সাংবাদিকতায় কুম্ভিলকবৃত্তি পরিত্যাজ্য
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:৪৬
মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক ।।
সাংবাদিকতায় কুম্ভিলকবৃত্তি অবশ্য পরিত্যাজ্য। এই পেশায় ‘চুরি-চামারি’ এতটাই বেড়েছে যে- একটু কঠিন ভাষায়ই কথাটা বলতে হলো। কথা হচ্ছে Plagiarism (প্লেজারিজম) নিয়ে। বাংলা একাডেমি এর অর্থ করেছে কুম্ভিলকবৃত্তি। সহজ করে বলা যায়- অন্যের ভাব, শব্দ, কথা এসব নিজের বলে ব্যবহার করা। আমি আগেও বলেছি- এটা স্রেফ চুরি কিংবা চৌর্য্যবৃত্তি। সাংবাদিকতায় এই চোরদের দৌরাত্ম্য এখন সকল সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়েছে।
একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন জার্নালিজম কোর্সে আমরা একটা প্র্যাকটিস নিউজ পোর্টাল চালাই। ডিইউএমসিজেনিউজ.কম। এই পোর্টালে শিক্ষার্থীরা নিজেরা বিভিন্ন বিষয় কাভার করে স্টোরি লেখে । ক্লাশে স্টোরি নিয়ে আলোচনা হয়। শ্রেণিকক্ষকে বার্তাকক্ষে পরিণত করে সম্পাদনার কাজ চলে। এরপর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। পোর্টালটি খুব একটা পাবলিক নয়। ফলে অনেকের তা জানা নেই। তবে কোয়ালিটি কনটেন্ট তৈরি ও তা প্রকাশকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষার্থীরা কাজ করে চলেছে। তো সেই, বলা চলে অনেকটা গোপন, প্র্যাকটিস পোর্টালেও হানা দিয়েছে সাংবাদিকতা জগতের চোরেরা। ক্যাম্পাসে বইয়ের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে করা একটি স্টোরি হুবহু কপি করেছে দেশ সংবাদ নামের একটি পোর্টাল। চোরদের এমন হানায় পেশার অনেকেই এখন অভ্যস্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীটি তার নিয়মিত পড়াশোনার ফাঁকে অনেকে খাটুনি করে এমন একটি স্টোরি তৈরি করলো তা যখন চুরি হয়ে যায় তখন কষ্টটা খুব বেশি করে লাগে। ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ১০ মিনিটে সারাবাংলা.নেটে প্রকাশিত হলো- শহরে যৌন হয়রানির নতুন ধরণ- প্রতিরোধ করবে কে? শিরোনামে পুরোদস্তুর গবেষণাভিত্তিক একটি স্টোরি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তা কপি-পেস্ট হয়ে গেলো কয়েক ডজন অনলাইন পোর্টালে। অফিসে কলিগদের এ নিয়ে আকুতি প্রতিদিনকার। এবার সে তালিকায় যুক্ত হলো শিক্ষার্থীরাও। আর সে কারণেই এই লিখতে বসা। তবে চোরদের একটু অ্যাকাডেমিক জ্ঞান দিতে চাই। কেনো তারা এটা করবে না সে কথাটিই বলবো ইনিয়ে বিনিয়ে। অবশ্য, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী- সেই আপ্তবাক্য আমারও জানা। তারপরেও বলা।
শুরুতে বলেছি- সাংবাদিকতায় এই চৌর্য্যবৃত্তি অবশ্য পরিত্যাজ্য। কিন্তু কেন?
একটা সংবাদমাধ্যমের জন্য প্রধান তিনটি মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে- পেশাদারিত্ব, বিশ্বাসযোগ্যতা ও জবাবদিহিতা। সাধারণ পাঠক তথা মানুষ আসলে একটা মিডিয়ার ওপরই ভরসা রাখে কিংবা রাখতে চায়। তাদের ভরসা এই যে, সংবাদমাধ্যমই তাদের কাছে সঠিক তথ্যটি সম্পূর্ণ সততায় তুলে ধরবে। একটা সংবাদ মাধ্যম যখন তার নৈতিক মান বজায় রেখে কাজ করে যায় তখনই সে সুনাম কুড়ায়। আর তা ধরে রাখা একটি প্রতিদিনকার, বর্তমানে অনলাইন মিডিয়ার যুগে প্রতিমূহূর্তের লড়াই। এ লড়াই সংবাদমাধ্যম হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক এবং সংবাদকর্মী হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তি সাংবাদিকের। একজন ব্যক্তি সাংবাদিক যখন যা কিছুই করেন তার মধ্য দিয়েই সমাজের কাছে ফুটে ওঠে গোটা সংবাদমাধ্যমের প্রতিচ্ছবি। সেকারণেই পেশাদারিত্ব, নৈতিকতা, সত্যকথন এগুলোকেই সাংবাদিকতার মূলনীতি হিবেবে মানা হয়। আর এসব মূলনীতি মানতে ব্যর্থ হলে সাধারণ পাঠক তথা মানুষকেই ঠকানো হয় সবচেয়ে বেশি। শুধু ঠকানোই নয়, এর মধ্য দিয়ে বড় ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। এতসব নীতিকথা কিংবা নীতির কথা বলছি এই জন্য যে- সাংবাদিকতায় যখন চৌর্য্যবৃত্তি (কুম্ভিলকবৃত্তি অর্থে) ঢুকে যায়- তখন এইসব নীতি-নৈতিকতা ভীষণভাবে ঝুঁকিতে পড়ে। আর তা সাংবাদিতার নীতিমালার একটা মারাত্মক লঙ্ঘনও বটে। একজন ব্যক্তি সংবাদকর্মী যখন এই চুরি করা কনটেন্ট নিয়ে আসেন তখন তিনি কেবল নিজের ক্ষতিই করেন না… ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার সংবাদমাধ্যমটিও। আর সর্বোপরি এতে করে গোটা সাংবাদিকতা পেশাই সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
সাংবাদিকতায় এই কুম্ভিলতা কিভাবে কোন কোন কারণে হতে পারে তার একটা ধারণা দেওয়া যাক। তিনটি প্রধান পথে এই অপরাধটি সংগঠিত হতে পারে। এক. অন্য একটি সংবাদমাধ্যম কিংবা অন্য কোনও সংবাদকর্মীর সংগ্রহ করা তথ্য তাকে কোনও ধরনের ক্রেডিট না দিয়ে আপনার সংবাদমাধ্যমে ব্যবহার; দুই. অন্য কোনও খবর কিংবা স্টোরি থেকে কোনও একটি অংশ হুবহু কপি করে নিজের স্টোরিতে ব্যবহার; এবং তিন. কোনও একজন রিপোর্টারের আইডিয়া কিংবা রিপোর্টের অ্যাঙ্গেলটি নিজের করে নেওয়া।
অবশ্য আমাদের সংবাদচোররা আজকাল আর আলাদা করে তথ্য, রিপোর্টের অংশ কিংবা আইডিয়া বা অ্যাঙ্গেল চুরির ধার ধারেন না। আপনার স্টোরিটি হুবহু কপি পেস্ট করে বসিয়ে দেন। তাতে তারা এমন ভুলও করে বসেন যে, কোনও কোটেশনে যদি মূল সংবাদমাধ্যমটির কথা উল্লেখ থাকে সেটাও মুছে দিতে ভুলে যান। অনেক আগে এজন্য লিখেছিলাম- সংবাদমাধ্যমে কপি-পেস্ট সম্পাদক নিয়োগ কবে? এই শিরোনামে। প্রত্যাশা এই যে, তাতে যদি কপি-পেস্টের কাজটা সঠিকভাবে করা যায়।
তো দেখাই যাচ্ছে- সাংবাদিকতায় এই প্লেজারিজম বেড়েই চলেছে। এ সঙ্কট শুধু বাংলাদেশের নয় গোটা বিশ্বের। আর সে কারণে সাংবাদিকতা পেশায় একটা অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে। স্রেফ কনটেন্ট কিংবা আইডিয়া চুরি করে কেউ কেউ চাকরিও হারাচ্ছেন। তাতে ব্যক্তি সংবাদকর্মীর ওপর নেমে আসছে খাড়া। কারণ ব্যক্তির কারণে মূল প্রতিষ্ঠান ক্ষতিটা মেনে নেবে না। তবে এখানে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা যায় সিএনএন’র ফরিদ যাকারিয়ার ঘটনাটি। ২০১২ সালে একবার তাকে সিএনএন ও টাইম ম্যাগাজিন উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিলো। যার কারণ ছিলো এই কুম্ভিলকবৃত্তি। সেবার টাইম ম্যাগাজিনে তার একটি কলামে এই কুম্ভিলতার আশ্রয় নিয়েছিলেন ফরিদ যাকারিয়া। সে ঘটনার পর ওয়াশিংটনপোস্ট, নিউজউইক ও স্লেট ম্যাগজিনে প্রকাশিত ১৩টি আর্টিকেলেও সংশোধনী দিতে হয়েছিলো।
একটি কুম্ভিলতা এত কিছু কর্মযজ্ঞের কারণ হয়, যখন সাংবাদিকতার নৈতিকতা থাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে বাংলাদেশে নাম কুড়িয়েছেন এমন বড় সম্পাদকের সম্পাদিত সংবাদপত্রও অহরহ চুরি করা কনটেন্ট দিয়ে ভরিয়ে তুলছেন তাদের সংবাদপত্রের দেয়াল।
তারা কিন্তু একবারও ভাবছেন না এই চৌর্য্যবৃত্তির পরিণতি কী হতে পারে! ফরিদ যাকারিয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। তিনি বড় মাপের, বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক, একবার ভুল করেছেন তাতে সামান্য শাস্তি হিসেবে কিছুকাল সাময়িক বরখাস্ত থেকেছেন। কিন্তু বিশ্বের দেশে দেশে আজকাল এমন চর্চা খুব দেখা যাচ্ছে- কোনও সংবাদপত্রে কিংবা সংবাদমাধ্যমে এই ধরনের ঘটনায় সংবাদকর্মী চাকরি হারাচ্ছেন। কেউ লজ্জায় পড়ে নিজেই চাকরি ছেড়ে পালাচ্ছেন। তবে সেতো গেলো অফিস কিংবা নিজের তরফ থেকে নেওয়া ব্যবস্থা। এমন ঘটনায় সরাসরি আইনের আশ্রয়ও নেওয়া সম্ভব। যাতে অর্থদণ্ড হতে পারে এমনকি কারাদণ্ড দেওয়াও সম্ভব।
আরেকটি কথা এখন অন্যের কনটেন্ট নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া যেমন সহজ, তেমনভাবে যারা এ কাজটি করছে তাদের ধরে ফেলাও সহজ হয়ে গেছে। প্যারাফ্রেজিং সার্ভিস নামের একটি সার্ভিস রয়েছে যা থেকে আপনি অতি সহজেই বের করে আনতে পারবেন কে কোথায় কিভাবে আপনার কনটেন্ট চুরি করছে। আরেকটি পদ্ধতি রয়েছে নাম জেকোয়েরি। তাতেও ধরে ফেলা সম্ভব কনটেন্ট চুরি। এছাড়াও প্ল্যাগস্ক্যান.কম, ডুপ্লিচেকার.কম, সফটোনিক.কম এমন সব সফটওয়্যারভিত্তিক সার্ভিসও রয়েছে। কিন্তু ধরে ফেলাই তো শেষ কথা নয়। ব্যবস্থাও নিতে হবে। সে জন্য রয়েছে আইক্যান (ইন্টারনেট কর্পোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস) নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এতে অভিযোগ করলে ওরা অপরাধীকে ধরে, অপরাধ প্রমাণিত হলে ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়।
আমাদের দেশে কপিরাইট নামের একটি আইন রয়েছে, তার আওতায়ও এর বিচার করা চলে। তবে অনলাইন নীতিমালায় এ ব্যাপারে জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে বোধ করছি। সাংবাদিকতাকে একটি যথার্থ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিতে হলে এর বিকল্প নেই।
একটি অনলাইন মিডিয়াকে আন্তর্জাতিক যে কোনও বড় আয়োজন কাভার করতে হলে কিছু শর্ত দেওয়া হয়। এই সেপ্টেম্বরেই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন বসছে। এখানে মিডিয়া অ্যাক্রেডিটেশনে সকল মিডিয়ার জন্য কিছু সাধারণ শর্ত রয়েছে। এর পাশাপাশি অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য বিশেষ চারটি শর্ত দেওয়া হয়েছে।
এক. ওয়েবসাইটটি কোনও প্রতিষ্ঠিত কিংবা স্বীকৃত মিডিয়া অরগানাইজেশনের মালিকানাধীন হতে হবে। তাদের থাকতে হবে সুনির্দিষ্ট অফিস ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর।
দুই. ওয়েব সাইটের অন্তত ৬০ শতাংশ অরিজিনাল নিউজ কনটেন্ট, মতামত কিংবা বিশ্লেষণধর্মী কাভারেজ থাকতে হবে।
তিন. যিনি কর্মসূচিটি কাভার করতে যাচ্ছেন তার নিজের নামে পূর্ববর্তী ১২ মাসে প্রকাশিত অন্তত ছয়টি স্টোরি জমা দিতে হবে।
চার. সপ্তাহে অন্তত তিন বার ওয়েবসাইটটি অরিজিনাল কনটেন্ট দিয়ে আপডেট করতে হবে।
কনটেন্ট চুরি করে যারা ওয়েব পোর্টাল চালিয়ে রীতিমতো সাংবাদিক তথা সম্পাদক ইত্যাদি বনে গেছেন তাদের জন্য এই শর্তগুলোর একটিও পূরণ করা সম্ভব হবে না। কারণ তাদের নিজেদের তৈরি অরিজিনাল কনটেন্ট বলতে কিছুই নেই। পাশাপাশি তাদের নেই কোনও ঠিকানা। নিজের নামে ছয়টি আর্টিকেল জমা দিলে তার সবকটিই যে প্লেজারিজমের দোষে দুষ্ট তা খুঁজে নিতে জাতিসংঘের মিডিয়া অ্যাক্রেডিটেশন লিয়াজোঁ ইউনিট (মালু)’র মোটেই সময় লাগবে না।
সুতরাং চুরি কিংবা কুম্ভিলতা নয়, নিজেই তথ্য সংগ্রহ করে নিন, নিজের স্টোরি নিজেই লিখুন, তাতে সাংবাদিকতাই উপকৃত হবে।
মাহমুদ মেনন : নির্বাহী সম্পাদক, সারাবাংলা
সারাবাংলা/এমএম