‘সুবর্ণগ্রাম’ এর রূপকথা
২১ আগস্ট ২০১৮ ১৭:৪৩
||অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)||
সে অনেক কাল আগের কথা। ত্রি-নদী বিধৌত ব-দ্বীপে বঙ্গীয় উপসাগরের কোল ঘেষে ছিল একটা সুখী জনপদ। নাম তার ‘সুবর্ণগ্রাম’। কবিরা যেমন লিখে গেছেন ঠিক তেমনি সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা একটি জনপদ। সুখী মানুষদের বসবাস সেখানে। কিন্তু সুবর্ণগ্রামে সুখ কেন যেন দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
দফায় দফায় ভীনদেশি দস্যুরা সুবর্ণগ্রামে হামলা করে লুটপাট করেছে তার রত্নভাণ্ডার। সুবর্ণগ্রামের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে বারবার। প্রতিবাদী হয়েছে, গড়ে তুলেছে প্রতিরোধও। তাতে বিদেশি লুটেরারা পালিয়েছে ঠিকই কিন্তু সুবর্ণগ্রামের মানুষের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কারণ সুবর্ণগ্রামেরই কিছু লোক বিদেশি লুটেরাদের সাথে হাত মিলিয়েছে। নামেই শুধু সুবর্ণগ্রামের শাসনভার নিজ গ্রামের লোকের হাতে, কাজে সব কিছু একেবারেই উল্টো।
সুবর্ণগ্রামের এই দালালগুলো আসলে বিদেশি লুটেরাদের চেয়েও খারাপ। দেশের সম্পদ তারা হেসেখেলে তুলে দেয় ভিনদেশি দস্যুদের হাতে। এদের হাতে খুন হয়েছেন সুবর্ণগ্রামের মহারাজও। বড় ভাল মানুষ ছিলেন এই মহারাজ। নিজের কথা ভাবেননি কোনদিনই। শুধু সুবর্ণগ্রাম আর সুবর্ণগ্রামের সুখি মানুষগুলোর মুক্তি আর ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। তারপর একদিন এলো সেই কালোরাত। সপরিবারে নিহত হলেন মহারাজ। নিহত হলেন মহারাণী আর যুবরাজরাও। যা করতে পারেনি বিদেশি দস্যুরা, তাই করলো সুবর্ণগ্রামেরই কিছু কুলাঙ্গার। সুবর্ণগ্রামের মানুষরা যা কোনদিনও কল্পনাতেও আনেনি তা-ই তাদের অসহায়ভাবে মেনে নিতে হলো।
মহারাজের প্রয়াণের সাথে সাথে অন্ধকারে তলিয়ে গেল সুবর্ণগ্রামের সুখি মানুষগুলোর বর্তমান আর ভবিষ্যত। অরাজকতার মহা তা-বে সুবর্ণগ্রামের সুখি মানুষগুলোও যখন হাসতে প্রায় ভুলতে বসেছে তখনি আশার কথা শোনালেন রাজ জ্যোতিষী। মহারাজের আস্থাভাজন জ্যোতিষীর আশ্বাসেও সুবর্ণগ্রামের মানুষ যেন আস্থা পেতে আর আস্থা পায় না। কিন্তু শেষমেষ রাজ জ্যোতিষীর ভবিষ্যতবাণীই সত্যি প্রমাণিত হলো। হাঙ্গর আর কুমিরে ভরা মহাসমুদ্র পারি দিয়ে সুবর্ণগ্রামের বন্দরে ঠিকই একদিন নোঙ্গর করল মহারাজের শেষ বংশধর আর তাদের অনুসারীদের নৌবহর। পরাজিত হলো দেশীয় দালালের দল।
তারপরের ইতিহাস শুধুই আনন্দের আর উন্নয়নের। মহারাজের বংশধর আর তাদের অনুসারীদের সুশাসনে শনৈ-শনৈ উন্নতি হতে লাগলো সুবর্ণগ্রামের। আশেপাশের দু’দশ গায়ের লোক ভাবে, ‘এও কি সম্ভব’? তারাতো বটেই, এমনকি দুর-দুরান্ত থেকেও রাজন্যবর্গ আর রাষ্ট্রদূতগণ দেখতে আসেন সুবর্ণগ্রাম, শিখতে চান সুবর্ণগ্রামের সাফল্য থেকে। তাদের সবার লক্ষ্য একটাই – তাদের গ্রামটাও যদি সুবর্ণগ্রাম হয়ে যেত।
কিন্তু ঐ যে কথায় আছে- চোরায় কোনদিনও শোনেনি ধর্মের বাণী। সুবর্ণগ্রামের ষড়যন্ত্রীদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হবে কেন? উপরে উপরে শান্তি থাকলেও সুবর্ণগ্রামের সুখী মানুষগুলো শান্তিতে নেই। বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় আবারো ঘোট পাকাচ্ছে বিদেশি দস্যুদের দেশীয় দালালরা। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে বিদেশি দস্যুরাও। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সামনে মহারাজের বংশধররা জনগণের সামনে তুলে ধরবেন সুবর্ণগ্রামের ভবিষ্যত নিয়ে তাদের যত সুন্দর সুন্দর ভাবনাগুলো। সুবর্ণগ্রামের রাজপ্রাসাদের পাশেই যে বড় ময়দানটা সেখানেই হবে লক্ষ মানুষের জমায়াত। হাত তুলে সবাই সমর্থন জানাবে আর এর উপরই নির্ভর করছে সুবর্ণগ্রামের আগামীদিনের পথচলা। শোনা যাচ্ছে বিদেশি ও দেশীয় দালালরা এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চাচ্ছে। যে কোন মূল্যে তারা এই আয়োজনটা প- করে দিতে চায়। আর এজন্য তারা নেমেছেও আটঘাট বেধেই। দেশে-বিদেশে প্রতিনিয়তই চলছে ষড়যন্ত্র। তারা খুব ভাল করেই জানে এটাই তাদের শেষ সুযোগ। এবার যদি তারা ব্যর্থ হয়, সুবর্ণগ্রামকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
সুবর্ণগ্রামের সুখি মানুষদের এ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তারা জানে উপরে উপরে ভদ্র হলেও এই লোকগুলো ভেতরে ভেতরে নেকড়ের চেয়েও হিংস্র। এরই মাঝে আবারো আশার কথা শোনাচ্ছেন রাজ জ্যোতিষী। বলছেন সুবর্ণগ্রামের সুখি মানুষগুলো যদি সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয় তাহলে কোন ষড়যন্ত্রেই কোন কাজ হবে না। সুখি মানুষদের জয় হবেই হবে। চুড়ান্ত পরাজয় হবে দেশীয় দালালদের। আর আবারো উৎসবে মাতবে সুবর্ণগ্রামের সুখি মানুষগুলো।
রাজ জ্যোতিষীর কথায় অনেকে আস্থা পেলেও, আস্থা পান না অনেকেই। জ্যোতিষী বলেছেন তার এই ভবিষ্যতবাণী টেরাকোটার শিলালিপিতে উৎকীর্ণ করে দিতে রাজপ্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে। সহস্র শ্রমিকের সযত্ন ছোয়ায় শেষ হয়েছে সেই কাজটি। এখন সবার প্রতীক্ষা রাজ জ্যোতিষীর ভবিষ্যতবাণী আরো একবার ফলে যায় কিনা।
কৈফিয়ত: গ্রীষ্মের প্রখর রোদে কান্তজীর মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দেখতে দেখতে এই রূপকথার অবতারণা। বাস্তবের কোন কিছুর সাথে এর সামান্য মিলটিও দৈবচয়ন মাত্র।
সারাবাংলা/এমএম