বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত মূলত ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ কর্তৃক আঁকা ‘র্যাডক্লিফ লাইন’-এর উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত যা বাংলাদেশ (পূর্ববঙ্গ) ও ভারতের মধ্যে সীমানা তৈরি করে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর এটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯৪৮ সালের ৬-১৪ ডিসেম্বর তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত আন্তঃডোমিনিয়ন সম্মেলনে ভারতের সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ বিভাগের সাথে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান এর ভুমি রেকর্ড ও জরিপ বিভাগের সীমানা নির্ধারন কাজের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। ভারতের ৫টি রাজ্য যথা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম এর সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। এই পাচটি রাজ্যকে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ সেক্টর, বাংলাদেশ-আসাম সেক্টর, বাংলাদেশ – মেঘালয় সেক্টর ইত্যাদি সেক্টর হিসেবে ভাগ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) সেক্টরের ৬২৮ টি স্ট্রিপ ম্যাপের মধ্যে ৬০৬ টি, বাংলাদেশ-আসাম (ভারত) সেক্টরের ৯৩টি স্ট্রিপ ম্যাপের মধ্যে ৮৯টি, বাংলাদেশ-মেঘালয় (ভারত) সেক্টরের ১৩৯টি স্ট্রিপ ম্যাপের মধ্যে ১৩২টি এবং বাংলাদেশ-ত্রিপুরা (ভারত) সেক্টরের ২৬৯টি স্ট্রিপ ম্যাপের মধ্যে ২৬৭টি ম্যাপসহ মোট ১০৯৪টি বাউন্ডারি স্ট্রিপ ম্যাপ উভয় দেশের প্লেনিপোটেনশিয়ারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উভয় দেশের মধ্যে বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে। অমীমাংসিত এবং অপদখলীয় ভূমির কারণে মোট ৩৫টি বাউন্ডারি স্ট্রিপ ম্যাপ উভয় দেশের পে¬নিপোটেনশিয়ারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয় নি।
বাংলাদেশ -ভারত সীমানা নির্ধারন এর পর সীমান্তের শূন্য লাইনে বিভিন্ন প্রকারের পিলার নির্মাণ করা হয়। যেমনঃ মেইন পিলার, সাব-সিডিয়ারী পিলার, রেফারেন্স পিলার এবং টি শেপড পিলার। সাধারনত ২/৩ কিঃ মিঃ পর পর স্পষ্ট বাঁকে মেইন পিলার, দুইটি মেইন পিলাররে মাঝে সাব-সিডিয়ারী পিলার এবং আরো ছোট ছোট বাঁকে কোথাও কোথাও টি শেপড পিলার নির্মান করা হয়। এ ছাড়া নদী এলাকায় যেখানে নদীর মাঝখান দিয়ে সীমানা চলে গেছে সেখানে উভয় দেশের অভ্যন্তরে রেফারেন্স পিলার নির্মান করা হয়। এ ছাড়া নদী এলাকায় যেখানে নদী শুকিয়ে গেছে সেখানে শূন্য লাইনে পোল টাইপ পিলার নির্মান করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে আন্তর্জাতিক সীমান্তে মোট ৮,৩৯৬ টি সীমানা পিলার রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পিলার নম্বরিং শুরু হয়েছে যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গ ,আসাম,মেঘালয়,ত্রিপুরা এবং শেষ হয়েছে মিজোরাম দিয়ে। সীমান্ত পিলার থেকে ‘পাক’ (PAK) লেখার পরিবর্তে ‘বিডি’ (BD) বা ‘বাংলাদেশ’ লেখা শুরু হয় মূলত ২০১৯ সাল থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর উদ্যোগে, এবং কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া চলে ২০২০ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত, যা ছিল স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছর পর। এই কাজটি বিজিবি নিজস্ব উদ্যোগে করে এবং এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর কোনো পিলারে পাকিস্তান লেখা থাকে না, শুধু বাংলাদেশ লেখা থাকে।
মূল আলোচনায় যাবার আগে বাংলাদেশের সীমান্ত সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেয়া প্রয়োজন। তাহলে বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরা যাবে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশের মোট সীমান্ত দৈর্ঘ্য হলো ৫,১৩৮ কিলোমিটার। বাংলাদেশের মোট আর্ন্তজাতিক সীমানা (স্থলসীমা) ৪,৪২৭ কিলোমিটার এবং সমুদ্র উপকূলের দৈর্ঘ্য ৭১১ কিলোমিটার।স্থল সীমার মধ্যে ভারতের সাথে ৪,১৫৬ কি.মি এবং মায়ানমারের সাথে ২৭১ কিমি সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত এলাকায় মায়ানমার অংশে তিনটি টাউনশিপ (জেলা) মংডু, বুথিডং (রাখাইন রাজ্য) এবং পালেতওয়া (চীন রাজ্য) টাউনশিপ এবং বাংলাদেশ অংশে রয়েছে কক্সবাজার,রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান জেলা।
ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ২২৬২ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে রয়েছে রংপুর বিভাগের ৬টি জেলা- পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এবং খুলনা বিভাগের ৬টি জেলা- সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশোর, কুষ্টিয়া এবং ঝিনাইদহ জেলা এবং ভারতীয় অংশে রয়েছে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা রয়েছে। আসামের সাথে বাংলাদেশের জেলার ২৬৪ কি.মি সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্তে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ রয়েছে এবং ভারতের ধুবরি, দক্ষিণশালমারা মানকার চর, করিমগঞ্জ (শ্রীভূম) এবং কাচার জেলা রযেছে। ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৮৭৪ কিমি। এর মধ্যে বাংলাদেশের ফেনী, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলা এবং ভারতের রয়েছে দক্ষিণ ত্রিপুরা, সিপাহি জালা, পশ্চিম ত্রিপুরা, খোয়াই, উত্তর ত্রিপুরা, উনাকটি এবং ঢালাই জেলা রয়েছে। মিজোরামের সাথে বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার ৩২০ কিমি সীমান্ত রয়েছে এবং ভারতীয় অংশে রয়েছে মিজোরামের ৩টি জেলা লুংলেই, মামিত ও সাইহা জেলা। মেঘালয়ের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪৩৬ কিলোমিটার। এই সীমান্তের এক পাশে রয়েছে বাংলাদেশের নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর এবং অপর পাশে মেঘালয়ের পশ্চিম গাড়ো পাহাড় জেলা, দক্ষিণ গাড়ো পাহাড় জেলা। পশ্চিম খাসি পাহাড় জেলা, দক্ষিণ পশ্চিম খাসি পাহাড় জেলা, পূর্ব খাসি পাহাড় জেলা, পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়া জেলা অবস্থিত। ভারতের ৫টি অঙ্গরাজ্য ও ৩০টি জেলার সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৬টি বিভাগের ৩০টি জেলার এবং মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশের ৩টি জেলার সীমান্ত রয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের মোট সীমান্তবর্তী জেলা সংখ্যা হবার কথা ৩৩টি কিন্তু রাঙ্গামাটি জেলা দুই দেশের সীমান্তে থাকায় বাংলাদেশের মোট সীমান্তবর্তী জেলা হবে ৩২টি।
বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে ২৪টি স্থল বন্দর যা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য সহ যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম।বেনাপোল স্থল বন্দর বাংলাদেশের যশোর জেলার শার্শা উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম পেট্রাপোল, বনগাঁও, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা। বুড়িমারি স্থল বন্দর লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম চেংরাবান্ধা, কোচবিহার জেলা। আখাউড়ায় স্থল বন্দর ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম রামনগর, আগরতলা পশ্চিম, ত্রিপুরা জেলা। ভোমরা স্থল বন্দর সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম গোজাডাঙ্গা, চব্বিশ পরগণা জেলা। নালিতাবাড়ি স্থল বন্দর শেরপুর জেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় হয় ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ভারত অংশের নাম ডালু, মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গাড়ো পাহাড় জেলায় অবস্থিত। তামাবিল স্থল বন্দর সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম ডাউকি ভারতের মোঘালয় রাজ্যের পশ্চিম জৈন্তিয়া পাহাড় জেলায় অবস্থিত। দর্শনা স্থল বন্দর চূয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম গেদে, কৃষ্ণনগর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। বিলোনিয়া স্থল বন্দর ফেনী জেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় হয় ২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম বিলোনিয়া, ত্রিপুরা, ভারত। গোবড়াকুড়া– কড়ইতলী স্থল বন্দর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা হয় হয় ২০১০ সালের ১৪ জুন এবং ভারতীয় অংশের নাম গাছুয়াপাড়া, মেঘালয়। রামগড় স্থল বন্দর খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ে অবস্থিত এবং ঘোষণা করা হয় ২০১০ সালের ৭ই নভেম্বর এবং এটি ভারতীয় অংশের নাম সাবরুম, ত্রিপুরা, ভারত। সোনাহাট স্থল বন্দর কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারিতে অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর এবং এর ভারতীয় অংশের নাম সোনাহাট, ধুবরি, আসাম, ভারত। তেগামুখ স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয় ২০২৩ সালের ৩০ জুন এবং এটি রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলায় অবস্থিত এবং ভারতীয় অংশের নাম দেমাগ্রী, মিজোরাম, ভারত। চিলাহাটি স্থল বন্দর ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই এবং এটি নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায় অবস্থিত এবং ভারতীয় অংশের নাম হলদীবাড়ি, কুচবিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। দৌলতগজ্ঞ স্থল বন্দর ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই এবং এটি চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবন নগর উপজেলায় এবং ভারত অংশের নাম মাঝদিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। ধানুয়া কামালপুর স্থল বন্দর জামালপুর জেলার বকসীগজ্ঞ উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০১৫ সালের ২১ মে এবং ভারত অংশের নাম মহেন্দ্রগজ্ঞ, আমপতি, মেঘালয়, ভারত। শেওলা স্থল বন্দর সিলেট জেলার বিয়ানী বাজার উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০১৫ সালের ৩০ জুন এবং ভারত অংশের নাম সুতারকান্দি, করিমগজ্ঞ, আসাম। বাল্লা স্থল বন্দর হবিগজ্ঞ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ এবং ভারত অংশের নাম পাহাড়মুড়া, খৈয়াই, ত্রিপুরা। সোনামসজিদ স্থল বন্দর চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগজ্ঞ উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং এর ভারত অংশের নাম মহাদীপুর মালদহ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। হিলি স্থল বন্দর দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম হিলি, দক্ষিণ দিনাজপুর, ভারত। বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর পঞ্চগড় উপজেলার তেতুলিয়া উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ভারত অংশের নাম ফুলবাড়ি, জলপাইগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। টেকনাফ স্থল বন্দর কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং অপর অংশের নাম মংডু, সিটুওয়ে, মায়ানমার। বিবির বাজার স্থল বন্দর কুমিল্লা সদর উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০০২ সালের ১৮ নভেম্বর এবং অপর অংশের নাম শ্রীমন্তপুর, সোনামুড়া, ত্রিপুরা, ভারত। বিরল স্থল বন্দর দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি ঘোষণা করা হয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং অপর অংশের নাম রাধিকাপুর, গাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। এছাড়াও আরো দুটি প্রস্তাবিত স্থল বন্দর রয়েছে। যথা- (১) মুজিবনগর স্থল বন্দর মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে প্রস্তাবিত এবং এটির অপর অংশের নাম হৃদয়পুর, চাপড়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। (২) প্রাগপুর স্থল বন্দর, কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলায় প্রস্তাবিত এবং অপর অংশের নাম শিকারপুর, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। সংক্ষেপে বলা যায় ঘোষিত স্থল বন্দরের সংখ্যা ২৩টি, চালু স্থল বন্দরের সংখ্যা ১১টি (নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ৬টি+ বিওটি ভিত্তিতে ৫টি)। ব্যবস্থাপকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাধীন স্থলবন্দরের সংখ্যা: ০৬টি, উন্নয়ন কার্যক্রমাধীন স্থল বন্দরের সংখ্যা ১২টি, ঘোষণার প্রক্রিয়াধীন স্থল বন্দরের সংখ্যা ০২টি।
