ত বিপদে না পড়লে এই রিজার্ভ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো একেবারেই ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখছি অহরহ এসব রিজার্ভ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। যেগুলো সাধারণত সর্বোচ্চ মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হওয়া উচিত, সেগুলো এখন হাসপাতালে সাধারণ ওয়ার্ডেই ব্যবহার করতে হচ্ছে। গবাদি পশুর ফার্মে অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বিপদ আরও বাড়াচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক ড. লুৎফুল কবীর বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। অসাধু চিকিৎসকরা অনেক সময় একাধিক ওষুধ কোম্পানিকে খুশি করতে একই রকমের বিভিন্ন কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। ওষুধের দোকারদাররাও নিজেদের ইচ্ছা মতো প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছেন। রোগীরাও অসচেতনতার কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ সম্পন্ন করছেন না।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি) এর ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ ছিল ‘সুপারবাগ,যা মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফল । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১ কোটিতে পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশ এই ঝুঁকির বাইরে নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলার জন্য ওষুধগুলিকে তাদের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে যথা: (১)Access : সাধারণ সংক্রমণ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার করা হয়। যেমন: অ্যামোক্সিসিলিন।(২)Watch: উচ্চ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ। কেবল নির্দিষ্ট ও গুরুতর সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। যেমন: সিপ্রোফ্লক্সাসিন, সেফট্রিয়াক্সন। (৩)Reserve: যখন অন্যান্য সব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যর্থ হয়, তখন এটি ব্যবহার করা হয়।যেমন: কলোস্টিন, লাইনজোলিড। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কোনো দেশে যেখানে প্রথম পর্যায়ে বা অ্যাক্সেস গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার কথা ৬০ শতাংশ কিন্তু আমাদের দেশে দ্বিতীয় পর্যায় বা ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি ৬৩ শতাংশ। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও শিশুদের অনেক রোগই ভাইরাস বাহিত যা অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই ভালো হয়ে যায়।

আবার অ্যান্টিবায়োটিকের ক্রিয়ার ধরণ অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিককে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে-(১) ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীর নষ্ট করে যেমন-Penicillin, Cephalosporin, Vancomycin ইত্যাদি (২) প্রোটিন সংশ্লেষণ বন্ধ করে যেমন-Tetracycline, Aminoglycoside, Macrolide ইত্যাদি (৩) DNA সংশ্লেষণ বন্ধ করে যেমন- Quinolone (৪) RNA সংশ্লেষণ বন্ধ করে যেমন- Rifampicin ( ৫) ফোলিক এসিড সংশ্লেষণ বন্ধ করে যেমন- Sulfonamide,Trimethoprim ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গণ অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখেন।

কিন্তু একজন ওষুধ বিক্রেতা বা হাতুড়ে চিকিৎসকের পক্ষে এত কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে কাজ করা সম্ভব হয় না ফলে এ অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের ফলে জীবাণু রোগ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না এবং ব্যয় বহুল চিকিৎসা শেষে রোগীর ভাগ্যে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু ঘটে।

ওষুধের ফার্মাকোকাইনেটিক বলতে বোঝায় যে, মানবদেহ একটি ওষুধের উপর কী প্রভাব ফেলে। এটি মূলত ফার্মাকোলজির সেই শাখা যেখানে একটি ওষুধ দেহে প্রবেশ করার পর থেকে শুরু করে নিষ্কাশন হওয়া পর্যন্ত তার গতিপথ ও পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়। কোন রোগীকে একটি ওষুধ প্রদানের ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের ওষুধের চারটি গুন শোষণ, বিতরণ, বিপাক ও নিস্কাশন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। শোষণ বলতে ওষুধটি প্রয়োগের স্থান (যেমন মুখ, ত্বক বা শিরা) থেকে রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে কত দ্রুত এবং কী পরিমাণে শোষিত হয়। বিতরণ বলতে রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে ওষুধটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, কলা এবং তরল পদার্থে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে বা বিতরণ হয়। বিপাক বলতে শরীর রাসায়নিকভাবে ওষুধটিকে ভেঙে ফেলে (সাধারণত যকৃতে) যাতে এটি শরীর থেকে সহজে নিষ্কাশিত হতে পারে। নিস্কাশন বলতে শরীর থেকে ওষুধটি এবং তার বিপাকজাত পদার্থগুলি অপসারণ করার প্রক্রিয়া (সাধারণত মূত্র বা মলের মাধ্যমে)। এই চারটি ধাপের অধ্যয়ন চিকিৎসকদের ওষুধের সঠিক মাত্রা, প্রয়োগের পথ এবং সময়সূচী নির্ধারণ করতে সাহায্য করে, যাতে ওষুধটি রোগীর দেহে সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর ফলাফল দেয়। এখন প্রশ্ন হলো একজন সাধারণ ওষুধ বিক্রেতার এ রকম ধারণা আছে কি? তা পাঠক বিবেচনা করবেন।

একটি রোগের নির্দিষ্ট ঔষধ এবং অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে এবং এটি কখনও কখনও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কখনও কখনও অ্যান্টিবায়োটিকের সাথে দুটি বা তার বেশি ঔষধ এক সাথে খাওয়া হয় তখন একটির প্রভাবে অন্য টির কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা বাধাগ্রস্থ হতে পারে এবং এ অবস্থাকে ড্রাগ ইন্টার অ্যাকশন বলে।একটির কারণে অন্য ঔষধের শোষণ কমে যায়। লিভারের এনজাইম সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, ফলে অন্য ঔষধ দ্রুত নষ্ট হয় । আবার একসাথে গ্রহণ করার কারণে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। যেমন:- যদি কেউ ডায়াবেটিসের ওষুধ Metformin এবং অ্যান্টিবায়োটিক Ciprofloxacin একসাথে খায়, তবে রক্তে সুগারের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে বা কমে যেতে পারে যা একটি গুরুতর প্রতিক্রিয়া। রক্ত পাতলা করার ঔষধ Aspirin এর সাথে অ্যান্টিবায়োটিক Azithromycin এক সাথে খেলে রক্তপাতের ঝুকি বাড়ে। অ্যান্টিবায়োটিক Erythromycin এর সাথে হৃদরোগের ওষুধ Digoxin statins এক সাথে খাওয়া হয় তাহলে বিষক্রিয়ায় অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হবে।

মানবদেহে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। যার কিছু ভালো আর কিছু খারাপ। অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা। এটা ভালো না খারাপ সেটা অ্যান্টিবায়োটিক বুঝতে পারে না।তাই কোনও রোগী অ্যান্টিবায়োটিক খেতে শুরু করলে তার শরীরের খারাপ ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি ভালো ব্যাকটেরিয়াও নষ্ট হয়ে যায়।এতে শরীর তার প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারায়। ফলে সবচেয়ে সাধারণ যে দু’টি সমস্যা দেখা দেয় তা হল ডায়রিয়া ও ছত্রাক সংক্রমণ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো খাবার হজম করা থেকে শুরু করে ক্ষতিকর ভাইরাস, পরজীবী থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক অন্ত্রের ভাল ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলে এবং ভাল ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। ফলে রোগীর মারাত্মক ডায়রিয়া, বদহজম, বমি বমি ভাব, জ্বর, পেটে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, মাথা ঘোরানো, ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। নারীদের যৌনাঙ্গে যে ভালো ব্যাকটেরিয়া থাকে, তা ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে কাজ করে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে ওই ব্যাকটেরিয়া যখন মরে যায়, তখন সহজেই যৌন পথে ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দেয়।

মাইটোকন্ড্রিয়াকে কোষের পাওয়ার হাউজ বলা হয়। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষতির মাধ্যমে কোষের শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিনষ্ট করে।কিছু এন্টিবায়োটিক কোষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিষয়ক স্মৃতি শক্তি দূর্বল করে দেয় ফলে একই রোগজীবাণু দ্বারা পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে মানুষের অন্ত্রে বাসকারী উপকারি ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে দেয় ফলে মানুষের হজম শক্তি হ্রাস পায়।দীর্ঘমেয়াদী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে অটোইমিউন ডিসঅর্ডার বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাধাগ্রস্থ হয়।মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায় বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।

অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারকে সাধারণত প্রতি ১০০০ জন বাসিন্দার জন্য দৈনিক সংজ্ঞায়িত ডোজ (DDD) হিসেবে পরিমাপ করা হয়। উক্ত পরিমাপ হিসেবে বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে ইরান ৬২, দক্ষিণ আফ্রিকা ৫১, মিশর ৫০ এবং বাংলাদেশ ৪৯। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা গেছে যে ইউরোপের কিছু দেশ, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো (যেমন সুইডেন, নরওয়ে) মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার সবচেয়ে কম।সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী,বাংলাদেশও মাথাপিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (Antimicrobial Resistance – AMR) হলো এমন একটি অবস্থা যখন অণুজীব (যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা পরজীবী) তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ওষুধের (অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল) কার্যকারিতা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করে। অর্থাৎ আগে যে ওষুধ দিয়ে সংক্রমণ নিরাময় করা যেত, জীবাণু এখন সেই ওষুধের উপস্থিতিতেও বেঁচে থাকতে ও বংশবৃদ্ধি করতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ফলে চিকিৎসা জগতে একধরণের অস্থিরতা তৈরী হলেও বিজ্ঞানীরা বসে নেই। এক ধরণের ডিএনএ ভাইরাস আবিস্কৃত হয়েছে যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে পারে। এরকম ভাইরাসকে ফাজ ভাইরাস বলে। ফাজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে একটি ফ্যাক্টরি হিসেবে ব্যবহার করে নিজের কপি তৈরি করে এবং শেষে সেই ফ্যাক্টরিকেই ধ্বংস করে দেয়।ফাজ ভাইরাসের এই ধ্বংস করার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ফাজ থেরাপি নামে এক ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিস্কার করা হয়েছে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক –রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ফাজ ভাইরাস ব্যবহার করা হয়।

ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য ফাজ থেরাপি (Phage Therapy) বেশ কিছু দেশে প্রচলিত আছে, বিশেষত যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সংক্রমণের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে যেসব দেশে ফাজ থেরাপি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এবং যেখানে এর গবেষণা ও ঐতিহ্য সুদীর্ঘ, সেগুলি হলো:জর্জিয়া: এই দেশটি ফাজ থেরাপির অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। এখানে তিবিলিসি-তে জর্জ এলিয়াভা ইনস্টিটিউট অব ব্যাক্টেরিওফাজ, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ভাইরোলজি (George Eliava Institute) অবস্থিত, যা বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাজ থেরাপি কেন্দ্র।জর্জিয়ার মতো রাশিয়াতেও ফাজ থেরাপির দীর্ঘ ইতিহাস আছে এবং এটি সেখানে প্রচলিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। পোল্যান্ডে রোক্লাউ (Wrocław)-তে একটি ফাজ থেরাপি ইউনিট রয়েছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র কেন্দ্র, যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ফাজ থেরাপির প্রয়োগ হয় । অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য কম্প্যাসনেট ইউজ (Compassionate Use) নীতির অধীনে পশ্চিমা দেশগুলোতে যেমন: ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মাঝে মাঝে ফাজ থেরাপি ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়, যখন অন্য কোনো অনুমোদিত ওষুধ কার্যকর হয় না।এই দেশগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে ফাজ থেরাপির সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও পরিচালনা করছে।

এভাবে গবেষণার মাধ্যমে মানুষ উপকারি ব্যাকটেরিয়াকে রক্ষা করে ভাইরাস দিয়ে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে পারবে।ব্যাকটেরিয়া কখনও এক বা একাধিক ওষুধের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারবে না। ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ভাইরাসের বিজয় মানব সভ্যতা টিকে থাকার অন্যতম হাতিয়ার।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর