রক্তস্নাত কফিনে স্বপ্নের কারিগর
১৭ আগস্ট ২০১৮ ১৬:০১
স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষের বহুল ব্যবহৃত অস্ত্রের একটি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর চাইতে জিয়া বেশি জনপ্রিয় ছিল, তাঁর প্রমাণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জানাজায় হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের উপস্থিতির বিপরীতে জিয়ার জানাজায় উপস্থিত কয়েক লাখ মানুষ। বঙ্গবন্ধুর সাথে জিয়া কেন, বাংলার আর কোন মানুষের তুলনার ধৃষ্টতায় আমি যাব না। ১৫ই আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর কি অবস্থায়, কতটা অবহেলার সাথে এই দেশের জনক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুনীরা দাফন করে সেই চিত্রটাই আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ঘটাতে যাওয়ার আগে সিপাহীদের এই বলে উদ্বুদ্ধ করা হয় যে, এই বিদ্রোহের পর দেশে ইসলামিক শাসনতন্ত্র কায়েম করা হবে। অর্থাৎ, সেই ৭১-এর মতই ইসলামের দোহাই দিয়েই ঘটানো হয় এই নৃশংস হত্যাকান্ড। অথচ, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, ৩ ছেলে এবং ২ পুত্রবধূকে বনানী গোরস্থানে দাফন করা হয় রক্তাক্ত কাপড়েই। ইসলামের সিপাহী বলে দাবী করা সেই তথাকথিত মুসলিম ঘাতক চক্র সেখানে কোন জানাজা কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে দেয়নি কাউকেই। বরং কার কবর কোনটা, সেটাও চিহ্নিত করে রাখেনি তারা।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে কোথায় কবর দেয়া হবে, এই নিয়ে খুনীদের সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় এক দিন আর এক রাত লেগে যায়। মুজিবকেও তারা বনানীতে কবর দিতে চেয়ছিল। কিন্তু এখানে জাতির পিতার লাশ দাফন করলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে এমন আশংকা করে তারা। এ প্রসঙ্গে কে এম শফিউল্লাহর ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গ’- গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর কবর, জানাজা- এসব নিয়ে প্রথম চিন্তা করেন, মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। তিনি তখন বঙ্গভবনে বন্দী অবস্থায় ছিলেন অনেকটা। তিনি খন্দকার মোসতাককে বঙ্গবন্ধুর দাফন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, সেই বিশ্বাসঘাতক বলেন, ‘রাস্তাঘাটে তো কতো মানুষ মারা যায়, তাদের সবার দিকে দিকে কি আমার খেয়াল রাখতে হবে? গ্রেভ হিম এনি হোয়ার, বাট নট ইন ঢাকা।’
তখন তিনি ও এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ঠিক করেন যে বঙ্গবন্ধুকে তার বাবা মায়ের পাশে শায়িত করা হবে। খালেদ মোশারফকে তিনি ব্যাবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন কাজটা করতে। ১৬ই আগস্ট, হত্যাযজ্ঞের পরেরদিন ১ জন মেজর, ১ জন লেফটেন্যান্ট ও কিছু সৈন্যসহ মুজিবের লাশ হেলিকপ্টারযোগে টুঙ্গিপাড়া পাঠানো হয়। তারা গ্রামের পেশ ইমামকে ডেকে পাঠায় এবং জিজ্ঞাসা করে গ্রামের লোকজন কি শেখ মুজিবের লাশ দাফন করতে চায় কি না? তারা উত্তর দেয়, যদি মরদেহ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় তবে তারা দাফন করতে রাজি আছে। গ্রামবাসীদের বলা হয়, তাদেরকে মুজিবের কবর ছাড়াও আরো ১০-১২টি কবর খুঁড়তে হতে পারে, কিন্তু আপাতত ১ টা কবর রেডি করতে হবে।
দুপুর আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর কয়েকজন শেখ মুজিবের লাশ নিয়ে যায় সেখানে। সাথে পুলিশের একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় গোপালগঞ্জের উপ-বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট। একজন মেজর বঙ্গবন্ধুর দেহটি কোনরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কবরে নামিয়ে রাখতে চায়।
