Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যে কথা বলবার কথা ছিল না!


২৪ অক্টোবর ২০১৮ ১২:৫২

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ বনাম ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ -এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের কথা বলবার কথা ছিল না । কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ যেভাবে বায়াত্তরের সংবিধান এদেশে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি, যে কারণে “সেক্যুলার” শব্দটি এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা আজও নাস্তিক্যবাদ হিসেবে দেখে, যে কারণে “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়” বাক্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিতে হয় সে নিরপেক্ষ । ঠিক একই ভাবে, একই পথে, একই জনসমষ্টির সামনে আজ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ একটি বিতর্কিত চেহারা নিয়ে উপস্থিত। এবং সেটিও প্রত্যাশা মতই।

বিজ্ঞাপন

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এই বিষয়টা আমার কাছে একটু হালকা লাগে। মানে এই শব্দগুলো এককভাবে যতখানি ওজনদার তা এই বাক্যের প্রায়োগিকতায় এসে ততখানি ওজন ধরে রাখতে পারছে না। ধর্মীয় উৎসব কিছুটা রিচুয়াল স্পিরিট। যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমিক ভাবে চলে এসেছে এমন প্রথাবদ্ধ বিশ্বাস কিংবা আরোপিত নিয়ম কানুনের সমাহার। এই জায়গাটি থেকে বিচ্যুতি ঘটলে পাপ-পুণ্যের হিসাব নিকাশের মত কিছু ব্যাপার দাঁড়িয়ে যায় । সেটি আখিরাত পরকাল বিশ্বাস যারা করেন কিংবা পূর্বজন্ম ও পুনর্জন্ম বিশ্বাসী সকলের ক্ষেত্রেই হতে পারে। অর্থাৎ বেহেশত-দোযখ বা স্বর্গ-নরক যে ভাষায়ই বলুন না কেন সেখানে জবাবদিহিতা থেকেই যায় । আর তাই এটা সার্বজনীন চেহারা নেয়ার দাবি নিয়েও সার্বজনীন প্রায়োগিকতায় অক্ষম।

বিজ্ঞাপন

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- বিষয়টা তাই আপনার আমার মধ্যে খটকা তৈরি করে। যেমন ধরেন, আমি পূজায় গিয়ে প্রসাদ খেতে পারি। কিন্তু দেবতার সামনে মাথা নিচু করতে পারি না। আবার আমার কোন বন্ধু ঈদে আমার বাসায় বেড়াতে আসতে পারে ফিরনি-জর্দা-সেমাই এমনকি ভরপেট খেতেও পারে । কিন্তু সে তো সকাল বেলা আমার সাথে নামাজ পড়তে যেতে পারে না; উভয়পাক্ষিক চাওয়া থাকা সত্ত্বেও না।

ইউরোপ আমেরিকায় বলা হয় ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। এর কারণ তো সবার জানা। যখন চার্চ ছিল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সেই সময়টায় কে রাজা হবে, কে প্রেসিডেন্ট হবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবে, স্বার্থে আঘাত হানলে আবার কখন কাকে সরিয়ে দিতে হবে… চার্চ এসব নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল । তখন বহু চেষ্টার পর চার্চ এর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করা হল । ক্রমওয়েলের প্রো-পার্লামেন্টারিয়ানরা অনেক চেষ্টা করেও চার্চকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। পরে যখন ইউরোপে রেনেসাঁ আর শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে নতুন যুগের সূচনা হয়, লিবারেল পন্থার রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হতে শুরু করে। মূলতঃ তখনই রাষ্ট্রকে এই “আনবায়াসড” বা সত্যিকার অর্থেই নিরপেক্ষ চরিত্রে প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঠিক এসময়ের রাষ্ট্রনায়করা এই ধারণাটি প্রবর্তন করেন যে, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’…।

এবার যদি আমাদের দেশের দিকে তাকাই, তবে বলতে দ্বিধা নেই যে, আমরা মনে হয় আবার পিছন দিকে যাচ্ছি । দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’- এর মধ্যে থাকা উচিৎ । এই যেমন ধরেন, প্রিন্স বাজারের গরুর দামে ছাড় দেয়ার বিষয়টা কিন্তু ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এর মধ্যে খটকা ।

প্রিন্সের ঘটনাটি কি ইচ্ছাকৃত ? নাকি ভুলে হয়েছে ?- সেই বিতর্কে যাবার আগে দেখি তাদের এই বাণিজ্যিক অফারের মূলে কী রয়েছে? প্রিন্স বাজার তাদের ক্রেতাদের জন্য একটা অফার ছেড়েছে। সেটা হল তাদের অনেকগুলো পণ্যের উপরে মূল্য ছাড় / ডিসকাউন্ট। প্রায় গোটা বিশের উপর পণ্যের এর মধ্যে গরুর মাংসও রয়েছে। যার টার্গেট অডিয়েন্স নিশ্চয়ই যারা গরু খান তারাই। এবং অবশ্যই অন্যরা নয়। এখন এই পুরো অফারটি প্রিন্স বাজার দিয়েছে পূজো উপলক্ষে। যদিও চাইলে আরও একটি যুক্তি দেয়া যায় পোস্টারে লেখা শারদীয় অফার লেখা। সুতরাং সেটা শরৎকালীন ছাড় হিসেবেও হয়ত চালিয়ে দেয়া যেত । কিন্তু যায়নি কারণ মা দুর্গার মুখমণ্ডলখানিকে অন্য কোন ব্যাখ্যার আর সুযোগ রাখে না। অর্থাৎ এটি একটি উৎসব এবং সে উৎসব পূজাকেই উদ্দেশ্য করে। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’-ই যদি হত, তবে উৎসবকে উদ্দেশ্য করে দেয়া একটা অফারে “ধর্মীয় অনূভূতিতে” আঘাত লাগবার কথা ছিল না। লেগেছে কিনা সেটাও বুঝবার উপায় সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। এই অফারে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যতটা না রিঅ্যাক্ট করেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ধর্মের কিন্তু “লিবারেলিজমের” লেবাসে থাকা লোকজন রিঅ্যাক্ট করেছেন অনেক বেশি। যারা ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- বলতেন, তারাই বলছেন উৎসব এর সবটুকু সবার না। যেটুকু ধর্মীয় অনূভুতিতে আঘাত দেয় না, শুধুই সেটুকু সবার। অর্থ্যাৎ ধর্মই শুধু যার যার, উৎসব নয়।

ঠিক এই প্রেক্ষিতেই “উৎসব” আর “রিচুয়াল” এর মধ্যেকার সম্পর্কটাও বলা দরকার। এ দুটির মধ্যে ওভারল্যাপিং এর সুযোগ নেই। রিচুয়াল হল পূর্ব আরোপিত প্রথাসিদ্ধ নিয়ম নীতিমালা । যেটা ধর্মের সাথে হলে আরো বেশি পূর্ব আরোপিত হয়। এবং এর থেকে বিচ্যুতি বা পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই রিচুয়াল এর একটা প্রকাশ হল উৎসব । মানে নিয়ম মেনে উৎসব । তাই

রিচুয়াল মেনে যেই ধর্মীয় উৎসব সেটা সার্বজনীন হতে পারে না। আর এই রিচুয়াল এর ব্যাপারটি যার “বিলিভ সিস্টেম” বা বিশ্বাস প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠে তার একই ভাবে “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” এই আপ্ত বাক্যে বিশ্বাস করার কোন কারণ দেখি না। কেউ দাবী করে থাকলে সেটা তার নিজস্ব সংশয়ের জায়গা।

অতশত ঝামেলায় না গিয়ে বরং চলুন, আমরা আজ থেকে যার যার ধর্ম নিজেরা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করি। উৎসবের দিন অন্যদের বাসায় যাই, মুড়ি-মুরকি-নাড়ু খাই। আমাদের সনাতনসহ অন্যান্য ধর্মের বন্ধুদেরও আমাদের উৎসবে দাওয়াত করি। সেমাই-জর্দা-মিষ্টি-বরফি খাওয়াই। পাশাপাশি তাদের নিজের ধর্মীয় বিষয় খেয়াল রেখে খাবার পরিবেশন করি।

আর একটা কথা, যার যেই ধর্মই হোক না কেন, ব্রিটিশদের দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভুলে গিয়ে, দেশটাকে নিয়ে ভাবি। রাষ্ট্রের উন্নয়নের কথা ভেবে সকল ধর্মের অতি মৌলবাদ এর শিকড়কে গোড়া থেকে উৎপাটিত করি। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি-অর্থনীতি থেকে আমার আপনার ধর্মকে পৃথক রেখে ধর্মকে কলুষিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাই।

সৃষ্টিকর্তা আপনার মঙ্গল করুন।

শান্তা তাওহিদা: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

সিইসি ও ৪ কমিশনারের শপথ আজ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০১:৩৩

আরো

সম্পর্কিত খবর