Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তবুও কেন বিদেশমুখি প্রবণতা!


৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৩:৩৭

রেজানুর রহমান ।।

কে কোথায় আছো লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দাও’- একটি মাত্র সংলাপ। কিন্তু এই সংলাপটির মাধ্যমেই কাছের অথবা দূরের পরিবেশ বোঝাতে হবে। দৃশ্যটি এরকম, দূরে কোথাও অন্ধকার একটি গুহার মধ্যে আটকে পড়েছে একটি লোক। যেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অন্যের সাহায্যে চাইছে। চিৎকার করে বলছে ‘কে কোথায় আছো লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দাও’…

’৮০’র দশকে ঢাকায় এসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নাটকের এক কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলাম। প্রথম দিনেই প্রশিক্ষক আমাদেরকে এই সংলাপটি বলতে বললেন। ‘ধরো তুমি অন্ধকার গুহায় আটকা পড়েছো। বাঁচার জন্য সাহায্য চাইবে। কি করতে পার তুমি? চিৎকার করে তোমার অবস্থান জানানো ছাড়াতো কোন গতি নেই। তার মানে তোমাকে এমনভাবে চিৎকার করতে হবে যাতে করে দূরের মানুষ তোমার কথা শুনতে পায়। প্রশিক্ষক একবার দেখিয়ে দিলেন। সংলাপ বলতে গিয়ে প্রথম দফাতেই উতরে গেলাম। হ্যাঁ, আমার এই সংলাপ দূরের মানুষকে আকৃষ্ট করবে। প্রশিক্ষক এবার কাছের মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য সংলাপ বলতে বললেন। ধরো, পাশের রুমেই বসে আছেন কেউ। বাসায় বিদ্যুৎ নেই। কাজেই লণ্ঠন অথবা মোমবাতি জ্বালাতে হবে। এবার সংলাপ বলো। ভাবলাম, এ আর কি এমন কঠিন… হর হর করে সংলাপ বলে গেলাম। কিন্তু সেটা দূরের মানুষকে আকৃষ্ট করার মতোই হচ্ছে। পাশের মানুষকে কোনোভাবেই আকৃষ্ট করতে পারছিনা। প্রশিক্ষক বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছেন তবুও পারছিনা। সংলাপটা কখনও উঁচু লয়ে হচ্ছে। আবার কখনও নীচু লয়ে… শেষ মেষ অতি সহজেই সংলাপটা রপ্ত করতে পেরেছিলাম অবশ্য। ‘অতি সহজ’ শব্দটা ব্যবহার করলাম এই জন্য যে, কাছের মানুষের দৃষ্টি আর্কষণের সময় আমার তেমন কোনো প্রস্তুতি থাকতো না। মনে হতো কাছের মানুষ তো কাছেই আছে। কাজেই তাকে জোরে বলি বা আস্তে বলি সে তো শুনবেই… তাকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার কি আছে? পরে মনে হলো এই ধারনাটা ঠিক নয়। বরং কাছের মানুষের প্রতিই অধিক মনযোগ দরকার। কারণ বিপদে আপদে সেই তো প্রথম এগিয়ে আসে! ভরসা দেয়, সাহস যোগায়…

বিজ্ঞাপন

বহুদিন পর কেন যেন এই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমরা কি কোনো এক অন্ধকার গুহায় আটকে পড়েছি? আমাদের এতো এতো টেলিভিশন চ্যানেল, অসংখ্য সংবাদপত্র, হাত বাড়ালেই নানামুখি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থাকা সত্বেও কেন যেন ‘কে কোথায় আছো লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দাও’ এই সংলাপটিই কানে বাজছে। আমার এক বন্ধুর কাছে প্রসঙ্গটা তুলেছিলাম। সে মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। বরং বলেছে, তুমি হয়তো কোনো কারণে মানসিক যন্ত্রনায় আছো। ডাক্তারের কাছে যাও। ডাক্তারই তোমাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন…

বন্ধু এক অর্থে সঠিক মন্তব্য করেছে। হ্যাঁ, আমি এক ধরনের মানসিক যন্ত্রনায় আছি। সেটা আমার নিজের কারণে নয়। কারণটা সমষ্ঠিগত। যা শুনলে অনেকেই হয়তো বিরূপ মন্তব্য করবেন। কারণটা তাহলে খুলেই বলি।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এবারের ঈদের ছুটি কাটিয়েছি। ঢাকায় ছিলাম ২৫ আগস্ট পর্যন্ত। তারপর সৈয়দপুরে ছিলাম ২৬ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। ঈদ উপলক্ষে আমাদের প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল কেউ ৫ দিন কেউ ৭দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সাজিয়েছিল। কয়েশ নতুন টিভি নাটক, শতাধিক টেলিফিল্ম এর পাশাপাশি সিনেমা, টক শো, গানের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি হরেক রকমের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানতো ছিলই। ঢাকায় বসে পরিচিত ২০টি পরিবারের খোঁজ নিলাম। উদ্দেশ্য, কে কোন টিভি চ্যানেল দেখছে তা জানা। সন্ধ্যে ৭টা থেকে রাত ৯ টার মধ্যে সবার সাথে কথা বলে দেখলাম ২০টি পরিবারের মধ্যে ১৩জনই পাশের দেশের টেলিভিশন চ্যানেল খুলে বসে আছে। অবাক হয়ে তাদের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান বানিয়েছে। তা সত্বেও আপনারা বিদেশে কেন? সকলেরই প্রায় অভিন্ন উত্তর, সুন্দর অনুষ্ঠান কোথায় দেখলেন? সবখানেই তো বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। অনেকটা প্রতিবাদের সুরে তাদেরকে বললাম, আপনারা ভুল করছেন। এবার ঈদে অধিকাংশ টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠানের মাঝখানে সহনীয় মাত্রায় বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল বিরতিহীন নাটকও প্রচার করেছে আপনারা বরং নিজের দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখুন প্লিজ… একজন তো আমার ওপর ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলেন, দেশের টিভি অনুষ্ঠান দেখতে বলেন? কি দেখব? নাটক? ভালো নাটক হতো সেই আশির দশকে, বিটিভিতে। এখন আর ভালো নাটক হয় না। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এই যে আপনি ঢালাও মন্তব্য করলেন, শেষ কবে দেশের কোন টিভি নাটক দেখে আপনার পছন্দ হয়নি? নাটকের নাম বলেন? ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, আমি তো ভাই দেশের টিভি নাটকই দেখিনা।

বিজ্ঞাপন

তাহলে কি করে বুঝলেন, দেশের টিভি নাটক ভালো না? আমার প্রশ্ন শুনে তোতা পাখির মতো শেখানো বুলি আওড়ালেন, সবাই বলে… তাই আমারও ধারনা…
ভদ্রলোকের সাথে আর কথা বলার ইচ্ছে জাগেনি। তবে মানসিক কষ্টের শুরুটা এখান থেকেই।

২৬ আগস্ট সৈয়দপুরে নেমে অবাক হলাম অন্য কারণে। বাংলা ও উর্দু ভাষার মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এই শহরে। অবাঙ্গালীদের অধিকাংশের বাসাবাড়িতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল খোলা নেই। খোলা রয়েছে পাকিস্তানসহ বিদেশী টিভি চ্যানেল। আর অধিকাংশ বাঙ্গালীর ঘরে পাশের দেশের অর্থাৎ ভারতের টিভি চ্যানেলের দৌরাত্ম। সন্ধ্যার পর পাশের দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বস্তাপচা টিভি সিরিয়ালে বুদ হয়ে যায় পরিবারের মা-বোনেরা। পরিচিত বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশ রেখে বিদেশে কেন… সবার অভিন্ন উত্তর, ‘ওদের (পাশের দেশ) অনুষ্ঠান অনেক আকর্ষনীয়। অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপন কম থাকে। তাই ওদের অনুষ্ঠানই দেখি।

যদি তাই হয় তাহলে আমাদের এতো এতো টেলিভিশন চ্যানেলের ভবিষ্যৎ কি? ঈদে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেও যদি আমরা দেশের পুরো দর্শককে দেশমুখি করতে না পারি তাহলে কবে পারব? পাশের দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের গানের রিয়েলিটি শো’র বিজ্ঞাপনে দেখলাম ঢাকার একজন তরুণ গায়ক আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে অহংকারের সাথে বলছে ‘আমি অমুক… গান নিয়ে যাচ্ছি অমুক দেশে… অমুক চ্যানেলে…’

আমার দেশের কোনো তরুণ গায়ক পাশের দেশেল টিভি চ্যানেলে গিয়ে গান গেয়ে বাজিমাত করুক এটা আনন্দের খবর। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যখানে। ওই টিভি চ্যানেলটি অথবা তারমতো আরও কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ভিউয়ার সংখ্যা কিন্তু বাংলাদেশেই বেশী। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন থেকে তারা বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ তাদের দেশে আমাদের অধিকাংশ টিভি চ্যানেল দেখাই যায় না। ছোটো হলেও বাংলাদেশ তো একটি দেশ। একটি দেশ যা পারে না পাশের দেশের একটি বিশেষ এলাকা সেটা কিভাবে পারে? অতীতের সেই সমৃদ্ধ ইতিহাস তো আমরা ভুলতে পারিনা। কলকাতার লোকজন একসময় অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলকে ডিশ এন্টেনা বানিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখেছে। এক সময় আমরাই ছিলাম শ্রেষ্ঠ। অথচ এখন….? ওরা কিভাবে পারল নিজেদেরকে এগিয়ে নিতে? এর একটাই উত্তর, ওরা পরিকল্পনা করে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছে। আর আমরা তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এগুচ্ছি। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। ইদানিং বাংলাদেশের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীই কলকাতায় টিভি নাটক, সিনেমায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে তাদের প্রায় সবাই ওদের সময় নিষ্ঠতার ব্যাপারে কথা বলেন। ‘জানেন ওরা বেশ প্রফেশনাল… সময়ের কাজ সময়ে করতেই অভ্যস্ত। কলটাইমের একটু এদিক সেদিক হলেই বাঁধে বিপত্তি…। যারা কলকাতার প্রশংসা করেন তাদেরই অনেকে ঢাকায় শুটিং এর ক্ষেত্রে কলটাইম এর তোয়াক্কা করেন না। বরং কলটাইমের কথা বললেই বিরক্ত হন।

কে কোথায় আছ লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দাও’ বলে লেখাটা শুরু করেছিলাম। আবারও সেই আকুতিই করি। আমাদের গোটা সাংস্কৃতিক অঙ্গন বিশেষ করে টিভি নাটক, চলচ্চিত্র, গান বোধকরি একটা অন্ধকার গুহায় আটকে পড়েছে। আলো চাই আলো… দেশ প্রেমের আলো… এখানে নির্মাতাদের যেমন ভূমিকা আছে। তেমনি ভূমিকা আছে দর্শকদেরও। প্রিয় দর্শক, এ ব্যাপারে আপনাদের সহৃদয় সহযোগিতা কামনা করছি। দেশকে ভালোবেসে আসুন না সকলে মিলে আমাদের নাটক, সিনেমায় সম্ভাবনার আলো ফেলি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

সারাবাংলা/পিএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর