বন্যা মোকাবেলায় মৎস্য ও পশু বীমা
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২২:৪৩
সৌরিন দত্ত ।।
জুন মাস শেষ হতে চলেছে। ভরা বর্ষার আগমনীতে ভিজে উঠবে আসামের চেরাপুঞ্জি, মেঘালয়। আর সেই বর্ষণ পাহাড়ি ঢলের রূপে ডুবিয়ে দেবে বাংলাদেশের সিলেটের জকিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, রংপুর আর কুড়িগ্রামের জনপদ। গত বছর বেশ ভালো (বলা যেতে পারে বেশি খারাপ রকমের) বন্যা হয়েছিল। বন্যা হয়েছিল তার আগের বছরও, তারও আগের বছর এবং তারও আগের বছর।
অপরিসীম প্রাণশক্তিতে বলীয়ান গ্রামীণ মানুষ গত বছরের বন্যায় নিঃস্ব হলেও হাল ছাড়েনি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে চাষাবাদ করেছে। চাষী বউ ঘরের মাচায় বড় যত্নে লাগিয়েছিল লাউ আর পুঁই লতা। কচি লাউয়ের সবুজ ডগা আর বিশাল পাতায় ছেয়ে গিয়েছিল তার দোচালা খড়ের ঘর। এক চিলতে উঠোনের এক কোনায় ছিপছিপে তরুণীর মত বেড়ে উঠেছে পুঁইয়ের গাছটা। সমিতির থেকে নেয়া ক্ষুদ্র ঋণে দুটো হাঁস আর দুটো মুরগিও কিনেছিল চাষী বউ, আর দিনকয়েক পরেই ডিম দেয়া শুরু করবে ওগুলো। গতবারের বন্যার সময় কোথাও এক মুঠো শুকনো খড় ছিলনা। গাছা আগাছা খেয়ে একমাত্র গাভিটার পেটের অসুখ হয়েছিল। তাই তড়িঘড়ি করে নামমাত্র দামে গরুটা বেচে দিয়েছিল চাষী। তবু ভাগ্য ভালো তার কোনমতে বেঁচে গিয়েছে, অন্যেরা তো বেচতেও পারেনি, গরুগুলো মরেই গিয়েছিল প্রথম কয়েকদিনেই। এবছর আবারো পানি বাড়তে শুরু করেছে। দুরু-দুরু বুকে কৃষক অপেক্ষা করছে দুঃসহ আগামী দিনগুলির। ফি বছরের বন্যায় সর্বস্ব হারানো যেন আমার দুখিনী মায়ের সন্তানগুলোর আজন্ম ললাট লিখন।
বানভাসি মানুষের পাশে সরকারের সাথে সাথে বেসরকারি সংগঠন এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে দাঁড়ান। জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সেল খোলা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড সার্বক্ষণিকভাবে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। একসময় বন্যার পানি নেমে যায়। সব হারিয়ে মানুষ ফিরে আসে নিজের ভিটেয়। রিক্তের বেদন আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে চারিদিক। অদৃষ্টবাদী নিরীহ কৃষক দুষতে থাকে নিজের কপালকে। বুঝতে পারেনা কিভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াবে?
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের অর্থনীতি ধীরে ধীরে কৃষি থেকে শিল্প নির্ভর হয়েছে। মূলত তৈরি পোশাক খাতের অবদানে আমাদের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ এখন আসে শিল্পজ পণ্য থেকে। কিন্তু জিডিপিতে এখনো কৃষির অবদান অনস্বীকার্য। কৃষিপণ্য এবং কৃষকের কল্যাণকল্পে আমাদের এক শক্তিশালী অবকাঠামো রয়েছে যা পৃথিবীর অনেক দেশে নেই। ধীরে ধীরে কৃষিজমির পরিমাণ কমতে থাকলেও এককালের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি বিস্ময়কর। বছরে চারমাস পানির তলায় থাকা জমিও এখন কমপক্ষে দোফসলি। মৎস্য এবং পশুপালন ক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি এখন উপমহাদেশে তো বটেই পৃথিবীর অনেক দেশের কাছেই রোল মডেল। কিন্তু আফসোস, তৈরি পোশাক বা অন্যান্য কিছু শিল্পের ক্ষেত্রে সরকার যে পরিমাণ ভর্তুকি বা নগদ প্রণোদনা দেয়, কৃষিক্ষেত্রে সে তুলনায় তেমন কিছুই দেয়া হয়না।
বন্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প হওয়া উচিৎ। কিন্তু সীমিত সম্পদের এই দেশে তা সবসময় সম্ভব হয়না। আর লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমলা, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলি, আমাদের এমনই চরিত্র যে সরকারি প্রকল্পের অনুদানের টাকার শতকরা কুড়িভাগও প্রকৃত দাবিদারদের হাতে পৌঁছে কিনা সন্দেহ। আর তাই সরকারের এই সাহায্য যদি পশু বা মৎস্য খাতে বীমা ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যয় করা হয় তবে তার সুফল অনেক ভালোভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে।
আমাদের থানা এমনকি কিছু ইউনিয়ন পর্যায়েও পশুপালন এবং পশু প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। বন্যা-প্রবণ এলাকায় সময়োচিত এবং সঠিক শুমারির মাধ্যমে গবাদিপশু তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের বীমার আওতায় আনা গেলে বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অনেক সহজতর হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সামান্য গতিশীলতাই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। একইরকম ভাবে জামালপুর ময়মনসিংহ এলাকার ক্ষুদ্র মৎস্য-খামার উদ্যোক্তাদের বীমার আওতায় আনা উচিত। দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনাসহ আরো অনেক দেশ মৎস্য ও পশুবীমাকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে। বলাবাহুল্য এসব দেশে কৃষি মোটেই অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ নয়।
মৎস্য ও পশু বীমা শুধু যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিরূপ প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে টেকসই উন্নয়নের স্বাদ দিবে তাই নয়, বিরূপ প্রকৃতির যে কালচক্রে প্রপিতামহের আমল থেকে তারা আবদ্ধ সেই চক্র থেকেও মুক্তি মিলবে। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়ত একই থাকবে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল থাকবে। দেশের বীমা শিল্পেও প্রভূত কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। একটি গরুর বাজারমূল্য কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকাও যদি ধরা হয়, তবে বন্যা পরবর্তীতে কৃষক ঘুরে দাঁড়াবে রিক্ত হাতে নয়, কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে।
মানুষকে খয়রাতি সাহায্য নয়, তাকে বিপদে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সু্যোগ দিতে হবে, দিতে হবে প্রণোদনা। মনে পড়ে সেই কাহিনী যেখানে প্রিয় নবী দরিদ্রকে কুঠার কিনে দিয়ে স্বাচ্ছল্যের পথ দেখিয়েছিলেন। আর একটা কথা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিককে যথাযথ পুনর্বাসন রাষ্ট্রের দায়িত্ব আর তার জন্য নতুন বা পরীক্ষিত কৌশলের প্রয়োগ রাষ্ট্রের কর্তব্য, মোটেও তা ঐচ্ছিক নয়।
লেখক: কর্মকর্তা, ডিএইচএল