Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশ ভারতের গ্রহীতা নয়, দাতা


৯ আগস্ট ২০১৮ ১৪:৩১

ইকরাম কবীর ।।

পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের রাজনীতির মাঠ ইদানিং বেশ গরম। এটি শুরু হয়েছে আসামের রাজ্য-সরকার সেখানকার চল্লিশ লাখ মানুষকে অনিবন্ধিত নাগরিক বলে ঘোষণা দেয়ার পর থেকে। এ দেখে পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী চটেছেন এবং তাই দেখে তাঁর ওপর সারা ভারতের বিজেপির নেতারা প্রচণ্ড ক্ষেপেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে সে দেশে বেশ কাদা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। তবে আমার কাছে খুব মজা লেগেছে পশ্চিমবঙ্গের এক নেতার কথা শুনে। তিনি বিষয়টির মাঝে আকাশ থেকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। তারপর থেকে তিনি একা নন, সেখানকার অনেকেই এখন এই বিষয়টির ভেতর বাংলাদেশ প্রসঙ্গ খুঁজে পাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

আমার নজর আকর্ষিত হয়েছে রাজ্য বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি আলি হোসেনের দিকে। মমতা ব্যানার্জীকে আক্রমন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “১০০ শতাংশ ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টানদের ধর্মীয় সংকট রয়েছে। তাঁরা শরণার্থী হিসেবে এ দেশে আসছেন। কিন্তু মুসলমানদেরতো সে দেশে কোনও সংকট নেই। দিনের পর দিন তাঁদের অনুপ্রবেশ মেনে নেয়া যায় না। আমরা যদি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে থাকতে চাই, আমাদের কি ওঁরা আশ্রয় দেবেন? কিছুতেই দেবেন না। অনুপ্রবেশকারী বলে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হবে”।
খবরটি ছেপেছে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা।

আসামে যে চল্লিশ লাখ মানুষ নাগরিক নিবন্ধন থেকে বাদ পড়েছেন তাদেরকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা হচ্ছে এবং তারা বাংলায় কথা বলেন বলেই বলা হচ্ছে এরা সবাই বাংলাদেশ থেকেই সেখানে গিয়েছেন। এ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম ও বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্কও চলছে, তবে কেউই এখনও ঠিক করে বলতে পারেন নি যে এই মানুষগুলোর ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে। তবে আমার এই লেখার বিষয় ঐ চল্লিশ লাখ মানুষ নন। আমার বিষয় হচ্ছে আলি হোসেনদের মত নেতাদের জন্য কিছু তথ্য সরবরাহ করা। এরা মনে করেন যে বাংলাদেশ থেকে মানুষ ভারতে অনুপ্রবেশ করে সেখানকার ধন-দৌলত লুটেপুটে খাচ্ছে। একটু সময় নিয়ে দেখতে চাই কথাটি কতটা সত্য। জনাব আলি হোসেন কি সত্যিই জেনে বলছেন না বলার জন্য বলে যাচ্ছেন তা নিয়ে একটু ভাবতে চাই। তিনি এবং তাঁর মত মানসিকতা নিয়ে যাঁরা চলছেন তাঁরা ভারতে বাংলাদেশের সম্পর্কে কতটুকু জানেন?

বিজ্ঞাপন

শুনুন তাহলে।
আমরা বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা মনে করি এ দেশ ভারতের গ্রহীতা নয়। বাংলাদেশ ভারতের দাতা। এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ভারতকে শুধু দিয়েই এসেছে। দু’হাজার পনেরো সালের একটি গবেষণার তথ্য দিই। বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম রেমিট্যান্স-দাতা দেশ। এখান থেকেই আপনাদের অনেক অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। কেমন করে ঐ অর্থ আয় হয় তা ভেবে দেখেছেন? ভারতীয় নাগরিক যারা বাংলাদেশে চাকরি করছেন এ দেশ থেকে বছরে ৩.৭ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার তাদের দেশে পাঠাচ্ছেন। বছরে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারে কত টাকা হয় হিসেব করে দেখেছেন? শুধু শুধু উত্তেজিত হন কেন?

আমরা অবশ্যই দেখতে চাই যে আপনারা কোন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে সেখানে থাকতে দেবেন না, তা যে দেশেরই হোক। পেলে, তাদের ধরে অবশ্যই নিজের দেশে পাঠিয়ে দেবেন। তবে আমাদের দেশেও যে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী আছে এবং তাঁদের সংখ্যা পাঁচ লাখ এ কথা কি আপনারা জানেন? তাঁরা এখানে কোন অনুমতি ছাড়াই কাজ করে চলেছেন এবং নির্বিঘ্নে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। কোই আমরা কি তাঁদের গালমন্দ করছি? তাঁদের বের করে দিয়েছি বা জেলে ঢুঁকিয়েছি? জানেন তো, আপনাদের দেশের মানুষ এখানে সব বড়-বড় পদ দখল করে বসে রয়েছেন? তাও আবার বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়াই! তাহলেই বলুন, বাংলাদেশ কি আপনাদের দিচ্ছে না? আর বাংলাদেশি অনুপ্রবাশকারীরা ভারতে গিয়ে কেমন ধরনের কাজ করছেন? আপনারা বাংলাদেশের মানুষকে দিয়ে কুলি-মজুরের কাজ করাচ্ছেন!

