ডিসেম্বর সব সময়ই একটি অমিমাংসিত মাস…
৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:১০
ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জীবনে একটি গৌরবোজ্জ্বল মাস। আমাদের বিজয়ের মাস। বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচিয়ে এবং বুক চিতিয়ে যাত্রা শুরু করার মাস।
১৬ ই ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনেই দখলদার পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ – ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর পরেও দেশের ভেতরে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়। মিরপুরে চলেছে যুদ্ধ। চলেছে বিহারীদের নৃশংসতা। ঝরেছে রক্ত অঝোরধারায় বিজয় দিবসের পরেও। হারিয়ে যাননি, নৃশংস ভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়েছিলেন জহির রায়হান হারানো ভাইকে খুঁজতে গিয়ে…..আমরা ভাবি যুদ্ধ শেষ। ধর্ম নিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মূল আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জন্ম নিয়েছে এক অনন্য দেশ।
কিন্তু হায়! শত সহস্র ষড়যন্ত্র ঘিরে ধরে আমাদের। সদ্য পরাজিত ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানীদের দোসর আর জীবিত আত্মারা করাল থাবা বসায় আমাদের লাল সবুজের হৃদয়ে। জাতির পতাকা খামচে ধরে পুরনো শকুন, সেই কবিতা রচনারও আগে।
দুনিয়ার ভয়াবহতম, কুৎসিততম এবং বীভৎস হত্যাকাণ্ডে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার।
ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয় হত্যাকাণ্ডের কলঙ্কিত অধ্যায়। খুনের বিচারে তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় বাধা। খুনীদের জামাই আদরে করা হয় পুরস্কৃত। বসানো হয় বাংলাদেশ নামের পাকিস্তানী মসনদে…..বইপুস্তক, দলিল দস্তাবেজ, প্রতিষ্ঠান – সব কিছু থেকে মুছে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ……..স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি বলতে আর কিছুই থাকেনা আসমুদ্রহিমাচলে।
কিন্তু অন্যায় বেশিদিন চাপা থাকে না। কোন সত্যই অসত্যের কাছে পরাজিত হতে পারে না। একুশ বছর পর ধীরে ধীরে ইতিহাস তার অমোঘ বিধানে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। তারই ফলশ্রুতিতে প্রথমবারের মত বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসে। বাতিল হয় কুখ্যাত ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ। মুখে বহুদলীয় গণতন্ত্র, আইনের শাসন ইত্যকার কথা তুলে আনা শাসনামলে হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করা ছিল। কি করে এই দেশে আমরা হত্যাকারীর শাস্তি আশা করতে পারতাম?
বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার প্রক্রিয়া কোন স্পেশাল ট্রাইবুনালে পুশ না করে বিচারিক আদালতের পথেই অগ্রসর হয়। আমরা দেখেছি, একাত্তরের খুনীরা গাড়িতে ফ্ল্যাগ চাপিয়ে সরকারে এসে এই বিচারপ্রক্রিয়াকে নানা ভাবে বাধাগ্রস্ত করে। একের পর এক বিচারপতি মামলা মোকাবেলায় বিব্রত বোধ করতে থাকেন। অবশেষে মামলা আবারও গতি পায় ২০০৮ সালের পর। অবশেষে চূড়ান্ত রায় হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার। রায় কার্যকর করার মাঝেও দেখি দণ্ডপ্রাপ্তরা পাশ্চাত্যে প্রশাসন আর ইন্টারপোলের নাকের ডগাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আফসোস, বিভিন্ন সময় এরাই স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানের বিচার ব্যবস্থার প্রশ্ন উত্থাপন করে বিভিন্ন জায়গায়…..।
শাহবাগ আন্দোলনও আমাদের রাজনৈতিক গতিপথের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। প্রায় ভুলতে বসা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়মমাফিক এবং প্রক্রিয়াগত বিচারের দাবি একটি জনগুরুত্বপূর্ণ ও সামাজিক দাবিতে পরিণত হয়। ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান আছে। অনেকগুলো রায় ইতোমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে। যাদের একটা বড় সময় একেবারেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনে হয়েছিল, তাদের পতন হয়েছে আদালতের রায়ে। “আওয়ামী লীগ কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ইস্যু জিইয়ে রাখবে” – মতবাদও মুখ থুবড়ে পড়ে।
রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন পূর্ণ মাত্রায় ঘটলেও আমরা বাহাত্তরের সংবিধান কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরত গিয়েছি ভাবলে ভুল হবে। তার কারণ আমাদের জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ। আমাদের চরম দূর্ভাগ্য যে আমাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাকিস্তান রাষ্টকেই তাদের রাষ্ট্র বলে মনে করেছিল। তার বাইরে আরেকটি বড় অংশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে একটি আধুনিক, স্মার্ট পাকিস্তানই হতে চেয়েছিল – বাংলাদেশ নয়।
এই কারণে আমরা ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী আর সংশয়পন্থীদের এক্টিভিজম আর আস্ফালন দেখি। কিন্তু আদপে বাংলাদেশ পন্থীদের আধিক্য দেখি না। সরকার আর রাষ্ট্র চালনায় যারা আছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাতে দেখেছেন দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র। খুনের দায়ে ফাঁসির আদেশ প্রাপ্তদের ছেড়ে দিতে বিশ্বের ক্ষমতাধর রা নিজেরা সক্রিয় হয়েছেন। সক্রিয় ছিল জাতিসংঘ। মার্কিন প্রভাবাধীন এবং একই সাথে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এই বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সাথে সক্রিয় ছিল খুনীদের পেইড লবিস্ট চক্র। এত কিছুর পরেও বিচারের রায় এবং তার বাস্তবায়নকে ঠেকাতে না পেরে শাহবাগকে চরমভাবে আঘাত করার কৌশল প্রণীত হয়। পুরো শাহবাগকে নাস্তিকদের আখড়া হিসেবে প্রমাণের একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা দেশ জুড়ে অব্যাহত থাকে। “চেতনাবাজ”, “চেতনাজীবি” বিভিন্ন শব্দ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় টীটকারি চলতে থাকে পুরো মাত্রায়। লক্ষ লক্ষ লাইক, শেয়ার, কমেন্ট দেখা গেছে এই ধরণের প্রপাগান্ডামূলক পেজগুলোতে। ইদানিং নতুন কৌশলে আবহাওয়া, ট্র্যাফিক আপডেট, মজাদার রেসিপি ইত্যাদি নাম নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে সেখানে লোকজন যোগাড় করে উন্নয়ন এবং দেশের অর্জনগুলো নিয়ে ব্যাঙ্গ, বিদ্রুপ ও রসিকতা দেখছি।
৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বরের পরেও যেমনি বিহারীরা আমাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে, খুন করেছে জহির রায়হানদের – ঠিক তেমনি পুরো ডিসেম্বর জুড়েই লাল – সবুজের রঙ উড়িয়ে একে বিজয়ের মাস বললেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে চ্যালেন্জ রয়ে গেছে। এক শাহবাগের বিপরীতে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত হেফাজতও ঘটিয়েছে। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে এদের দৌরাত্ম্য চলমান। বাচ্চাদের বই পুস্তকে “ও” তে ওলকচু বদলে “ওড়না” লিখা হয়েছে। বিভিন্ন স্কুলের শহীদ মিনারগুলোতে জুতা পড়ে চলাফেরা চলছে শিক্ষকদের সামনেই। সুপ্রীম কোর্টের সামনে থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য। নগ্নভাবে এবং মূলধারার মিডিয়া কে ব্যবহার করে নারীর ঘরের বাইরে কাজ করা এবং পোশাক আশাক নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। জুম্মার এক ঘন্টা আগে গিয়ে পার্শ্ববর্তী মন্দিরের ঢাকের আওয়াজ বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয় নি, বেড়ধড়ক পিটিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মনের সুখ মিটিয়েছে। থেমে থেমে জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপরেও চলেছে অত্যাচার।
সেই যে, ধর্ম নিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্রের বাংলাদেশকে অনেক অচেনা মনে হয়। আমার ধারণা, আমরা যখন লিখি, “এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম ?” তখন আমরাই নিশ্চিত হই না, কোন বাংলাদেশ আমরা আসলে চেয়েছিলাম? নইলে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্তরা কি করে জণগণেরই প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন?!
কাল হতে শুরু হওয়া নতুন বছরের জানুয়ারি মাস হয়ত অনেক সম্ভাবনা নিয়ে আসবে, কিন্তু ডিসেম্বর সব সময়ই একটি অমিমাংসিত মাস …।
লেখক: সিইও, কনটেন্ট ম্যাটারস এবং ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, সারাবাংলা.নেট।