শেখাল শিশুরা, আমরা বড়রা কি শিখেছি?
১১ আগস্ট ২০১৮ ১৮:১৯
।। জিমি আমির ।।
কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়কার কথা। ছাত্ররা রাস্তায় সবার লাইসেন্স চেক করছে। এ দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে ফিরে গেলাম বিদেশ ভ্রমণের কিছু স্মৃতিতে। ওয়াশিংটনে ফরেন প্রেস সেন্টারে যাওয়ার সময় দেখি রাস্তায় আশপাশের কোনো গাড়ি নেই। দূর থেকে একটা গাড়ি আসছিল। চিরাচরিত বাঙালি আমি সেটাকে হাত দেখিয়েই দৌড়। দূর থেকেই বুঝলাম, গাড়িটা ব্রেক কষল। আমার দৌড় দেখে ড্রাইভারের আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা হয়েছিল সেদিন।
ওইভাবে রাস্তা পার হওয়ার ঠেলা বুঝলাম একটু পর। আমাদের ফেলোশিপ টিমের মেন্টর ক্যাথি রীতিমত আমার দিকে তেড়ে এলো। বলল, এটা তুমি কী করলে? এভাবে কেউ রাস্তা পার হয়? এটা কি রাস্তা পার হওয়ার কোনো নিয়ম? তাছাড়া, এটা আমার শহর নয়। এখন যদি কিছু হয় তাহলে তোমাকে কিভাবে রক্ষা করব? খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল ক্যাথিকে। ভয়ও পাচ্ছিল। এই ঘটনায় খুবই লজ্জা পেলাম, বাকিদের চোখ রাঙানিও নিরবে হজম করলাম। এরপর সিগন্যাল দেখে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে কিভাবে রাস্তা পার হওয়া যায়, তা শিখে নিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা।
একদিন সকাল ৮টায় ওকলাহামা শহর থেকে আমাদের গাড়ি এয়াপোর্টের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখলাম গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। বুঝলাম না আমি। ক্যাথিকে জিজ্ঞেস করি, রাস্তা তো খালি, গাড়ি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল কেন? ক্যাথি বলল, সিগন্যাল পড়েছিল, তাই। আমি রাজ্যের অবাক হয়ে দেখলাম সাত থেকে আটটি রাস্তার মাথা। কোনোদিকে কোনো গাড়ি নেই। ঢাকা হলে তো এই সিগন্যালকে থোড়াই কেয়ার করে গাড়ি বের হয়ে যেত। ক্যাথি বলল, কন্ট্রোল রুম থেকেই সিগন্যাল মনিটরিং হচ্ছে। সুতরাং সিগন্যাল অমান্য করে চলে গেলে গাড়ি ফিরে আসার আগেই জরিমানার চিঠি চলে যাবে গাড়ির মালিকের ঠিকানায়। শুধুই শুনে গেলাম। বলার তো কিছু নেই। সবই নতুন আমার জন্য।
ব্যস্ত নিউইয়র্ক শহরে ঘুরছি। জীবনে বিদেশ তো দেখিনি। তাই চারপাশে যা পাচ্ছি, গোগ্রাসে গিলছি— এমন একটা অবস্থা। খেয়াল করলাম, রাস্তায় চলন্ত গাড়িগুলোর মধ্যে হঠাৎ একটা গাড়ির সামনে আর একটা গাড়ি থামল। চলন্ত রাস্তায় গাড়ি থামানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই, বিষয়টা বুঝতে না পেরে ড্রাইভিং সিটে বসা আমাদের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হুসেন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, ঘটনাটা কী? তিনি বুঝিয়ে বললেন, সামনে গিয়ে যে গাড়িটা আটকাল, ওটা পুলিশের গাড়ি ছিল। পেছনের গাড়িটি নিশ্চয়ই কোনো অনিয়ম করেছে, তাকে ধরার জন্যই এই অবস্থা। ভাবলাম, যাহ বাবা, নিরবে পুলিশ গিয়ে দাঁড়ালো কোনো শব্দ ছাড়াই!
বিশাল হাইওয়েতে গাড়ি চলে কয়েকটি লেনে। অথচ কোনো গাড়ির সঙ্গে কোনো গাড়ির রেষারেষি নেই। বিকট কোনো হর্ন নেই। সাইকেলের জন্য আছে আলাদা লেন। নিয়ম কাকে বলে, তারই যেন সংজ্ঞা দেখলাম ভিনদেশে। এসব চোখে না দেখলে বোঝা বা কাউকে বোঝানো অনেক কঠিন।
লন্ডন শহরতলীর একটি গ্রাম থেকে ফিরছিলাম এক সন্ধ্যায়। তো ফিরতি পথে এক শপিংমলে ঢুঁ মারার জন্য সবাই নামার সিদ্ধান্ত নিল। নামার সময় আমি যথারীতি ঢাকার মতো করে ধাম করে গাড়ির দরজা খুললাম, যা পাশের গাড়ির সাথে হালকা ধাক্কা খেল। গাড়ির বাঙালি মালিক দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে আমাকে বললেন, আপনি সরে যান। তার চিন্তিত চেহারা দেখে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তিনি তার নিজের গাড়ি যে জায়গায় ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে হয়েছে, সেই জায়গাটা দ্রুত মুছে নিলেন। পরে এসে বললেন, গাড়ির দাগটা মুছে ফেললাম।
এই হচ্ছে আমার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। আমি সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে জানতে চেয়েছি, আপনারা তো দেশে গিয়ে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। সেই আপনারাই বিদেশে সব ধরনের নিয়ম মানেন নিপাট ভদ্রলোকের মতো? জবাব ছিল, বিদেশে নিয়ম খুব কড়া, জরিমানা গুনতে হয় শত শত ডলার। কেস খেতে হয়, জেলে যেতে হয়। নিয়মের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই বললেই চলে। আর দেশে তো নিয়ম শিথিল। সবাই যেভাবে চলে আমরাও সেভাবেই চলি।
গত কয়েকদিন শিক্ষার্থীদের গাড়ির লাইসেন্স চেক করার বিষয়টা দেখেই মনে পড়ল অনেক আগেকার এসব ঘটনা। ৪৬ বছর ধরে একটি দেশ চলছে। বলা হচ্ছে, ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। অথচ দেশের ভেতরের ভয়াবহ অনিয়মের চিত্রই কিন্তু দেখতে পেলাম আমরা। তাহলে, সব উন্নয়ন কি শুধু কাগজে-কলমে?
৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির দেশ এখন বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশই এখন ৭ শতাংশ জিডিপি অর্জন করতে পারেনি। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তালিকায় নামও উঠে গেছে বাংলাদেশের। দারিদ্র্যসীমা নেমে এসেছে ২৪ শতাংশের নিচে। কৃষি, শিল্প, সেবার প্রবৃদ্ধি এখন বেশি। অথচ সেই দেশটি এখনও সড়কের নিয়ম জানে না। বছর তিনেক আগে ঢাকার রাস্তায় একবার সিগন্যাল বাতি অনুযায়ী ট্রাফিক কন্ট্রোল করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা কাজ করেনি। দুই দিনের মাথায়ই তা বন্ধ করতে হয়েছিল। রাস্তায় পাখির মতো মানুষ মরে অজ্ঞ, মদ্যপ, লাইসেন্স না থাকা চালকদের জন্য। আর আইনের কোনো প্রয়োগ না থাকায় খুব সহজেই পার পেয়ে যান এসব চালক।
এসব অনিয়ম দেখার যেন কেউ নেই। এ দেশেই আবার শ্রমিক নেতা হিসেবে সমধিক খ্যাত এক মন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘রাস্তায় গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভার হওয়া যাবে। লাইসেন্সের দরকার কী!’ যে দেশের মন্ত্রীরই এই অবস্থা, সেই অভাগা দেশে মানুষ আর কী-ই বা চাইতে পারে এ ধরনের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে।
গত ২৯ জুলাই থেকে শুরু করে পরের কয়েকদিন রাজধানীর প্রধান সড়ক ছিল স্কুলের শিক্ষার্থীদের দখলে, যাদের এতদিন আমরা বলে এসেছি ফার্মের মুরগি। সবসময় গালমন্দ করে বলেছি, এরা দিন-দুনিয়ার কিছুই বোঝে না। এমন প্রজন্ম দিয়ে আমরা কী করব?
কিন্তু সবার চোখ কপালে তুলে দিয়ে এরা যা করে দেখাল, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। নব্বইয়ের গণআন্দোলন আমার জীবদ্দশায় হলেও তখন খুব ছোট। তাই, ওই আন্দোলনের কোনো স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা নেই। অন্য সব ছাত্র আন্দোলনের মতোই ওটাও বইয়ে পড়া বা বড়দের মুখ থেকে শোনা। কিন্তু এই কয়েকদিনের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন যেন বাকি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে বলেই মনে করছেন সাবেক ছাত্র আন্দোলনকারীরা।
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ স্লোগানগুলো এখন সার্বজনীন স্লোগানে পরিণত হয়েছে। রাস্তায় গাড়ির লাইসেন্স চেকিংয়ের মাধ্যমে দেখা গেল, পুরো রাষ্ট্রের একটি ভয়াবহ ফাঁপা চিত্র। মুখ্য সচিব থেকে শুরু করে বিচারক, কিংবা সাধারণ ড্রাইভার— কারও কাছেই বৈধ কাগজ নেই। কী ভয়ানক!
গত কয়েকদিনে মনে হয়েছে, কী হবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দিয়ে, কী হবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে। পাখির মতো মানুষ মারার বিচার যে দেশে হয় না, যে দেশে নেই কোনো জবাবদিহিতা, যে দেশের দেশের ভবিষ্যৎ চাকার তলায় লুটোপুটি খায়, সেই দেশ সত্যিকার অর্থেই কতদূর যেতে পারে, তাই আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ছোট ছোট বাচ্চারা। আমরা বড়রা কি আদৌ কিছু শিখব তাদের কাছ থেকে?
সারাবাংলা/এসবি/টিআর