কেউ আমারে চায়না দিতে একটু সময় ঋণ
১৬ অক্টোবর ২০১৮ ১৪:২৭
আমি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। মা ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে গেলেন। আমি তখন কোনো একটা ছুটিতে নরসিংদীতে। আমি আর আব্বা এই দুইজন নরসিংদীতে; বাকী সবাই ঢাকা। আব্বা সকালে কোর্টে চলে যেতেন আর আমি সারাদিন বাসায় একা। বুয়া আসতো নিজের মতো কাজ করে চলে যেতো। সম্ভবত তিনদিন আমরা এভাবে ছিলাম। যেহেতু বাসায় আমি একা তাই আব্বা তাড়াতাড়িই বাসায় চলে আসতেন। মনে আছে এক সন্ধ্যায় আমরা বাপ-বেটিতে গল্প করতে বসেছিলাম; সেই গল্প চলেছিলো রাত ১০-৩০ টা অব্দি। সত্যি বলছি আমি একটা কথাও বলিনি । এই পুরো চার ঘণ্টা আমার আব্বা বলেছিলেন আমি শুনেছিলাম। মাঝখানে অবশ্য আব্বাকে লেবু-লবণ দিয়ে রঙ চা বানিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলেন বলতে আব্বা তাঁর জীবনের গল্প করেছেন , তার স্ট্রাগলের গল্প করেছেন, আম্মার সাথে তার বিয়ের গল্প করেছেন। আমার এখনও মনে আছে বিয়ের গল্প করার সময় আব্বা ব্লাশ করছিলেন। আমি তাঁর সবার ছোট মেয়ে তাই হয়তো লজ্জা একটু বেশিই পাচ্ছিলেন।
তৃতীয় বর্ষে যা বুঝিনি আজ তার অনেকটাই বুঝি (আমার বুঝার সবটা সঠিক নাও হতে পারে)।ওই তিনদিন আম্মা ছিলেন না তাই আব্বার কোনো কথা বলার সঙ্গী ছিলোনা। কাজ থেকে ঘরে ফিরে প্রতিটা মানুষ তার সারাদিনের জমানো গল্প বলার জন্য কাউকে খোঁজে । সেই ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গীই বেস্ট অপশন। তবে অফিস ফেরত সারাদিনের গল্পগুলো একরকম আবার সারাজীবনের গল্পগুলো অন্যরকম। সারাজীবনের গল্পগুলো বলার জন্য জীবনসঙ্গী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেস্ট অপশন নয় । তাই মানুষ তার গল্প বলার জন্য যথার্থ মানুষ খোঁজে, সুযোগ খোঁজে । আমি হয়তো আমার আব্বার জন্য একেবারে যথার্থ মানুষ ছিলাম না কিন্তু সময়টা খুব যথার্থ ছিলো । মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার সঙ্গীহীনতাও বাড়তে থাকে আর সেই সাথে বাড়তে থাকে তাদের কথা বলার তৃষ্ণা, না বলা কথাগুলো বলার আকাঙ্ক্ষা।
আমার বিশ্বাস আমরা সবাই কমবেশি খেয়াল করেছি যে কাজ থেকে অবসর নেয়ার পর মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়, অসুখ বিসুখ বেশি হয় এবং অনেকেই খুব দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান । এর অন্যতম বড় কারণ অখণ্ড একাকী অবসর বা আরও সহজ করে বললে একাকীত্ব । পরিবারের বয়স্ক মানুষটির প্রতি আমাদের আগ্রহ কম থাকে, তাঁর জন্য সময় কম থাকে আর কম থাকে আমাদের নিজেদের জীবন ব্যস্ততার কারণেই; খুব যে ইচ্ছাকৃত তা নয়। আর এখন সামাজিক যোগাযোগের উপর নির্ভরশীল সময় মানুষকে যখন ধীরে ধীরে এলিয়েনেশনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তখন একজন বয়স্ক মানুষের জন্য সময় বের করা তীব্র দাবদাহে ঝুম বৃষ্টি পেয়ে যাওয়ার মতোই কঠিন।
‘যাও শুনোনা, তোমাদেরও বয়স হবে তখন দেখবে তোমাদের কথাও কেউ আর শুনছে না, এটাই নিয়ম সংসারের’ – এটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠোঁটে মাছ মিষ্টি এন্ড মোর সিনেমার একটি ডায়লগ। চাকরি থেকে অবসর নেয়া স্ত্রী হারা দাদু সৌমিত্র তাঁর সদ্য প্রেমে পড়া নাতিকে যখন নিজের প্রথম চুমো খাওয়ার গল্পটি বলতে উদ্যত হন তখন নাতিটি ব্যস্ততার ভান করে চলে যায় । আর তখনই সৌমিত্র উপরের ডায়লগটি দেন । ডায়লগটি আমাদের সমাজের নির্মম সত্য। ছোট নাতি-নাতনীদের সাথে সময় কাটানো আর যে নাতনী যথেষ্ট বড় এবং সব বোঝে তার সাথে সময় কাটানো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় । বেশিরভাগ সময় মানুষ জীবনের শেষ প্রান্তে যখন এসে পৌঁছায় তখনই তার নিজের গল্পগুলো বলার আগ্রহ বেশি কাজ করে আর ঠিক এই সময়টাতেই তার জন্য কারো সময় থাকেনা (ব্যতিক্রম ছাড়া)। জগারস পার্কের জগিং পার্টনাররা তো জগিং পার্টনারই; তাদের সাথে কী আর জীবনে প্রথম প্রেমপত্র লেখার গল্পটা সেভাবে বলা যায় না বলে সুখ পাওয়া যায়!! বন্ধুবান্ধব যতোই থাকুক আপনজনদের সান্নিধ্য এই সময় বেশি প্রয়োজন হয়। মাদার তেরেসার Loneliness and the feeling of being unwanted is the most terrible poverty এই উক্তিটির মতো– আমার মনে হয় এই অনুভূতিটাই একজন মানুষকে আরও বেশি একলা করে ফেলে , মানসিকভাবে এমন একটা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করায় যে সে অজান্তেই দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। এই দারিদ্র মেনে নেয়া বড় কঠিন!
পরিবারের অবসরে যাওয়া বৃদ্ধ মানুষটির জন্য আমাদের একটু সময় হয়না এটাই সত্যি অথচ তাঁরই তখন গল্প বলার জন্য একজন মানুষ দরকার সবচেয়ে বেশি । লাইফ পার্টনারতো সব শোনার জন্য আছেনই; কিন্তু জীবনের আরও কিছু না বলা অধ্যায় নির্দ্বিধায় বলে যেতে পারেন আসুন আপনি, আমি একজন অবসরে যাওয়া বয়স্ক মানুষের সেই সঙ্গী হই, তাঁর কথা শুনি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট
সারাবাংলা/এমএম