Thursday 25 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সরকারি কর্মচারী আইনের প্রভাব আছে কি নেই

আনোয়ার হাকিম
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:০৬

সরকারি কর্মচারী আইন কার্যকর আছে কি নেই – এ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য আগে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধি ১৯৭৪ নামে এক বিধি কার্যকর ছিলো। ২০১৮ সালে এর সারবত্তা অক্ষুন্ন রেখে প্রবর্তিত সরকারি কর্মচারী আইনে তাকে উদরস্থ করা হয়েছে। মূলত সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধি ছিলো সরকারি কর্মচারীরা কি কি করতে পারবেন না আর কি কি করতে পারবেন, পারলে কি কি শর্তে তার একটা ম্যানুয়াল?

গত কয়েক দশক ধরেই এই বিধি তার কার্যকারিতা হারাচ্ছিলো এর প্রায়োগিক দুর্বলতা বা অনীহার কারণে। কিছু কিছু বিধি এমনই হাস্যকর ছিলো যে তা উপেক্ষা করার সাহস দেখাতে কুণ্ঠা করেন নি কর্মচারীরা। তবু ভয়ডর বলে কিছু একটা ছিলো। উপরস্থের কুনজরে পড়লে বা কোন ঘটনার শিকার হয়ে পড়লে বা আনুগত্য বা অপকর্মের সহচর না হলে পান থেকে চুন খসলেই এর প্রয়োগ অনিবার্য ছিলো। কিন্তু গেলো রেজিমে এর প্রয়োগে একতরফা দৃষ্টি প্রতিভাত হত। যারা লাইনের কমরেড, সকল কর্ম-অপকর্মের গাঁটছড়া বাধা বশংবদ তাদেরকে বাদ দিয়ে বাকিদের জন্যই যেন ছিলো এর বাধ্যবাধকতা। ফলতঃ অসার হয়ে পড়েছিলো এর প্রয়োজনীয়তা। যেমন: বিধিতে বলা ছিলো কোনো সরকারি কর্মচারী তার নিজের বদলী ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে কোনো রাজনৈতিক ব্যাক্তির নিকট, বিশেষ করে কোনো মাননীয় সংসদ সদস্যের নিকট সুপারিশ বা তদবির করতে পারবেন না। অথচ বেসামরিক প্রশাসনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ব্যাপক লংঘন হতে দেখা গেছে। বলা চলে তদবীর ও সুপারিশ ছাড়া কারো বদলী বা পদোন্নতি ছিলো অকল্পনীয় ও চরম অনিশ্চিত। এই বিধিতেই বলা ছিলো কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের বা যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ব্যাতিরেকে জনসমক্ষে বা মিডিয়ার সামনে বা পত্রিকায় নিবন্ধ, বিবৃতি, মতামত আকারে কোনো কিছু প্রকাশ বা প্রচার করতে পারবেন না। অথচ গেলো রেজিমে সরকারের মধ্যম শ্রেণির কর্মচারীরাও যে যার মত মিডিয়ার মাইকের সামনে, টক শো’তে বা পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে ইচ্ছেমত অংশগ্রহণ করেছেন, মতামত রেখেছেন, বিরোধীদলকে ঈঙ্গিত করে কটাক্ষ, রগড় করতেও নির্ভয় ছিলেন। সরকারি কর্মচারী আইনেও অনুরূপ বিধি বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এই আইনকে এখনো উপেক্ষা করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

বিজ্ঞাপন

৫ আগস্টের জুলাই বিপ্লবোত্তর সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে বিভিন্ন প্রকার পেশাজীবি সংগঠনের বেপোরোয়া আচরণ ও সরকারের সীমাহীন উদারতা তথা নিষ্ক্রিয়তা পরিস্থিতিকে বিভৎস করে তুলেছে। আনসার বাহিনীর নিম্ন পদস্থদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা, পল্লী বিদ্যুৎ কর্মচারীদের লাগাতার মরণকামড় দেওয়া তা-ব, সরকারি পেশাজীবীদের সড়ক অবরোধ, অবস্থান কর্মসূচি, যমুনা ও সচিবালয় ঘেরাওয়ের নামে নজিরবিহীন উৎশৃংখলতা এই আইনের অকার্যকারিতাকেই প্রকট করে তুলেছে। সাম্প্রতিক কালের সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের প্রায় অদম্য ও অভূতপূর্ব লাগাতার কর্মসূচি এবং সরকারের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ বিষোদগার সরকারি কর্মচারীদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে মারমুখী ও অনমনীয় করে তুলেছে। তদ্রুপ মাধ্যমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও। ২৬ ক্যাডারের সংঘবদ্ধ কর্মসূচি ও প্রশাসন ক্যাডারের প্রত্যুত্তর সরকারি কর্মচারী আইনকে যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। একটা সময়ে গিয়ে হয় তারা ক্ষান্ত দিয়েছে, নয়ত কিছুমিছু পেয়ে জয় থাকতে ভঙ্গ ভালো নীতিকে অনুসরণ করে যার যার ব্যারাকে ফিরে গেছে নয়ত শোকজ, বিভাগীয় মামলা খেয়ে বা বরখাস্ত, চাকরি থেকে অব্যাহতির মত খড়গ মাথায় নিয়ে চুপ হয়ে গেছে। সব ক্ষেত্রেই সরকার ব্যাকফুটে গিয়ে খেলেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় গিয়ে শক্ত হয়েছে। কিন্তু এত করেও সরকারি কর্মচারীদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় নি। খোদ সচিবালয়ের কর্মচারীরাও একাধিকবার তাদের সার্বক্ষণিক উর্ধতনদের সাথে অসৌজন্যমূলক, মারমুখী আচরণ ও অবরোধ ইত্যাদির মত চরম ধৃষ্টতামূলক কা- করেছে। উপদেষ্টাদেরকে ঘেরাও, অবরোধ, উর্ধতন কর্মকর্তাদেরকে ভুয়া ভুয়া শ্লোগান দিয়ে, অপমান সুলভ আচরণ করে তাদেরকে চরম চাপের মুখে রাখতেও দ্বিধা করেনি। এর কোন কিছুই সুশাসন, শৃংখলা ও সেবামনষ্ক না। কিছু হলেই, কিছু চাওয়ার থাকলেই বলা নেই কওয়া নেই ট্রেড ইউনিয়নের মত সরকারি কর্মচারীরাও রাস্তায় নেমে পড়ছে, মাইকে, মিডিয়ায় ইচ্ছেমত সরকার বা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই আচরণ ও চব্বিশ ঘন্টা , আটচল্লিশ ঘন্টা সময় দিয়ে আল্টিমেটাম দিচ্ছে। তাও আবার সরকারি কার্যদিবসে কাজকর্ম ফেলে রেখে প্রকাশ্য সমাবেশ করে। অথচ সরকারি কর্মচারী আইনে এসব করলে কি করা হবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। কে শোনে কার কথা?

প্রতিটি আন্দোলনই যে নিজেদের ভালোমন্দ বা আর্থিক সুবিধা আদায়ের জন্য করা হয়েছে তা না। বরং অনেক আন্দোলনের পেছনে সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা পতিত সরকারের দোসর ও বেনিফিসিয়ারির কলকাঠি নাড়ানাড়ি ছিলো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সঠিক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে ব্যার্থ হওয়ায় সবাই আসকারা পেয়েছে আর অন্তর্বতীকালীন সরকারকে দুর্বল ভেবে আরো বেশি সাহসী হয়েছে। যা এখনো চলমান আছে। সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন থাকা সত্বেও আইনকে কেউ ভয় না পাওয়ার কারণ কি তা উদঘাটন করা প্রয়োজন। নইলে নির্ধারিত আচরণ বহির্ভূত আচরণে জনপ্রশাসন বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার সুযোগ নিতে পারে কোনো বিশেষ কোটারী। তবে কর্মচারীদের যৌক্তিক দাবীদাওয়া উপেক্ষা করে ফেলে না রেখে যাচাই বাছাই করে প্রয়োজনে কমিটি করে দিয়ে সংলাপ স্থাপনের মাধ্যমে কাজ করলে সংক্ষুব্ধ শ্রেণির ক্ষোভ বহুলাংশে প্রশমিত হয়। তা না হলে ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ জাতীয় বহুলশ্রুত প্রবাদের অনুরূপ ‘আইন আছে প্রয়োগ নেই’ প্রবাদ জায়গা করে নেবে। এভাবেই প্রশাসনের চেইন অব কমা- ভেঙ্গে পড়ছে। আর এ কারণেই সেবাগ্রহীতার অধিকার প্রতিনিয়ত ক্ষুন্ন হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে সরকারি অফিস আদালতে অনিয়মের চর্চা বাড়ছে। প্রতিকার করার কেউ নেই, বরং প্রতিকার প্রার্থীর কপালে খারাপি নিশ্চিত। তাই, যে কোন মূল্যে বেসামরিক প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বৈষম্য নিরসনে দৃশ্যমান কাজ করতে হবে। সেবাদান সহজলভ্য করতে হবে। প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এতসব জিনিস কোন এক ম্যাজিক মন্ত্রে রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে না। যথা সময়ে আইনের সঠিক প্রয়োগ ও এর অব্যাহত অনুশীলনের মাধ্যমেই শক্তিশালী ও সেবামনষ্ক প্রশাসন যন্ত্র স্থাপন করা সম্ভব। অতএব সাধু সাবধান। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এএসজি
বিজ্ঞাপন

রিজার্ভ বেড়ে ৩২.৮০ বিলিয়ন ডলার
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:২৮

আরো

সম্পর্কিত খবর