Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কূটনীতি যখন অবন্ধু-বৎসল


২৬ আগস্ট ২০১৮ ১৫:১৭

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

||সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা||

রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। সেই বন্ধুত্ব প্রয়োজনের সময় সত্যিকারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। গত এক বছর ধরে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী সামলাতে গিয়ে বাংলাদেশ দুটি বিষয় বেশ ভালভাবে বুঝেছে – এক. সম্পর্ক যার সাথে ভাল তার কাছ থেকে হৃদ্যতা থাকা প্রত্যাশিত হলেও কূটনীতি বিষয়টা প্রত্যাশার শৃঙ্খলের ধার ধারে না। দুই. কূটনীতি জিনিসটা বড় নির্দয়। বন্ধুত্বের চেয়ে, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থই বেশি তাড়িত করে একটি দেশকে। এই স্বার্থের পৃথিবীতে তাই বন্ধুর বিপদেও পাশে দাঁড়ানোর তাড়না থাকেনা।

বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গা নামক সংকটটি গত এক বছরে একটি বার্তা এই পৃথিবীকে দিয়েছে, নৈতিকতা, মানবিকতার মতো বিষয়গুলি নিয়ে যতই উদ্বেগ থাকুক, দেশ সমূহের কাছে সেটা গৌণ ব্যাপার। মিয়ানমার প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং দেশটির ভূ-কৌশলগত অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি যেমন এক দিকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে, অন্যদিকে এটি ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরেরও একটি দেশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে স্থলপথে সংযোগ স্থাপনের যেকোন প্রচেষ্টা মিয়ানমারের উপর দিয়ে হতে হয়। দেশটির সঙ্গে স্থল-সীমান্ত সম্পর্ক রয়েছে ভারত, চিন, বাংলাদেশ, লাও ও থাইল্যান্ডের। এ রকম একটা দেশকে নিয়ে এশিয়ার দুই উদীয়মান শক্তি, চিন ও ভারতের টানাপড়েন চলছে। ভারত মূলত ছুটেছে সেই স্বার্থের টানেই, যদিও কিছুটা শান্তনার বাণী তারা বাংলাদেশের জন্য রাখার চেষ্টা করেছে।

ভারত প্রতিবেশী, হৃদ্যতায় পরিপূর্ণ এখন দুই দেশের সম্পর্ক। রাশিয়া আমাদের যুদ্ধকালীন সময়ের বন্ধু। আর চীনের সাথে এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অথনৈতিক দহরম মহরম। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে সীমিত সম্পদের বাংলাদেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থেই হিমশিম খাচ্ছে। বন্ধু ভারত, চীন ও রাশিয়া তবুও মিয়ানমারেরই পাশে দাঁড়ালো, বাংলাদেশের নয়।

বিজ্ঞাপন

কূটনীতি নির্দয়, কিন্তু কূটনীতিতো বিবেচনাবোধও। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের জন্য এই দেশগুলোর সেই বিবেচনার প্রকাশ পাওয়া গেলোনা।
শুরু থেকেই রোহিঙ্গা সমস্যাকে মিয়ানমারের ‘অভ্যন্তরীণ সংকট’ বলে অভিহিত করেছে চীন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চীনের এই অবস্থান যতটা না বর্তমান সরকারকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিপদে ফেলেছে, তার চেয়ে বেশি ফেলেছে ভারতের অবস্থান। ভারত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও সু চি-র নিন্দা করেনি, বরং তাদের পাশে থাকার কথা বলেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায় ভারত। কারণ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ভৌগোলিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম মিয়ানমার। আবার, উত্তর-পূর্ব ভারতের যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি মিয়ানমারের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়, তাদের দমন করতেও দিল্লির দরকার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সহায়তা। মিয়ানমারে ভারত বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। রাখাইন রাজ্যের সিত্তুই-এ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে ভারত। ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ‘এশিয়ান ট্রাইল্যাটরাল হাইওয়ে’ নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতের। এটি মায়ানমারের মাধ্যমে মিজোরাম ও থাইল্যান্ডকে সংযুক্ত করবে। রয়েছে কালাদান বহুমুখী প্রকল্প এবং সড়ক ও নদীপথে পণ্য পরিবহণের পরিকল্পনা। ভারতের নেতৃত্বে ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনমিক কোঅপারেশন’ (বিমসটেক)-এরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ মিয়ানমার। ২০১৫-১৬ সালে ভারত-মায়ানমার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ২.০৫ বিলিয়ন (২০৫ কোটি) ডলার। অনুমোদিত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ৭৩০ মিলিয়ন (৭৩ কোটি) ডলার। ২২টি ভারতীয় কোম্পানি এই অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

বোঝাই যাচ্ছে ভারত তার স্বার্থকেই বড় করে দেখেছে, বংলাদেশের সাথে দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্বকে বিবেচনায় না নিয়ে। প্রশ্ন অবশ্য আছে, বাংলাদেশের সঙ্গে কি তার কোন স্বার্থই নেই?

পৃথিবীর ৬৮টি দেশকে যুক্ত করে যে বিশাল ও অতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প চীন হাতে নিয়েছে, মিয়ানমার তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত রাখাইন অঞ্চলেই সে গড়ে তুলছে একটি সমুদ্রবন্দর, এখান থেকে সংগৃহীত গ্যাস-তেল সরাসরি রফতানি হবে চীনে। পশ্চিম এশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির জন্য ব্যস্ত মালাক্কা প্রণালী এড়াতে এখানেই নির্মিত হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত তেল ও গ্যাস পাইপলাইন। চীনের মদতে একটি মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনাও নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। রাখাইন রাজ্যের কিয়ুকপিয়ুতে অবস্থিত এই বিশেষ শিল্পাঞ্চলে নির্মীয়মাণ বন্দরের মাধ্যমে মায়ানমারে বেজিংয়ের নৌ-উপস্থিতি আরও প্রবল হবে। অস্ত্র, খাদ্যশস্য, বস্ত্র— চীন থেকে মিয়ানমারের আমদানির তালিকাও দীর্ঘ। একটি হিসাবে, ১৯৮৫ থেকে ২০১৫, মায়ানমারে ১২৬টি প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন বা ১৫০০ কোটি ডলার। রাশিয়াও মিয়ানমারে বাণিজ্য সুযোগ খুঁজছে।

মিয়ানমারে চীন ও ভারতের তুলনায় অল্প হলেও অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেরও। তাই তারাও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মৃদু ভর্ৎসনার বেশি কিছু করতে আগ্রহী নয়। ইউএনএইচসিআরের মত সংস্থাগুলোর কাজ হলো শরনার্থীপালা, সমস্যার সমাধান করা নয়।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে গত এক বছর ধরে যে চেষ্টা চলেছে তার দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশের তৎপরতায় মিয়ানমার স্বীকার করেছে এই মানুষগুলো তাদের দেশ থেকে এসেছে। এর বেশি কিছু নয়। দীর্ঘমেয়াদী এই সমস্যার সমাধানে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনীতি জোরদার করে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই আসলে। এক বছর ধরে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের বোঝা চেপে আছে বাংলাদেশের কাঁধে। এই মানুষগুলোর খাবার, স্বাস্থ্য, বাসস্থান সবকিছুই বহন করতে হচ্ছে আমাদের। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের পরিবেশ, স্থানীয় অর্থনীতি। এ সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক শক্তিকেই কাজে লাগাতে হবে বাংলাদেশের। কিন্তু সেই কূটনীতি কোথায়, সেটিই খুঁজছে দেশের মানুষ।

সবাই নিজ নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। একটা দেশে যতই সংগঠিত জাতিগত নিধন চলুক, একুশ শতকের দুনিয়ায় পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করাই কূটনীতির আসল ধর্ম। মানবিকতা নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়? বিশ্ব সম্প্রদায় যেন মানবিবতার পুরো ভার নেয়ার জন্য ভরসার জায়গা একটাই ভাবছে – হাতের কাছে আছে বাংলাদেশ!

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি।

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর