এই ক্ষতিটা অপূরণীয় কিনা জানি না?
১১ আগস্ট ২০১৮ ১৯:৫৮
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এবারের ক্ষমতাসীনের দশ বছর হতে চলল। টানা দুইবারের দেশশাসনের মেয়াদ এবছরের ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে জয়ী হতে পারলে দলটি ফের ক্ষমতায় বসবে। যদি এমনটা হয় তবে সেটা হবে নতুন ইতিহাস; টানা তিন নির্বাচনে জিতে দেশশাসনের রেকর্ডও বটে।
কিন্তু সময়ের বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, আওয়ামী লীগের শাসনামল যেমন সাফল্যের কথা বলে, তেমনি বলে ব্যর্থতার কথাও। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই সরকার দেশকে অনেকটা সামনে এগিয়ে নিয়েছে বটে, তবে দুর্নীতি আর বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দেওয়ার নজিরও দেখিয়েছে এই সরকার। তাতে মানুষের আকুতি-আহাজারি বেড়েছে। এসব ব্যর্থতা শাসক দলের অর্জনকে আড়াল করতে বসেছে। যা শাসক দলকে একটা বড় প্রশ্নের মুখেও ঠেলে দিয়েছে।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের মূল কারণ পূর্ববর্তী শাসক বিএনপির দুঃশাসনই কেবল ছিল না, ছিল দলটির নির্বাচনী অঙ্গীকারে মানুষকে আকৃষ্ট করার উপাদান। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করাসহ ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারগুলোসহ অপরাপর অঙ্গীকারে সাধারণ ভোটার, বিশেষ করে তরুণসমাজের বড় অংশ নিজেদেরকে খুঁজে পেয়েছিল। ফলে স্রেফ আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটগুলো বাদে বাকি প্রায় সকল ভোট পেয়েছিল দলটি।
ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী অঙ্গীকার ভোলেনি আওয়ামী লীগ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়; এবং সবগুলো ধাপ অতিক্রম শেষে বেশ কজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর শাস্তিও কার্যকর হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার পূরণে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বেশকিছু ধাপ অতিক্রম হয়, যা এখনও চলমান। এসবের বাইরে সরকারের কিছু জন ও উন্নয়নবান্ধব কর্মসূচি দৃশ্যমান হয়। পদ্মাসেতু দৃশ্যমান, রাজধানীতে বসছে মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চারলেন সড়ক তৈরি হয়েছে, এসবই এখন দৃশ্যমান। এগুলো সরকারের অর্জন নিঃসন্দেহে, এবং স্বীকারে দেশবাসীর দ্বিধা থাকারও কথা নয়।
প্রথম দফা ক্ষমতার মেয়াদপূর্তিতে ২০১৪ সালে দেশে যে নির্বাচন হয় তাতে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ দল বিএনপি অংশ নেয়নি। ফলে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দিতায় সাংসদ হয়ে যান। এনিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা হলেও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার এই নির্বাচন গুরুত্ব রাখে এবং তা মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। নাগরিক হিসেবে ভোট নামক অধিকার প্রয়োগ করতে না পারলেও অনেকেই সেবার মেনে নিয়েছেন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
আওয়ামী লীগের এই দফা শাসনামলে অনেকদিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া থমকে গেছে; মুক্তমনা লেখকদের ওপর একের পর এক আঘাত এসেছে; ধর্মীয় মৌলবাদীদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সরকার আপোষ করেছে তা অনেকাংশেই প্রকাশ্য; প্রগতিশীলতার পক্ষে থাকা আওয়ামী লীগ বিভিন্ন উপায়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের রক্ষাকবচ হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে। তার ওপর যোগ হয়েছে- তারুণ্যঋদ্ধ বিভিন্ন আন্দোলন নিয়ে সরকারের ভূমিকা। প্রশ্ন উঠেছে-এর ফলে দলটি কী ক্রমে বন্ধুশূন্য হতে বসেছে?
