Tuesday 11 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমরা তাহলে এখন কী করবো

আনোয়ার হাকিম
১১ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:৫৮

আমরা তাহলে এখন কী করবো – এমন কথা এখন দেশের অধিকাংশ লোকের। এর কোন উত্তর নেই। দেশে এখন চলছে পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিষোদগারের মহোৎসব। একে অপরকে টেক্কা দিয়ে নিজের অবস্থান নিরংকুশ করার উন্মত্ততা। গত পনের বছরের দেখানো পথে শটকাট উপায়ে যেন তেন উপায়ে মিলিওনিয়ার হওয়ার বেপোরোয়া নেশা। যার কিছুই নেই সেও আজ রাতারাতি কারো কলিজা উপড়ে ফেলে বিপুল পরিমাণ স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হওয়ার নেশায় সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ছাত্ররাও তক্কে তক্কে আছে, বুড়োদের আর বড়দের কাছ থেকে দেখে- শুনে আর গন্ধ শুঁকে শুঁকে জায়গা মত দান মারতেও পিছপা হয় না। কারো মধ্যে তৃপ্তির ‘ত’ নেই। সবার মাঝে হিংস্রতা আর অপথে- কুপথে বড়লোক মানে ক্যাশওয়ালা হওয়ার খায়েশ। তাই, কেউ কাউকে স্বার্থ ছাড়া সালাম আদাব তো দূরের কথা, ভদ্রতাটুকুও করতে চায় না। সবাই যেন সর্বক্ষণ তেতে আছে। তাই সর্বক্ষণ মাথায় গরম, মুখে অশ্রাব্য ভাষা আর চলনে উৎশৃংখল ভাব।

বিজ্ঞাপন

দেশে অভাবিত বিপ্লব হয়ে গেলো। জেন-জিদের উত্থানে দেশের জনগণ আশান্বিত হয়েছিলো এই ভেবে যে, এইবার, এইবার হয়ত ভাগ্য ফিরলো। সেই বিপ্লব বেহায়েত হতে সময় নেয়নি কতিপয় বুড়োর কারণে। এতিম ছাত্ররা ইতিউতি ছুটাছুটি করে শেষ পর্যন্ত দিশেহারা হয়ে বেপথেও পা বাড়িয়েছে, কেউ কেউ কলহে, স্ক্যাণ্ডালেও জড়িয়ে পড়েছে। কেউ ফিল্মী স্টাইলে রাহাজানি করতে গিয়ে নাটকীয় কায়দায় ধরা খেয়েছে। পাশাপাশি একই সময়কালে আরেক গ্রুপ বিনা মেহনতে ট্যাম্পু স্ট্যাণ্ড, বাস স্ট্যাণ্ড, মিডিয়া, চ্যানেল, পত্রিকা অফিসের দখল নিয়ে ফেলেছে। কেউ কেউ আবার সাধু বেশে পাকা চোর অতিশয় হয়ে পুরোনো মালিকের স্থাপনায় নতুন নিশান উড়িয়ে আপোষে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও পালন করছে।

আলেকজাণ্ডার তার সেনাপতিকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘সেলুকাস কী বিচিত্র এ দেশ’। মূলত জোয়ার ভাটার নিত্য খেলা প্রত্যক্ষ করেই তিনি এ জনপদের অধিবাসীদের সম্মন্ধে বিরূপ ধারণা করে নিয়েছিলেন। তিনি কি এদেশের ষড়ঋতু সম্মন্ধেও অবহিত ছিলেন? জানি না। তবে জোয়ার ভাটার মত এদেশে যেমন গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবাদহ অতি বাস্তবতা, তেমনি বর্ষার প্রচুর বারিপাতও দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা। আরো রয়েছে জীবনযাত্রার আরেক চরম মাত্রা- শীতের কনকনে ঠাণ্ডা। এরপরেও থেকে যায় বসন্তের ফুরফুরে হাওয়ার দুলুনি। বাকী ঋতুর কথা বাদই থাক। এতসব বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা তাই বিচিত্র। তার উপর জাতিতে আমরা সংকর মিশ্রিত। এ যেন বিচিত্রতার ষোলকলায় পরিপূর্ণ এক জনপদ।

বৈষম্য আর স্বাধিকারবোধ থেকে ৭১ আমাদেরকে এনে দিয়েছিলো কষ্টার্জিত স্বাধীনতা। আমরাই পারি- এ বোধ আমাদেরকে উজ্জীবিত করেছিলো। সে উজ্জীবন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। চুয়ান্ন বছরে এর প্রজ্জ্বলন আর হয় নি। সেই থেকে পরিকল্পনাহীন ও বেপোরোয়া দৌড়ঝাঁপেরও অবসান হয় নি। ডান আর বামের অস্থির শিল্পকর্মে জনগণ বরাবরই আশান্বিত হয়েছে আর খেয়া পারাপার শেষে নিরাশায় পতিত হয়েছে। সেগুলো অতীতের কথা। অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে আমাদের জুড়ি নেই। তাই অতীতাশ্রয়ী হিসেবে আমরা সম্মুখভাগে আগুয়ান হতে পারছি না। এও এক বিচিত্র মোহান্ধতা, প্রচণ্ড মাদকতা।

চব্বিশের জুলাই বিপ্লব যে অপার সম্ভাবনার দ্বারোদঘাটন করেছিলো তা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে অংকুরেই। বিভক্ত জাতি একতায় বিশ্বাসী না। দশে মিলে করি কাজে তাদের আস্থা নেই। তাই বিপ্লবের স্পিরিট আজ মৃত, বিস্মৃত। বাংগালি আবার বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি। অল্পতেই ভুলে যায় সব কিছু। পরস্পর বিরোধী এত স্বত্বা নিয়ে এদের ঘুম হয় না ভালো মত। তাই অনিদ্রাজনিত মস্তিষ্কের উচ্চচাপ সারাক্ষণ লেগেই থাকে।

শিক্ষকরা তাদের জায়গায় নেই। ছাত্ররা তা বেশ ভালো করেই জানে। তাই তারাও তাদেরকে শ্রদ্ধা করা তো দূরের কথা প্রভাবক, উদ্দীপক হিসেবেও গণ্য করে না। শিক্ষকরা শিক্ষাদান ফেলে ব্যবসা আর ট্রেড ইউনিয়নের মত এসোসিয়েশন করে, ফলদায়ক রাজনীতির এক্টিভিস্টের দায়িত্ব পালন করে। ছাত্ররা পড়াশোনা ফেলে দীপুমনির অটো পাসের ধান্ধায় থাকে। রাজনীতির ধারাপাত কোনকালেই শুদ্ধ ছিলো না। তবু যা ছিলো তারও বারোটা বেজে অর্থহীন ও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো গেলো রেজিমের কঠিন অপশাসনে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেইয়ের স্বকৃত প্রণোদনা বলে রাজনীতির অঙ্গণ এতটাই কলুষিত যে এখানে সভ্যতা-ভব্যতার কোন চর্চা নেই। চান্দা ছাড়া দলে থাকার কোন রেওয়াজ নেই। দখল, বাণিজ্য আর ধান্ধা ছাড়া এর কোন এজেণ্ডাই যেন নেই। ইদানীং এটা আরো স্পষ্ট হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এখন আর কেউ কিছু করে কোন কিছু আড়াল করার সুযোগ পাচ্ছে না। অবৈধ বাণিজ্যের গেঁড়াকলে আজ সবাই নিমজ্জিত। কেউ স্বস্তিতে নেই। ধান্ধার নিত্য নতুন সফিস্টিকেটেড এভিনিউ আবিষ্কৃত হচ্ছে। জনগণ সব জানে। জেনে বুঝেও এদের পিছু পিছু ঘুরে কিছুমিছু পাওয়ার আশায়। যাই পাওয়া যায়, তাতেই লাভ। নগদ যা পাও হাত পেতে নাও- বাকির খাতায় শূন্য থাক- এই মন্ত্রে উজ্জীবিত আজ গোটা জাতি। কারো মধ্যে চরিত্র বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যে যত বেশি পদধারী, ক্ষমতাবান, প্রভাব বিস্তারকারী আর সাহসী, যার চোখের পাতা যত কঠিন এ দেশে তার সম্ভাবনা তত বেশি উজ্জ্বল।

