গো ব্লু ড্রেস গো… জয় হোক মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার
২৩ আগস্ট ২০১৮ ১৪:৫৮
||মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক||
ক্যাসি সেমিয়নকে ধন্যবাদ। তার একটি দৌড় অনেক কিছু স্পষ্ট করে দিয়েছে। আমরা যারা রিয়েলটাইম জার্নালিজম প্র্যাকটিস করি তাদের জন্য এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
গত দেড় দশক ধরে এই রিয়েলটাইম জার্নালিজমের সঙ্গে রয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াচ্ছি গত পাঁচ বছর। সব সময়ই একটা প্রশ্নের সম্মুখিন হই- দ্রুত খবর দেওয়ার জন্য কী কী করতে হবে?
অনেককেই বলি, ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের এবং অফিসে কলিগদেরও… একটু গায়ে গতরে শক্ত-সমর্থ্যও হওয়া দরকার এই সাংবাদিকতার জন্য। অনলাইনে কিংবা ২৪-ঘণ্টা খবরের টেলিভিশনগুলোতে যারা কাজ করেন তারা এই বিষয়টি সহজে ধরতে পারবেন। একটি নিউজ ব্রেক করার জন্য তাদের সত্যিই একটি দৌড় দিতে হয় এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বিষয়টি এমন।
এও বলি, ধাক্কাধাক্কি করে, কনুইয়ের গুঁতোয় অন্যকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারলেই সবার আগে খবরটি পাওয়া যায় এবং দেওয়াও যায়। এতদিন বিষয়গুলো থিওরিটিক্যালি কিংবা মুখে বলতে হতো… এবার একটা প্র্যাকটিক্যাল উদাহরণ মিললো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক ক্যাম্পেইন প্রধান পল ম্যানাফোর্টের বিরুদ্ধে মিথ্যা ট্যাক্স ফাইলিং ও ব্যাংক প্রতারণার অভিযোগের বিষয়ে রায় দেন ভার্জিনিয়ার আলেক্সান্দ্রিয়াস্থ আদালতের বিচারক। সে রায়ে ম্যানাফোর্ট দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। খবরটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গত মঙ্গলবারের (২১ আগস্ট) ওই ঘটনায় অনেক সংবাদমাধ্যমের টপ হেডলাইনে উঠে এলেন ক্যাসি সেমিয়ন ও সঙ্গে তার নীল রঙের পোশাক।
সেমিয়নকে (প্রথমে অবশ্য জানা যায়নি মেয়েটি কে?) দেখা যাচ্ছিলো আদালত ভবনের দরজা ঠেলে এক ঝটকায় বেরিয়ে এলেন আর দিলেন একটা ভো দৌড়। আদালতের সামনে যে ফটোসাংবাদিকরা দাঁড়িয়েছিলেন, ক্যামেরা তাক করে, তাদেরই একজন জ্যাকুলিন মার্টিনের ক্লিকে ধরা পড়লো নীল ড্রেস পরা মেয়েটির দৌড়। পুরোপুরি অ্যাথলেটের ভঙ্গিমা। ভিডিও চিত্রও ধরা পড়লো বিভিন্ন চ্যানেলের ভিডিও ক্যামেরায়। কে এই মেয়েটি? সে শিরোনামে মূলধারার সংবাদমাধ্যম হাজির করলো খবর। আর সোশ্যাল মিডিয়ারতো কথাই নেই।
ক্যামন ছিল দৌড়টি দেখুন এখানে-
https://twitter.com/i/status/1032004898114752518