যুদ্ধাপরাধের বিচারের গতি স্তিমিত করে দিয়ে সরকার দেশপ্রেমিক তরুণদের থেকে দূরে সরেই যায় নি কেবল, মুক্তমনা লেখকদের নিরাপত্তাহীনতায় এই শ্রেণির বিরাট এক জনগোষ্ঠির শত্রুসম হয়ে ওঠেছে। তার ওপর আছে সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন মন্ত্রী ও সরকার-প্রশাসনের নানারকম হুংকার-বক্তব্য, যা দলটির জনসমর্থন হারানোয় ভূমিকা রাখছে।
এটা উল্লেখের দাবি রাখে যে, দেশের লেখক অংশের সকলেই মুক্তমনা লেখক নন, কিন্তু দেশের প্রগতিশীল মানুষদের অধিকাংশই প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধবিরোধী, একইভাবে মুক্তমনা লেখকদের প্রতিও সমব্যথী। সরকারের মৌলবাদ তোষণ ও মুক্তমনা লেখকদের উদ্দেশ করে নানা ধরনের আপত্তিকর বক্তব্যকে এক্ষেত্রে তারা ইতিবাচকভাবে নেয়নি।
আওয়ামী লীগের এই দফা শাসনামলে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছে। দেশব্যাপী চলা এই আন্দোলনকে সরকার প্রথমে শক্তি প্রয়োগ এবং পরে পূরণের আশ্বাস দিয়ে আরও পরে সেটা বাস্তবায়ন না করেই আন্দোলনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছে।
সারাদেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর এই আন্দোলন পুলিশের লাঠিচার্জ আর কাঁদানে গ্যাসে বন্ধ হয় নি। প্রথম দফা বন্ধ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর এক ঘোষণায় কিংবা প্রতিশ্রুতিতে। পরে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন নি। এতে করে লক্ষ শিক্ষার্থী হতাশ হয়েছে। এই হতাশা প্রধানমন্ত্রীর ওপর থেকে কি আস্থা হারানোর কাজ করে নি? করেছে; যা পরবর্তীতে দৃশ্যমানও হয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে আগামীতে ভোটের রাজনীতিতে এর প্রভাব কী পড়বে না।
কোটা আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হলেও এর প্রভাব পড়েছে চাকরিপ্রত্যাশী জনগোষ্ঠির বাইরের নাগরিকদের মাঝেও। শিক্ষার্থীসহ তারাও প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও কোটা ব্যবস্থা সংস্কার না হওয়ায় বিস্মিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের জনসমর্থনে তার প্রভাব পড়বে না, সেটা কেউ বলতে পারবে না।
শিক্ষার্থীদের এক আন্দোলনের পর এবার অন্য এক আন্দোলন দেখছে দেশ। এবারের দাবি নিরাপদ সড়ক বা সড়কে নিরাপত্তার। এবারও দৃশ্যপটে শিক্ষার্থীরা, তবে এরা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া। এর শুরুটা রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর বাসচাপায় নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। ওই দিনই শ্রমিক নেতা ও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শিক্ষার্থী-মৃত্যুর ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অদ্ভুত হাসি হেসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে এই হত্যাকাণ্ডকে জায়েজের চেষ্টা করলেন। তার এই হাসি ছিল নির্মম এবং হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার দুরভিসন্ধি। এরপর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। উত্থাপন হয় নয় দফা দাবি। ঢাকার ওই শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল আন্দোলন একটা সময়ে সারা দেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে, আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীরা গাড়ির কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাই শুরু করে। এর কবলে পড়ে পুলিশ, মন্ত্রী-সাংসদের ড্রাইভার, সাংবাদিক-ডিআইজির গাড়ি। উলটোপথে গাড়ি চালাতে গিয়ে লজ্জায় পড়তে হয় বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী তোফায়েল আহমদকে, গাড়িচালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় গাড়ি বদলাতে হয় মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে। এ ঘটনাগুলো সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। সাধারণ মানুষেরা এর প্রশংসা করতে থাকে। শিক্ষার্থীদের এমন ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজপত্র চেকিংয়ে নেমে যাওয়ায় ঢাকা হয়ে প্রায় পরিবহনশূন্য। এই পরিবহনশূন্যতার পেছনের মূল কারণ কাগজপত্রের ঘাটতি। মন্ত্রী শাজাহান খানের আশীর্বাদপুষ্ট পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা দেশব্যাপী অঘোষিত ধর্মঘট পালন করে। ফলে দৃশ্যত অচল হয়ে পড়ে সারাদেশ।
ইত্যবসরে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান নিহতদের বাড়িতে যান, তার হাসির জন্যে ক্ষমা চান তিনি। প্রধানমন্ত্রী নিহতদের পরিবারকে সাক্ষাৎ দিয়ে দুই পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকা করে ৪০ লক্ষ টাকার অনুদান দেন। তবু শিক্ষার্থীরা রাজপথ থেকে সরেনি। এমন পরিস্থিতিতে মাঠে নামে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশ। তারা আগ্রাসি হয়ে ওঠে। আক্রমণও করে। আহত হয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের একটা অংশ সংঘর্ষে জড়ায়। সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ে তৃতীয় শক্তিগুলোও। আন্দোলনের বাইরে থাকা অনেকেই এতে উসকানি দেওয়া শুরু করে, গুজব ছড়ানো হয়, রাজনৈতিক নেতাদের উসকানিমূলক অডিও ফাঁস হয়। সরকার দাবি করে আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ঢুকেছে। বিভিন্নভাবে তার প্রমাণও হাজির করে। ফলে পুরো ব্যাপারটি রহস্যময় ও গোলমেলে হয়ে যায়। এতে আন্দোলন থেমে যায়।
শিক্ষার্থিদের আন্দোলন নিয়ে এই গুজব, উসকানি, সংঘর্ষ এতকিছু চললেও সারাদেশের মানুষের কাছে শিক্ষার্থিদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা কমেনি। সাধারণ মানুষ ও শিশুমনের আবেগ লাইসেন্স চেকিংয়ের এই কাজকে সমর্থন করছে। যদিও সেটা এক-দিনের প্রতীকী এক কর্মসূচি হওয়া উচিত ছিল। এই অনতি-তরুণেরা এমন কর্মসূচি দীর্ঘদিনের জঞ্জাল সাফ করার শুরুর প্রক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তারুণ্যের বহ্নিশিখা আর আবেগে হয়ত তারা ভাবছে এমন করে তারা সত্যি সত্যি দেশকে হুট করে বদলে দিয়ে যাবে। বাস্তবতা থেকে এটা বেশ দূরে, এবং আবেগ সর্বক্ষেত্রে বাস্তবতা থেকে কিছু দূরে অবস্থান করে বলে তারা এই মোহ কাটাতে পারছে না।
শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তবে সেজন্যেও সাধারণ মানুষ দোষ দিচ্ছে সরকারকে। কিছু জায়গায় আক্রমণের শিকার হয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরতে হয়েছে। এই ফিরে যাওয়াটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হওয়ার দরকার ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। এই অস্বাভাবিকতার দায় গিয়ে পড়ছে সরকারের ওপর।
এই শিক্ষার্থীদের মাঝে এই ধারণা পোক্ত হয়েছে যে সরকার তাদেরকে বাধা দিয়েছে, সরকারের লোকজন তাদেরকে আক্রমণ করেছে। এই শিক্ষার্থীরা কী শাসক দল আওয়ামী লীগের পক্ষের লোক হতে পারবে? সে প্রশ্নটিই যখন সামনে এসেছে তখন এটা একটা রাজনৈতিক দলের জন্যে বড় শঙ্কার।
আগামী চার-পাঁচ বছরেই এই শিক্ষার্থীরা দেশের ভোটার তালিকায় নাম ওঠাবে। তখন তারা কী নির্দ্বিধায় আওয়ামী লীগের বন্ধু-পক্ষের লোক হতে পারবে? সন্দেহ থেকেই যায়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। দলটির রয়েছে সুদীর্ঘ গৌরবের ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামে দলটির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। দেশের অর্থনীতিকে আজ সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই দলটির সরকার। এত এত সাফল্যের উপাখ্যানে ঋদ্ধ দলটির নিজস্ব সমর্থকগোষ্ঠি থাকার পরেও একটা শ্রেণি রয়েছে আওয়ামীবিরোধি ভূমিকায়। তাদের একটা উষ্কানি সবসময়ই থাকে। তার ওপর কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সহ নানা আন্দোলনের সময়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে দলটি আরও কিছু মানুষের বিরাগভাজন হতে চলেছে স্থায়ীভাবে।
এই ক্ষতিটা অপূরণীয় কিনা জানি না, তবে সেটা দীর্ঘমেয়াদের হতে চলেছে!
লেখক: সাংবাদিক
সারবাংলা/এমএম