রজব আলী, যিনি পঁচাত্তরে রেডক্রস অফিসে পিয়নের চাকরি করতেন তিনিসহ অন্যান্য গ্রামবাসীরা জোর প্রতিবাদ জানান। তিনি তাঁর এক সাক্ষাতকারে বলেন– ‘১৬ আগস্ট মিয়া ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) টুঙ্গিপাড়ায় আনা হয়। কবর খোঁড়া, লাশ দাফনের জন্য লোকের প্রয়োজন হয়। আমি এগিয়ে যাই। কবর খুঁড়ি। লাশের সঙ্গে আসা মিলিটারিরা মিয়া ভাইকে মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি প্রতিবাদ জানাই। তাদের বলি, মিয়া ভাইকে ইসলামী বিধিবিধান মতো দাফন-কাফন করতে হবে।’
সেনাবাহিনীর লোকজন গ্রামবাসীকে মৃতদেহ দেখতে দিতে চায় না। ভয়ে সম্ভবত। গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ করে ‘আমাদেরকে অবশ্যই মৃতদেহ দেখতে দিতে হবে।’ মেজর ইতস্তত করে জানতে চায় – ‘আপনারা কি লাশ না দেখে কবর দিতে পারেন না?’ তখন মৌলভী শেখ আব্দুল হালিম বলেন, ‘আমরা সেটা করতে পারি, যদি আপনারা তাকে শহীদের মর্যাদা দেন’। তিনি আবার প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কি তার দাফন কাফন ইসলামিক আইন অনুযায়ী করতে চান না?’ সেনাবাহিনীর লোকজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তাদের উপর পরিষ্কার নির্দেশ ছিল – গ্রামবাসী যেন কোন অবস্থাতেই মুজিবের লাশ দেখতে না পায়। কিন্তু একজন মুসলমানকে ইসলামী আইন অনুযায়ী কবর দেওয়া না হয়, তাহলে সেখানে বিদ্রোহের সৃষ্টি হতে পারে, এই ভেবে মেজর দাফন-কাফন সম্পন্ন করার নির্দেশ দিল, সাথে যোগ করল – এসব করতে হবে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতেই।
কফিন খোলা হলো। কফিন খুলতে কাঠমিস্ত্রি ডাকতে হল। কফিন খুললেন কাঠমিস্ত্রি আইয়ুব আলী। তাঁর ভাষায় বঙ্গবন্ধুর মুখটি মলিন হয়নি তখনো, কিন্তু দেহ ছিল বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত এবং বরফ ভরা কফিনটি ছিল রক্তস্নাত। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে কফিনটির ঘিরে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন। প্রতি মুহূর্তেই আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে শতশত মানুষ ভিড় করছিল। তাদেরকে লাশের সামনে পৌঁছুতে বাধা দেওয়া হলো, যারা দাফনের কাজ করছিল, তারা কয়েকজন ছাড়া কাউকেই দেখতে দেয়া হলনা পিতার মুখ। কিন্তু যে কোন মুহূর্তে তারা বাধা ভেঙে এগিয়ে আসতে পারে, এজন্য প্রথমে এক লেফটেন্যান্ট চিৎকার করে উঠল এই বলে– ‘জলদি করুন, কি হল’? এরপর সেই মেজর হুংকার দিল, ‘আপনাদের আর পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হল।’
বঙ্গবন্ধুকে তাঁর গ্রামের বাড়ীর বারান্দাতে নিয়ে যাওয়া হল। ‘বুকে ছিল তার চব্বিশটি গুলি। ডান হাতের তালুতে একটি। বাঁ পায়ের গোড়ালির পাশে একটি। দুই রানের মধ্যখানে দুইটি গুলি। গোসলের আগে তার গায়ের গেঞ্জি, পাঞ্জাবী, প্লেকার্ড লুঙ্গি, পাঞ্জাবীর পকেটে রুমাল, তামাকের কৌটা, পাইপ, একটি তোয়াইলা, একটি চাদর, এগুলি পাওয়া যায়। জিনিসগুলি ধুয়ে যত্ন কইরা রাখি। ধুইতে গিয়া খালি গেঞ্জিটা হারাইয়া ফেলি।’ কথাগুলো বলেছেন আব্দুল মান্নান শেখ। বঙ্গবন্ধুর কবর খুঁড়েছিলেন এই ব্যক্তি। গোসলও করিয়েছিলেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে ঐ মুহূর্তে কেউ ছিলেন না, আশেপাশের সকল দোকান পাটও বন্ধ। বঙ্গবন্ধুকে আরো একজন যিনি গোসল দিয়েছিলেন, সেই ইদ্রিস আলী একটা ৫৭০ সাবান জোগার করলেন গোসল করানোর জন্য। কিন্তু করা গেলো না গরম পানির ব্যবস্থা। বাড়ির পাশের পুকুর থেকে গ্রামবাসীরা বালতি ভরে গোসলের পানি তুলে আনলেন। ইদ্রিস আলীর ভাষায়, গুলিগুলো বের হয়ে আসছিল গোসল করানোর সময়। সেগুলো তিনি শরীরের ভিতরে ঠেলে ঠেলে ঢুকিয়ে দেন আবার। সমস্ত রক্তের দাগ পরিস্কার হওয়ার আগেই মেজর চিৎকার করে উঠে– ‘জলদি করুন আপনারা। আর কত সময় লাগবে আপনাদের।’
জাতির জনকের জন্য কেনা হয় না কাফনের কাপড়। তাঁর পরিবর্তে শেখ মুজিবের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত শেখ সাহেরা খাতুন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের রিলিফের জন্য রাখা শাড়ি দিয়ে বানানো হয় কাফন। কাফন সেলাই করার সময়টুকুও গ্রামবাসীকে দেয়া হয় না। জানাজা হবে কিনা এমন প্রশ্নে মেজর সম্মতি জানালেও তারা কেউ জানাজায় অংশগ্রহন করে না। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে অল্প কয়েকজন মানুষ নিয়ে জানাজা শেষে শেখ মুজিবকে তাঁর পিতার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। আনুমানিক ৩৫ জন লোক উপস্থিত ছিলেন বাংলার এই সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার জানাজায়।
এ বিষয়ে, রজব আলী বলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর যখন দাফন কাফন চলছিল তখন এতে অনেক সাধারণ মানুষ শরিক হতে চাচ্ছিল, কিন্তু আর্মিরা প্রচণ্ড বাঁধা দেয়। তারা ভাবছিল বেশি মানুষ এসে যদি লাশ ছিনিয়ে নেয়! সেদিন মানুষ যেমন আর্মিদের ভয় পাচ্ছিল, আর্মিরাও ভয় পাচ্ছিল সাধারণ মানুষদের, কখন জানি তারা ক্ষেপে ওঠে!’ একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুর পর যে রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার কথা ছিল, সেটা বঙ্গবন্ধু পাননি। দাফন শেষ হওয়ার পর আর্মি অফিসাররা সারিবদ্ধ হয়ে তাকে তিনবার স্যালুট করে চলে যায়। আর্মিরা যে ভয় পাচ্ছিল সেটা বুঝতে পারা যায়, কর্ণেল কাজী হায়দার আলীর বক্তব্য থেকে। তিনি সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
তিনি লিখেছেন- ‘হেলিকপ্টারের মধ্যে কারো মুখে কথা নাই, সবাই হয়তো আমার মতোই ভাবছিল, এই কঠিন দায়িত্বে আল্লাহ কেন আমাদের সোপর্দ করলেন? দায়িত্ব পালন করে নিজেরা ফিরতে পারবো কি? দেশের প্রেসিডেন্টের মৃতদেহ তাঁর বাড়িতে যাচ্ছে, লোকেরা কতো কিছু জিজ্ঞাসা করবে, তার জবাব কী দেব? সবাই মনে করবে আমরাই এই অঘটন ঘটিয়েছি, তখন লোকাল এরিয়া থেকে পাল্টা আঘাত আসতে পারে, নিজেরা সামলে ফিরে আসতে পারবো কি?’
না, একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন যে মানুষটি বাঙালি জাতিকে দেখিয়েছিলেন, যে মানুষটির স্বত্তার সাথে মিশে ছিল বাংলার মানুষ, যে মানুষটি সবকিছুর আগে প্রাধান্য দিয়েছিলেন বাংলার মানুষকে, যিনি এই বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করে জেলে কাটিয়েছেন ৪৬৮২ টি দিন, সেই মানুষটির জানাজায় বাংলার মানুষকে শরিক হতে দেয়া হয়নি। সারা দেশে কারফিউ জারি করে কেড়ে নেয়া হয়েছিল শোক প্রকাশের স্বাধীনতাটুকুও। বাংলার মানুষের চোখ সেদিন পাথর হয়ে গিয়েছিল শোকে।
নাহ, বঙ্গবন্ধুর মহিমা, তাঁর অবদান, প্রকাশের জন্য লোক দেখানো লক্ষ মানুষের জানাজায় শো-ডাউন দরকার ছিল না কখনোই। পিতাকে এ দেশের মানুষ ধারণ করেছে তাদের অস্তিত্বে। খুনিরা জানত না, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ একটি চেতনার নাম, যাকে খুন করে মিটিয়ে ফেলা যায় না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন ততদিন যতদিন এই পৃথিবীতে উচ্চারিত হবে একটি নাম ‘বাংলাদেশ’।
লেখক: ফারজানা ইয়াসমিন অপরাজিতা, অনলাইন এক্টিভিস্ট।