পরে ক্যাসি সেমিয়ন নিজেই জানালেন টুইট করে- হ্যাঁ আমিই ছিলাম সেই নীল পোশাক পরা সংবাদকর্মী। ছবিটি তোলার জন্য জ্যাকুলিন মার্টিনকে ধন্যবাদ দিতেও ভুললেন না তিনি। আর হ্যাশট্যাগ চালু করলেন #GoBlueDressGo নামে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে খবর সংগ্রহের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ২০১৩ সালের ০৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ফেডারেল আদালত দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় বাংলাদেশি তরুণ কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেন। সেদিন সেই আদালতের রায়ের খবর দিতে এমন একটি দৌড় আমি নিজেও দিয়েছিলাম। ফেডারেল কোর্টের বাইরে রাখা মোবাইল ফোনটি তুলে সবার আগেই হাপাতে হাপাতে খবরটি পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম ঢাকায়। সেদিন আমেরিকান তথা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা আমার পেছনে দৌড়েছিলেন কী না জানি না। কারণ এমন সময়ে পেছনে ফিরে দেখার সময় থাকে না। তবে কোর্টের বাইরে যখন নিজের সংবাদমাধ্যমে খরটি দিয়ে চারিদিকে তাকালাম, দেখলাম সংবাদকর্মীরা সকলেই যার যার ফোনে ব্যস্ত। রায় ঘোষণার মাত্র কয়েক মিনিটের মাথায় তখন ঢাকায় খবরটি প্রকাশ করাও সম্ভব হয়েছিলো। যা নিমিষেই ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমেও।
সুতরাং আদালতের খবর যারা সংগ্রহ করেন, তাদের জন্য এই ঘাম ছোটানো দৌড়টি অবধারিত।
ঢাকায় যারা আদালত পাড়ার সংবাদকর্মী তাদের জন্যও এটি এক নিয়মিত চর্চা। তারাও কিন্তু এভাবেই দৌড়ে আদালতের বাইরে এসে তবেই খবরটি দেন।
আদালত ভবনে মোবাইল ফোন কোনওভাবেই অ্যালাওড নয়। ফোন আপনাকে রেখে যেতে হবে বাইরে। সুতরাং প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে আদালতের কোনও সিদ্ধান্ত আপনি দ্রুত জানিয়ে দেবেন তেমনটা হবার নয়।
ঢাকায় উচ্চ আদালতের, আপিল বিভাগের, ট্রাইব্যুনালের ও নিম্ন আদালতের খবরগুলো সংবাদকর্মীরা এভাবেই দেন। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাদের একটি দৌড় লাগাতে হয়।
আলেক্সান্দ্রিয়ার আদালতে মঙ্গলবার কেবল যে সেমিয়ন ক্যাসি দৌড়িয়েছেন তা নয়, অন্য মিডিয়ার সংবাদকর্মীরাও একইভাবে দৌড়ে বের হয়েছেন। সেমিয়ন সবার আগে বের হয়েছিলেন বলে মূল খবরে তার কথাটিই বেশি চাউড় হয়েছে। তবে অন্যদের দৌড়ানোর ছবিও ধরা পড়েছে ফটো সাংবাদিকদের ক্যামেরায়।
এ দৃশ্য দেখে এমি অ্যাওয়ার্ডজয়ী আমান্ডা হোল্ডেনের টুইটটি ছিল বেশ মজার-
‘আমার মনে হচ্ছে সবচেয়ে স্মার্ট মিডিয়াগুলো তাদের সবচেয়ে দক্ষ অ্যাথলেট রিপোর্টারকেই ম্যানফোর্ট বিচারের রায়ের খবর সংগ্রহে পাঠিয়েছিল।’
আরেক টুইটে তিনি একটি ভিডিও শেয়ার করে বলেছেন- ‘আমার মনে হচ্ছে এটা সত্যিই একটা রিলে রেস ছিল।’
চব্বিশঘণ্টার সংবাদমাধ্যমে এই খবর পরিবেশনা সত্যিই একটা রিলে রেস। ওই যে ক্যাসি সেমিয়ন সবার আগে দৌড়ে সবার আগে খবরটি তার হাউজে পৌঁছে দিলেন, তখন তার নিউজরুমকেও করতে হয় একই ধরনের আচরণ।
এমন একটি খবর নিউজরুমে ঢোকা মানেই হচ্ছে গোটা নিউজরুমে একটা ফায়ারআপ (হঠাৎ জ্বলে ওঠা)’র মতো ঘটনা ঘটে। তখন খবরটি দ্রুত অনলাইনে কিংবা যে যার মিডিয়ায় দ্রুত প্রকাশ কিংবা প্রচারের ব্যবস্থা নিলেই এগিয়ে থাকা সম্ভব। আর এই এগিয়ে থাকাটাই হচ্ছে প্রতিদিনকার চ্যালেঞ্জ। অথবা বলা চলে প্রতি মূহূর্তের চ্যালেঞ্জ। সুতরাং এই রিলে রেসের ফিনিশিং লাইনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম দৌড়টিও।
সত্যি কথা বলতে কি! ক্যাসি সেমিয়ন কিন্তু বাস্তবেও একজন দৌড়বিদ। সেকথাও তিনি জানিয়েছেন টুইটে। সেমিয়ন লিখেছেন- ক্রসকান্ট্রি রানিং-এর সেই দিনগুলোর কথা মনে করে আজ বেশ ভাল লাগছে।
ক্রস কান্ট্রি রানিং এক ধরনের দৌড় যাতে দৌড়বিদরা টানা ৪ থেকে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়ান। এই দৌড়ের পথটাও খুব একটা সহজ নয়। কোথাও বড় বড় ঘাঁষের মধ্য দিয়ে, কোথাও কাদামাটি পেরিয়ে আবার কোথাও বন-জঙ্গল পেরোতে হয় এই দৌড়ে। তেমনই এক দৌড়বিদ ছিলেন ক্যাসি সেমিয়ন।
এক সময়ের দৌড়বিদ এই সংবাদকর্মী মূলত একজন ইনটার্ন (শিক্ষানবীস সংবাদকর্মী) । কাজ করেন মাল্টি-মিডিয়া রিপোর্টার হিসেবে। এনবিসি নিউজ ও মিশেলরিপোর্টস’র জন্য কাজ করছেন। এর আগে তিনি ইনটার্ন হিসেবে কাজ করতেন এবিসি নিউজের সাথে। এনবিসি তো এই ঘটনায় ভীষণ খুশি। তারা এখন এই শিক্ষানবীস সংবাদকর্মীর জন্য রীতিমতো গর্বিত।
ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর) এর স্পেলাশ করেসপন্ডেন্ট মেলিসা ব্লক’র কথাটিও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি টুইটে লিখেছেন- আদালত কক্ষে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ ছিলো… সুতরাং খবর এসেছে ক্ষিপ্রগামী পায়ে।
আর ইউএসটুডের পলিটিক্যাল রিপোর্টার এলিজা কলিন্স লিখেছেন- যাদের দৌড়াতে দেখছেন ওরা সংবাদকর্মী। আদালত কক্ষে কোনও ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস অ্যালাওড ছিলো না, সুতরাং রিপোর্টারদের দৌড়াতেই হয়েছে।
মিউজিক অ্যান্ড স্পোর্টস ফটোগ্রাফার জাস্ট কোনোর লিখেছেন- এই ছবিগুলোতে যে সংবাদকর্মীদের দৌড়তে দেখছি তাদের প্রত্যেকেরই পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া উচিত।
তা পুলিৎজার জিতুন কি না-ই জিতুন… দ্রুত খবর পরিবেশনায় সাংবাদিকদের এভাবেই দৌড়তে হবে, যাতে সবার আগে খবরটি নিজ নিজ সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন। বিশেষ করে ক্যাসি সেমিয়নের মতো যারা মাল্টি-মিডিয়ায় কাজ করেন তাদের জন্য এর কোনও বিকল্প নেই।
আচ্ছা- মূল খবরটিই তো জানানো হলো না। ওই রায়ে ডোনান্ড ট্রাম্পের ক্যাম্পেইন প্রধান তার বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা ট্যাক্স ফাইলিং ও ব্যাংক প্রতারণার আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর। সুতরাং এ খবর সবার আগে দিতে পারাটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সুতরাং গো ব্লু ড্রেস গো… জয় হোক মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার।
সারাবাংলা/এমএম
আমান্ডা হোল্ডেন ক্যাসি সেমিয়ন গো ব্লু ড্রেস গো মাল্টিমিডিয়া যুক্তরাষ্ট্র আদালত যুক্তরাষ্ট্র সাংবাদিক সাংবাদিকতা