ভারতের মোট ১৫ হাজার ১০৬ কিলোমিটার স্থলসীমা এবং ৭ হাজার ৫১৬ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা রয়েছে। মোট সাত দেশের সঙ্গে ভারত স্থলসীমা ভাগাভাগি করে। এগুলো হলো বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান। এর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ সীমানা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তের প্রায় ৭৯ শতাংশে বেড়া দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ-ভারত ৪,১৫৬ কি.মি কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩ হাজার ২৩৯ কিলোমিটার বেড়া দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর দুটি দেশ, চীন ও রাশিয়া, সবচেয়ে বেশি দেশের সাথে স্থল সীমান্ত ভাগ করে, যা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। চীনের সাথে ১৪টি দেশের ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া এবং মঙ্গোলিয়া এবং রাশিয়ার সাথে ১৪টি দেশের নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, চীন, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বব্যাপী ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সীমান্তে বিভিন্ন কারণে কমপক্ষে ৬৩,০০০ মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর কর্মকাণ্ড, যার মধ্যে বিতর্কিত ‘দেখামাত্র গুলি’ নীতিও রয়েছে, বিপুল সংখ্যক মৃত্যুর কারণ হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিএসএফ-এর হাতে অন্তত ১,৯২৩ জন বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। বিবিসির দেয়া তথ্য মতে বাংলাদেশ –ভারত সীমান্তে ২০২৩ সালে ৩১ জন এবং ২০২৪ সালে ৩০ জন নিরপরাধ বাংলাদেশীকে বিএসএফ কর্তৃক হত্যা করা হয়। ভারত তার সীমান্তে নজরদারির জন্য ড্রোন, স্যাটেলাইট চিত্র, রাডার সিস্টেম, CCTV, থার্মাল ইমেজিং সেন্সর, নাইট ভিশন ডিভাইস, লেজার সেন্সর, এবং AI-চালিত রোবটসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা ২৪/৭ নজরদারি, অনুপ্রবেশ শনাক্তকরণ এবং অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধে সহায়তা করে, এমনকি দুর্গম ও খারাপ আবহাওয়ার পরিস্থিতিতেও।
বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তে কুড়িগ্রাম জেলা অবস্থিত। সীমান্তের কয়েকটি ঘটনার কারণে কুড়িগ্রাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত ও পরিচিত। কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বাশজানি মসজিদটিতে দু’দেশের লোকেরা নামাজ পড়ে যা সাধারণত: বিরল ঘটনা। প্রতি বছর এ মসজিদটি দেখতে দেশ বিদেশের অনেক পর্যটকের আগমন ঘটে। ২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিল রৌমারি উপজেলার বড়াইবাড়ি গ্রামে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ঘটে যায় ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সংঘর্ষে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ’র ১৬ জন সৈন্য ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং বাংলাদেশের তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (এখন বিজিবি) ২ জন সৈন্য শাহাদত বরণ করেন। এ ঘটনায় বাংলাদেশী জওয়ানদের বীরত্ব ও দেশপ্রেম বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। ২০১১ সালের ০৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয় ফেলানী খাতুন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আধাঘণ্টা ধরে ছটফট করে কাঁটাতারেই ঝুলন্ত অবস্থায় নির্মমভাবে মৃত্যু হয় ফেলানীর। কাঁটাতারেই ঝুলে থাকে দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা ফেলানীর নিথর মরদেহ। সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে থাকা ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি বিশ্বজুড়ে হৈচৈ ফেলে দেয়। ফেলানী হয়ে উঠে প্রতিবাদের প্রতীক। বিশ্ব মিডিয়ায় ফেলানী খাতুনের কাঁটাতারে ঝুলে থাকার ঝুলন্ত মরদেহের ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় ভারত হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়।
প্রত্যেক দেশের এক বা একাধিক প্রতিবেশী দেশ থাকে। কোনো দেশ ইচ্ছা করলেও তার প্রতিবেশীকে বদলাতে পারে না। সুতরাং প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রাখতে পারলে লাভ উভয় দেশের। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় তা নানা কারণে হয়ে ওঠে না। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মূলত ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ এই মূলমন্ত্রের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সবসময় সংঘাত এড়িয়ে চলার নীতি অবলম্বন করে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম