দক্ষিণ এশিয়া এখন চীনের দখলে!
২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ২০:৪৭
আনিস রায়হান
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কাছে দীর্ঘদিন ধরে ভারতই ‘দাদাভাই’। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে এ অঞ্চলে ভারতের দৃশ্যমান নানামুখী ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু চলমান দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের এই আধিপত্যে ভাগ বসাতে শুরু করেছে চীন। একের পর এক সফলতাও পাচ্ছে তাদের পরিকল্পনা। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে চীনের প্রভাব, আর পিছিয়ে পড়ছে ভারত।
দক্ষিণ এশিয়ায় এই মুহূর্তে শক্তির যে মেরুকরণ, তাতে চীনকেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বলে মানতে হয়। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারে এখন চীনই সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী দেশ। এমনকি বাংলাদেশ-ভূটানের মতো ভারতের একেবারে ঘনিষ্ঠ দেশেও চীন তার অবস্থান আগের তুলনায় শক্ত করেছে।
নেপাল : নেপালের সাম্প্রতিক নির্বাচনে চীন সমর্থিত বামপন্থী জোট বিপুল বিজয় পেয়েছে, পরাজিত হয়েছে ভারত সমর্থিত নেপালি কংগ্রেস। বামপন্থী জোটের সংখ্যাগুরু দল ইউএমএল-এর নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খাদক প্রসাদ ওলী এবারও প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওলীর অভিযোগ, এর আগে চাপে ফেলে তার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল ভারত। সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে নেপালের অর্থনীতিতে ভারতের অঘোষিত অবরোধ দুই দেশের সম্পর্ককে তলানিতে নিয়ে গেছে। নির্বাচনী প্রচারণাকালে ওলী বলেছিলেন, চীন থেকে একটি রেলওয়ে নেটওয়ার্ক নেপাল পর্যন্ত আসবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আরও অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
এটা খুবই পরিষ্কার— উন্মুক্ত সীমান্ত থাকলেও নেপালের সঙ্গে আবার কবে উন্মুক্ত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে ভারত, তা অনিশ্চিত। বামপন্থীদের দুই পক্ষকে জোটভুক্ত করার পেছনে মূল ভুমিকা ছিল চীনের। সুতরাং এই সরকার তাদের পক্ষে থাকবে। ভারতের অঘোষিত অবরোধ এবং ভূমিকম্প বিপর্যয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখায় চীন এতটুকু দাবি করতেই পারে।
মালদ্বীপ : ৭ ডিসেম্বর ২০১৭ বেইজিংয়ে স্বাক্ষরিত হলো চীন-মালদ্বীপ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিপি)। যৌথ বিবৃতিতে মালদ্বীপ সরকার তার সকল পর্যায়ে এবং সকল বিভাগেই চীনের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়ে সম্মতির কথা জানিয়েছে। এতে মালদ্বীপ সরকারের সকল পর্যায়ে চীনের প্রভাব আরও বাড়বে। বিবৃতি বলছে, উন্নত যোগাযোগ ও সহযোগিতার জন্য, মালদ্বীপবাসীর জন্য চীনা ভাষায় স্কুলও চালু করবে চীন। এতে করে মালদ্বীপের সমাজ-সংস্কৃতি ও ভাষাতেও চীনা প্রভাব পড়বে।
এ চুক্তির ফলে মাছ ছাড়াও মালদ্বীপের আরও প্রায় ৪০০ পণ্য চীনে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। আর সীমিত শুল্কে মালদ্বীপে শিল্পপণ্য রফতানি করতে পারবে চীন। মালদ্বীপের শিল্পবিকাশ সেক্ষেত্রে চিরতরে রুদ্ধ হওয়ার শঙ্কা দেখছেন অনেকেই। আর মাছসহ মালদ্বীপের স্থানীয় পণ্যের বাজারেও চীনের পরোক্ষ বিনিয়োগ ঘটছে, ঘটবে। ফলে শুল্ক সুবিধা উভয় দিক থেকেই চীনারা ভোগ করবে। প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন নিজ ক্ষমতা দৃঢ় করতে এবং ভারতীয় প্রতিরোধ মোকাবিলায় এই চুক্তি করে চীনকে পাশে পেতে চাইছেন। যেকোনো সংকট মোকাবিলায় চীনের ওপরই ভরসা করছে তার সরকার।
শ্রীলঙ্কা : শ্রীলঙ্কায়ও পিছিয়ে পড়ছে ভারত। দেশটির বিগত রাজাপাকসে সরকার চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাজাপাকসেকে হঠিয়ে সিরিসেনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পেছনে ভারতীয় সহযোগিতা ও সমর্থনের অভিযোগ আছে স্থানীয়ভাবে। যার ফলশ্রুতিতে রাজাপাকসের দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) এখন সে দেশের সবচেয়ে বড় ভারতবিরোধী শক্তি হয়ে উঠেছে।