এবার চলুন একটু কলকাতা শহরের নিউমার্কেট এলাকায় যাই। কি দেখা যায় সেখানে, সেখানকার হোটেল ও দোকান-পাটে? কারা খরচ করছে? কারা কেনাকাটা করছে? শুধু নিউমার্কেট এলাকা নয়; অন্যান্য মলগুলোতে গিয়েও দেখুন অর্থ ব্যয় করছেন বাংলাদেশিরা, ভারতীয়রা নয়। বাংলাদেশিরা নিজের দেশের আয় করা অর্থ আপনাদের ওখানে গিয়ে ঢেলে দিয়ে আসছেন। ঈদের সময় ও পুজা-পার্বণে আপনাদের দোকানীদের ৯০ শতাংশ মুনাফা আসে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে। ঈদের সময় প্রায় দেড় লাখ মানুষ ভারতে কেনাকাটা করতে যান এবং ঈদের আগে-আগে ঢাকায় ভারতের দুতাবাস থেকে প্রায় এক লাখ ভিসা দেয়া হয়। এই ভিসা কেন দিচ্ছেন? জেনেই দিচ্ছেন যে এঁরা আপনাদের দেশে গিয়ে খরচ করে আসবেন।

একেকজন বাংলাদেশি যদি এক হাজার ডলারের কেনাকাটা করেন, তাহলে ভারত কত অর্থ আয় করছে? ভাবছেন, বাংলাদেশিরা বোকার হদ্দ; নিজের দেশে কেনাকাটা না করে আপনাদের ওখানে গিয়ে করে। হতে পারে, তবে আপনাদেরকে দেয়ার জন্য একটা ধন্যবাদতো দিতে পারেন। অথচ সবসময় ঘৃনা-মিশ্রিত কথাই বলে চলেছেন। কেন করেন এই ঘৃনা? রাজনীতির কারণে? আমরাওতো রাজনীতি করি, কিন্তু কই, আমরাতো আপনাদের ঘৃনা করি না।

আবার আপনাদের হাসপাতালগুলোর কথা বলি। ভারতের হাসপাতালগুলোতে বেশ ভাল চিকিৎসা পাওয়া যায়। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে ভাল। ভারত সরকারের এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে সেখানে ৪৬০,০০০ বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন যাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ১৬৫,০০০ জন। তার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশিরা মোট সংখ্যার ৩৫ শতাংশ। আরো বলা হচ্ছে যে ১৬৫,০০০ জন বাংলাদেশি যাচ্ছেন ভিসা নিয়ে এবং সীমান্ত অঞ্চলের আরো অনেকে যাচ্ছেন ভিসা ছাড়াই যা হিসেব করলে দেখা যায় বাংলাদেশিরা মোট সংখ্যার ৫০ ভাগ যা দু’লাখের মত। এখানে প্রতি মাসে প্রায় ৪০০ জন রোগী ভারতীয় ভিসার জন্য আবেদন করছেন। এখন ভাবুন এই দু’লাখ বাংলাদেশি ভারতের হাসপাতালগুলোতে গিয়ে অর্থ খরচ করছেন। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার মতে বাংলাদেশিরা ভারতে গিয়ে চিকিৎসা বাবদ ৩৪৩ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার খরচ করেছেন।

আসুন এবার কতজন পর্যটক বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ভারতে যাচ্ছেন তার হিসাবে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে ভারতীয় সুত্রে বলা হচ্ছে যে ১৬ থেকে ১৭ লাখ বাংলাদেশি প্রতি বছর সেখানে যাচ্ছেন। পর্যটকদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা আমেরিকানদের ঠিক পরেই। দশ বছর আগে ভারতে আসা বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ছিল না প্রথম দশের ভেতরেও। সরকারি পরিসংখ্যান মতে, ২০০৬ সালে যেখানে ভারতে আসা বিদেশিদের দুই শতাংশেরও কম যেত বাংলাদেশ থেকে, সেটি এখন বেড়ে দাড়িয়েছে ১৪.১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাওয়া পর্যটকের হার ১৫.১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসাকাজ, ব্যবসায়িক প্রয়োজন এবং শপিং এ বেশি যান। এঁরা কত অর্থ সেখানে খরচ করছেন তা একবার ভাবুন।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বেশিরভাগ সময় ভারতের জীবনে বাংলাদেশই দাতা হিসেবে কাজ করছে। স্বাধীনরা যুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল এবং আমাদের শরণার্থীদের সেখানে আশ্রয় দিয়েছিল যা আমরা মনভর্তি কৃতজ্ঞতা নিয়ে স্মরণ করি। কিন্তু তারপর থেকে ভারত শুধু নিয়েই গেছে এবং বাংলাদেশ দিয়েই গেছে।

জনাব আলি হোসেনের মত রাজনীতিক ভারতে অনেক আছেন। তাঁরা বাংলাদেশ নিয়ে কিছু সস্তা বিষোদ্‌গার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার আগে একটু চিন্তা করার অনুরোধ জানাতে চাই।

ইকরাম কবীর, গল্পকার ও কলামিস্ট।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর