নিবারণের মা
৮ অক্টোবর ২০১৮ ১৪:২০
ছেলেবেলায় আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। এই কথাটিতে কোন বিশেষত্ব নেই । শৈশবে সব ছেলেরাই দুরন্ত থাকে। তবে আমার দুরন্তপনার জন্যে অনেককেই অযথা অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে, সে কথা ভেবে খুব কষ্ট হয় আমার।
আমরা থাকতাম চট্টগ্রাম চন্দনপুরা কলেজ কলোনির ১৪৩ নং বাড়িতে। আমার বাবা চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সেই সুবাদে সিনিয়র শিক্ষকদের জন্যে বরাদ্দ সরকারি কলোনির একটি তিন বেডরুম বাড়িতে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছিল। সমবয়সী বন্ধুবান্ধবীতে ভরা ছিল কলোনির জীবন। আধবেলা স্কুল শেষ করে মার্বেল খেলা, দুপুর না গড়াতেই ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো আর শেষ বিকেলে মেয়েদের সাথে ‘ছি বুড়ি’ খেলা ! এই ছিল আমাদের দৈনিক রুটিন। একবার এক মেয়ের ফ্রকের ভেতরে ‘বিছুটি পাতা’ ঢুকিয়ে দিয়েই দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেই মেয়েটি আজ’তক আমার সাথে কথা বলে না। ক্রিকেট বলের আঘাতে কলোনির কত বাড়ির কাচের জানালা যে ভেঙ্গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
একদিন পোস্টমাস্টার কাকু যথারীতি চিঠি বিলি না করে সোজা আমার বাবার কাছে চলে গেলেন ; কারণ তার কাছে নিশ্চিত প্রমাণ ছিল সাইকেলের পিছনে বাঁধা সবগুলো চিঠির বিদেশি স্ট্যাম্প আমি চুরি করেছি। এমন কিছু একটা ঘটবে, আমি তা আগে থেকে টের পেয়েছিলাম। সে সময় আমাদের কোন দেয়াল ঘড়ি ছিল না। সবকিছুই চলতো মসজিদের মাইকে আযানের ধ্বনিতে। মাগরিবের আযান পেরিয়ে সেদিন আকাশ ঘন অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল আমি মায়ের কড়া আদেশ অমান্য করে তখনো বাড়ির বাইরে ছিলাম । আমি জানতাম আজ বাড়িতে জন্যে মৃত্যু অপেক্ষা করছে । আমি ভয়ে কাতর হয়ে কলোনির রাস্তার ওপারে পোড়ো মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এমনিতে দিনের বেলাতেও আমরা ঐ মন্দিরে যেতে ভয় পেতাম; সেদিন আমার আর কোথাও যাবার জায়গা ছিল না। হঠাৎ দেখি প্রাত্যহিক পুজো শেষ করে এক প্যাঁচে সাদা পাতলা সুতির কাপড় পরা নিবারণের মা বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে আমি হাউ হাউ করে কেঁদে দিলাম। তিনি আমাকে যথাসম্ভব অভয় দিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলেন ।
ডাকটিকিট সামান্য হতে পারে কিন্তু ‘চুরি করা’ র ব্যাপারটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আমি এখন খুব বুঝি, সেদিন পোস্টমাস্টার কাকুর সামনে বাবা খুবই অপমানিত বোধ করেছিলেন। নিবারণের মাকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে বাবা আমাকে বেদম প্রহার করেছিলেন। খুব মনে আছে আমাকে চড় থাপ্পড়ের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে এই পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রমহিলাও সেদিন আঘাত পেয়েছিলেন। জন্মের পর থেকেই নিবারণের মাকে আমি দেখে এসেছি । মহিলাদের যেমন প্রতিটি শাড়ির পেছনে একটি অ-বলা গল্প থাকে তেমনি আমার পিঠে অনেকগুলো ক্ষতের দাগ আছে; সে দাগের সবক’টি গল্প নিবারণের মায়ের জানা ছিল।
ইদানিংকালের কথা বাদ দিলে আমি আমার মাকে মায়ের চাইতেও আমি বেশি পেয়েছি চশমাপরা স্কুল টিচার হিসেবে। ঘুম থেকে উঠে তিনি স্কুলে ছুটতেন, আমরা দুই ভাইবোন থাকতাম নিবারণের মায়ের কাছে। বাবা একবার বেরুলে রাতে কখন বাড়ি ফিরতেন আমি জানতাম না । মা অবশ্য স্কুল শেষে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শুরুতে ফিরে আসতেন । এভাবে যে যার সময়ে ফিরে আসতো কিন্তু নিবারণ আর কোনোদিন বাড়ি ফিরে আসেনি । আমরা কেউ জানতামনা সে কী পানিতে ডুবে না যক্ষায় মারা গেছে। নিবারণের মাকেও কোনোদিন ছেলেকে নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। তিনি বরাবরই নীরব এবং নিভৃত ছিলেন । আপন মনে আযানের শব্দ ধরে সংসারের মুখস্থ কাজ শেষ করে ঠিক এশার আগে একচালা ঘরে চলে যেতেন। পোড়ো মন্দিরের পিছনে ছিল তাঁর ঘরটি। দুপুরে ছাদে ভেজা কাঁথাকম্বল, জামাকাপড়, তোয়ালে ইত্যাদি রোদে উল্টে পাল্টে দিতেন। গোসলের পর আমার মাথায় নারকেল তেল মেখে চুল আঁচড়ে দিতেন। তারপর কাঁসার বাসনে কৈ মাছের কাঁটা বেছে ভাতের সাথে ঝোল আর আলু ভর্তা মেখে ছোট ছোট ‘ভাতবল’ বানিয়ে দিতেন। আমার এখনো মনে আছে, ভাতবল গুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। প্রথমটার নাম নীলকমল, পরেরটি নীল কমলের বড়’দা লালকমল। তারপরেরটা প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা । সে রাজার এক অপরূপা রাজকন্যা আছে এবং অবধারিত ভাবে শেষ ভাতবলটি হতো সেই রাজকন্যার নামে। কোনোদিন ওর নাম হতো মাধুরীলতা কোনোদিন কাঞ্চনমালা । শেষ বলটা খেয়ে ফেলা মানেই রাজকন্যার সাথে আমার বিয়ে হওয়া।
একবার বাড়িতে বাবার একজন ছাত্র আমার সমবয়সী এক ছেলেকে বেড়াতে নিয়ে এলেন । তখন বিকেল, আছরের আযান হয়েছে। বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,‘ তিতাস, ওর নাম আবীর। ওর বাবা মা নেই । আজ থেকে তুমি আর আবীর, তোমরা বন্ধু হলে । যাও, ওকে নিয়ে মাঠে খেলাধূলো করে আসো।’ আমি আবীরের হাত ধরলাম। ও একটু ইতস্তত করছিলো। মাঠে যাবার আগে আমি অবাক বিস্ময়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ ওর কী একটা নিবারণের মা ও নাই ?’
পাড়ার সবাই তাঁকে ‘নিবারণের মা’ বলেই ডাকতো । এতদিন পরে আমি ভাবছি অন্তত আমরা বাড়িতে ভাইবোন তাঁকে শ্রদ্ধা করে ‘মাসি’, ‘দিদা’ এমন কত নামেই তো ডাকতে পারতাম! কেন জানিনা, তা হয়নি। আসলে এমন যে তাঁকে আমাদের কখনো কোন নামে ডাকতে হয়নি । তাঁকে ডাকার প্রয়োজন হবার আগেই তিনি আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হতেন। তবে মনে আছে, কলোনির অনেকে আমাদের অন্দর মহলে একজন হিন্দু মহিলার আসা যাওয়া, তার হাতের রান্নাবান্না সহজভাবে নিতে পারতেননা । মাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, ‘ আমি হিন্দু মুসলমান চিনিনা। আমার ঘরে যারা আসেন, আমি বিশ্বাস করি তাঁরা প্রত্যেকেই ভাল মানুষ। এই নিবারণের মা ছাড়া আমার পক্ষে স্কুল কলেজের চাকরি করে তিয়াসা, তিতাসকে বড় করা সম্ভব ছিলো না। নিবারণের মা ছিল বলেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ওযুর পানিটা সবসময় হাতের কাছে পেয়েছি ।’
এরপর কখন যে কী হলো আমরা কিছুই জানলাম না। একদিন মায়ের কাছে শুনলাম বাবার চাকুরিতে প্রমোশন হয়েছে । আমরা চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যাবো । সেটা ছিল ১৯৭৬ সাল। ফজরের আযানের পর আমাদের মালপত্র সব ট্রাকে তোলা শুরু হয়েছে। অবশ্য এর কিছুদিন আগ থেকে আমরা এ বাড়ি ও বাড়ি বিদায়ী ভোজ খেয়েছি। আমাদেরকে সাহায্য করার জন্যে কলোনির সবাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন । এসব বিদায় যজ্ঞেও নিবারণের মা ধীর স্থির, তাঁর নিয়মিত কাজ করে যান। আছরের আযান হলো। আমাদের গোছগাছ, বাঁধাসাজা চূড়ান্ত হয়েছে । আমাদের দু’জনকে কাপে করে দুধ ঢেলে দিলেন নিবারণের মা । আমার জন্যে আলাদা করে দুধের সর তোলা থাকে সেখানে খানিকটা চিনি ছিটিয়ে দিলেন। চলে যাবার আগে সবাই আমাকে গাল টিপে টিপে আদর করছে । আমি ভীষণ উত্তেজনায় দুধ কিংবা সর কিছুই খেতে পারছিলাম না । আমি ঢাকায় যাচ্ছি, সেখানে আমার নতুন স্কুল হবে। শুনেছি, ঢাকার স্কুল বাড়ি থেকে বেশ দূরে হয়, পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। আমি প্রতিদিন দু’বেলা রিকশা চড়তে পারবো, আমাদের ঢাকা বাসাতে একটা টেলিভিশন কেনা হবে ……এতো সবের ভেতরে নিবারণের মায়ের কথা মনেই ছিলনা। তাছাড়া ওঁনাকে পরিবারের বাইরের কেউ ভাবার কোন কারণ ছিলো না আমার । ঠিক সেই মুহূর্তে মা এসে বললেন, ‘ পায়ে হাত ছুঁইয়ে নিবারণের মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নাও। মাগরিবের নামাজ পড়ে আমরা তোমাদের নানার বাড়ি যাবো। সেখান থেকে ভোরে ফজরের নামাজের পরে আমাদেরকে ট্রেন স্টেশনে যেতে হবে ।’
সন্ধ্যা ঢলে পড়েছে । শৈশবের চিরচেনা চন্দনপুরা কলেজ কলোনি ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি । রিক্সার পাদানিতে টুকটাক ছোট কয়েকটি ব্যাগ । বাবা রিক্সাচালককে একটু সাবধানে চালাতে বললেন । রিক্সাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার এপারে বাড়ির সামনের পোড়ো মন্দিরটাকে ঘন কালো দেখাচ্ছে। আমার সেই ভয়ার্ত রাতের কথা মনে পড়লো । যে রাতে এই মন্দির ছাড়া আমার আর কোথাও কোনো আশ্রয় ছিল না । আমাদের রিক্সা ডানে মোড় নেবার আগে আমি শেষবারের মতো মন্দিরের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করলাম । সেখানে একটি মৃদু প্রদীপের আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না ।
এইতো আমি ! আমার ডানপাশে দিনে পাঁচবার আযানের ধ্বনি অন্যপাশে পুজোর প্রদীপ হাতে সার্বক্ষনিকের জন্যে নিবারণের মা । কী আমার শৈশব ! কী আমার কৈশোর ! আমি বেড়ে উঠেছি দু’পাশের এই দুই অপূর্ব বৈভব আর বিত্তের ভিতর দিয়ে । বড় হয়ে আমি আর নতুন কোন ধর্মজ্ঞান অর্জন করিনি। হয়তো আমি ধর্মযাজক হতে পারিনি, তবে আমি অন্ধ নই।
সারাবাংলা/ এসএস