সিরিসেনা সরকার ক্ষমতায় আসে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে। এরপর ভারত ও শ্রীলঙ্কার উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে বেশ কিছু সফর বিনিময় হয়। কিন্তু চীন তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। ফলশ্রুতিতে অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যায়, রাজাপাকসে সরকারের চেয়েও সিরিসেনা সরকার যেন বেশি চীনপন্থী হয়ে উঠেছে। এ ছিল এক নীরব অভ্যুত্থান।
শ্রীলঙ্কা অতি সম্প্রতি হাম্বানতোতা বন্দর চীনের কাছে হস্তান্তর করেছে। এটাও ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির অংশ। চীন এখানে ১.৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়া চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিএইচইসি), চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের (সিএসসিইসি) মতো চীনের কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কায় বিপুল বিনিয়োগের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এখন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় আসা মোট বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) মধ্যে চীন থেকে এসেছে ৩৫ শতাংশ, আর ভারত থেকে ১৬.৫ শতাংশ।
চীনা প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে, আর ঝুলে যাচ্ছে ভারতীয় প্রকল্পগুলো। ভারত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হাম্বানতোতা বন্দরের সন্নিকটে অবস্থিত মাত্তালা বিমানবন্দর লিজ নিতে। এই বিমানবন্দরও তৈরি হয়েছে চীনের বিনিয়োগে। বিমানবন্দরটি ভারতকে লিজ দেওয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে রাজাপাকসের দল। ভারত চাইছে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ‘ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কোঅপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট’ (ইটিসিএ) চুক্তি সাক্ষর করতে। ইটিসিএ সই হলে ভারতীয় শিল্পমালিকরা শ্রীলঙ্কায় কারখানা স্থাপন করতে পারবেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার কারণে দুই বছর ধরে ইটিসিএ ঝুলে আছে।
মিয়ানমার : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্কটা আগে থেকেই গভীর। মিয়ানমারে আবিষ্কৃত তেল-গ্যাস দুটি পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে চীনে যায়। এমন কি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত জ্বালানিও যায় এই পাইপলাইন দিয়ে। প্রাকৃতিক গ্যাসের লাইনটি সচল হয়েছে ২০১৪ সালে, আর তেল পরিবহনের লাইনটি চালু হয়েছে ২০১৭ সালের এপ্রিলে। রাখাইন সংলগ্ন কিয়াউকপু এলাকায় গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক জোন পরিকল্পনায় ৯০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন।
সামরিক জান্তার অধীনে মিয়ানমারে ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে চীন। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সমর্থিত অং সান সু চির দল ‘ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি’ (এনএলডি) দেশটির নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে। চীনের সঙ্গে তখন সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা ছিল, কিন্তু চীনা কূটনীতিকরা শেষ অবধি সফল হয়েছেন। মিয়ানমার তার পুরনো বন্ধুতেই আস্থা পাচ্ছে বেশি। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন শক্তভাবে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে, ভারত ভুগেছে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। এর ফলে মিয়ানমারে ভারতের সুযোগ আরও কমে গেল।
পাকিস্তান : চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা নেওয়ার নীতিতে এগুচ্ছে পাকিস্তান। ভারতকে চাপে ফেলতে নিজেদের মাটিতে তারা বাস্তবায়ন করছে চীনের একগুচ্ছ উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আলোকে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) কাজ চলছে। ধুলোয় ঢাকা গোয়াদর শহরে চলছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ। গোয়াদরে বিভিন্ন অবকাঠামো এবং নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং।
অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানে এভাবে ভীত গাড়লেও ক্রমশ তাদের রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রেও জায়গা করে নিয়েছে চীন। কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া, মার্কিনের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতায় সৃষ্ট শূন্যস্থান পূরণ করা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থন দেওয়া এবং চীনা বিনিয়োগের সুরক্ষায় দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে আন্তঃসংযোগ প্রতিষ্ঠা— এসব পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারণী ক্ষেত্রে সর্বত্রই চীন ঢুকে পড়ছে। ভারত চায় এ অঞ্চলে পাকিস্তানের যেকোনো ধরনের উত্থানকে প্রতিহত করতে। কিন্তু চীনের সঙ্গে দেশটির সাম্প্রতিক গাঁটছড়া ভারতকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
ভূটান ও বাংলাদেশ : দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এখন কেবল ভূটান ও বাংলাদেশই ভারতের সবচেয়ে কাছের মিত্র। ভূটানের কোনো সেনাবাহিনী নেই, এক চুক্তি মোতাবেক ভারতই তাদের রক্ষাকর্তা। ফলে তারা কখনো ভারতের বলয় থেকে বের হবে, এটা কেউ ভেবেনি। কিন্তু চীনারা হাল ছাড়েনি। ক্ষুদ্র এই প্রতিবেশীর সঙ্গে সকল সীমান্তবিরোধ মিটিয়ে ফেলতে গোপন কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে তারা। একটি চুক্তি চূড়ান্ত করতে ভূটানের সঙ্গে তারা ২৪ দফা আলোচনায়ও বসেছে। কিন্তু ভূটানের সঙ্গে কথা-বার্তা এগোলেও ভারতের বাধায় তা কার্যকর করা যাচ্ছে না বলে বছরের শুরুতে জানায় চীন। এর কিছু পরই দোকলাম নিয়ে শুরু হয় চীন-ভারত অচলাবস্থা। ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভূটানের সঙ্গে গোপনে চীনের এই সম্পর্কোন্নয়ন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
যদিও বাংলাদেশ এই মুহূর্তে নিবিড়ভাবে ভারতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তবু চীন উন্নতি করছে। বিনিয়োগ বাড়িয়েছে, সহযোগিতার নানা ক্ষেত্র উন্মোচনে দুই দেশ একত্রে কাজ করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত রোহিঙ্গা বিষয়ক সমঝোতা চীনের প্রভাবেই ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে। ওই অঞ্চলে চীনের প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে এ রকম কিছু দরকার ছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা হয়ে গেছে বললে, মিয়ানমারের পক্ষে পশ্চিমা চাপ কিছুটা হলেও এড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য ছিল এ বিষয়ে একটি বহুপাক্ষিক চুক্তি করা। কিন্তু সেখান থেকে চীনের প্রভাবেই সরে গেল দেশটি।
চীনের অগ্রসরতার ভিত্তি : চীনের এই ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার উৎস হলো, ‘বোঝাহীন বিনিয়োগ’। এ অঞ্চলের দেশগুলো যেখানে ভারতীয় ঋণের সঙ্গে তাদের দুরভিসন্ধিমূলক রাজনৈতিক স্বার্থ দেখে, চীনের বিনিয়োগকে সেই তুলনায় অনেক নিরাপদ মনে করছে। চীনের এ সাফল্যের পেছনে কাজ করছে তাদের কূটনৈতিক সামর্থ্য, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দক্ষতা এবং তথাকথিত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি।
চীনের বর্তমান সরকার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আগ্রাসী এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী। প্রেসিডেন্ট শির খোলামেলা ঘোষণা— এখন এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক শক্তি হিসেবে বেইজিংয়ের উত্থানের সঙ্গে অন্যদের অভিযোজন করে নিতে হবে। চীন এটা কখনই মেনে নেয়নি যে, দক্ষিণ এশিয়া ভারতের একচেটিয়া প্রভাবের অধীনে থাকবে। এখন তারা ধীরে ধীরে সে অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
ভারত যখন বড় দেশগুলোর সঙ্গে দফা-রফায় ব্যস্ত অথবা আঞ্চলিক নানা প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীন, চীন তখন এসব দেশের বাস্তব সমস্যায় নজর দিয়েছে, স্থানীয় দ্বন্দ্বগুলো কাজে লাগিয়েছে, যেকোনো সমস্যায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে একই নীতি নিয়ে কাজ করে চলেছে তারা। এভাবে অল্প দিনের মধ্যেই এই অঞ্চলে চীন তার অবস্থান শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে।
আনিস রায়হান: সাংবাদিক
দ্রষ্টব্য: এই কলামের সকল মতামতের দায়িত্ব লেখকের