উন্নয়নের নামে গত পনের বছরে যত লুটপাট হয়েছে, আর্থিক খাতে ঋণ প্রবাহ সৃষ্টির নামে ব্যাংক লুটপাট সংস্কৃতির যে মচ্ছব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং লুটের অর্থ পাচারের যে দিগন্তের সূচনা হয়েছে তাতে আমাদের কোনই অর্জন নেই বললে ভুল বলা হবে। অর্জন অবশ্যই আছে। আমরা শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির কোন শাখাতেই বিশ্বমান কেন আঞ্চলিক মানেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে না পারলেও লুটপাটের ক্ষেত্রে, পাচারের পটুতায় আমরা এরিমধ্যে আন্তর্জাতিক ষ্ট্যাণ্ডার্ড অর্জন করে ফেলেছি।

নির্বাচনকে আমরা করেছি হাস্যকর ও ইউনিক মডেল। এদেশে নির্বাচন কোন কালেই শতভাগ স্বচ্ছ ছিলো না। কিন্তু গত পনের বছরের ভোটারবিহীন নির্বাচন, দিনের ভোট আগের রাতেই শেষ করে ফেলা ও আমি- ডামির নির্বাচন আমাদেরকে বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চতায় ও বক্রতায় পৌছে দিয়েছে। প্রশাসন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, কারণ গেলো রেজিমের মত, তাবেদারি করার মত, কোন উপযুক্ত প্রভু এই মুহুর্তে নেই। তাই কোন কিছুতেই তাদের আর উৎসাহ নেই। আগের মত নিভর্রতা নেই, ভাগাভাগি নেই, একচ্ছত্র অধিপতি ভাব নেই, তাই এই নির্জীবতা। পুলিশের কাঠামো ভংগুর। তাদের ঘুরে দাঁড়াবার সদিচ্ছা আছে কিনা সন্দেহ হয়। তাই আগেরটাই ভালো ছিলো গীতের অনুরণন ও আকুল প্রতীক্ষাই এখন তাদের অন্তর্বতীকালীন একমাত্র প্রেরণা। সিণ্ডিকেট ঝিম মেরে আছে। হাত বদলের যাদুতে যারা এখন ক্রিজে ব্যাট করছে তাদের বিস্ময়কর নেপথ্য বোঝাপড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এক উপদেষ্টা কিছুদিন আগেই বলেছেন, সরকারের ভেতর আরেক সরকার সক্রিয় রয়েছে। এ সময়ের দু’টি বড় দল প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করে তাদের দৃষ্টিতে পক্ষপাতদুষ্ট উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে নালিশ করে এসেছে, এক দলের তরফ থেকে নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এতসব দেখে শুনে জনগণও এখন বেপোরোয়া। তারা সামান্যতেই ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে, চাই কি হাতাহাতি থেকে রক্তারক্তি অবধিও চলে যাচ্ছে। এক দল ভিউ কামানোর ধান্ধায় এগুলো মোবাইল বন্দী করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যরা তাতে উৎসাহিত হয়ে একই ধারায় নেমে পড়ছে। দাবী আদায়ের নামে নাটক হচ্ছে, হুমকি- ধামকিও হচ্ছে। অবরোধ, যানজট নগরবাসীর এখন নিত্যদিনের বিস্বাদ। মধ্যস্থতা করার কেউ নেই। কেউ কাউকে মানেও না, গণেও না।

সরকারকে সবাই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। সরকার প্রধানকেও। যেন সব দোষ নন্দ ঘোষের। ছেড়ে দে মা চেটেপুটে খাই দশা। সরকারেরও ব্যার্থতা অপরিসীম। সরকারের পক্ষে সাফাই গাইলে কেউ তা ধর্তব্যের মধ্যে নেবেও না। তার পক্ষে যতই অকাট্য যুক্তিই থাকুক না কেন, পাবলিক অতশত বুঝে না। তারা দৃশ্যমান উন্নতি চায়। পরিবর্তন চায়।

মোটা দাগে এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান দশা। এতসব অরাজকতা, উৎশৃংখলতা আর অধ:পাতের বিপরীতে ভালোর চর্চা নিরুৎসাহিত হচ্ছে, প্রয়োজনীয় প্রণোদনা পাচ্ছে না। আমাদের সামনে ভবিষ্যতের কোন রূপরেখা নেই। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস আর মেনিফেস্টোতে পাবলিকের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। কেউ জানেনা নির্বাচন হবে কিনা, হলে কি হবে, হলে পরিবর্তন কি কিছু হবে? নাকি চুয়ান্ন বছরের ছিলছিলারই পুনরুজ্জীবন হবে? সবার মনে এক প্রশ্ন – তাহলে আমরা এখন কী করবো? উত্তর জানা নেই। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি