২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়: একই যাত্রায় ভিন্ন ফল?
২৪ অক্টোবর ২০১৮ ২০:৫০
।। ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ।।
অপরাধ যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপসারণ করার উদ্দেশ্যে মারাত্মক রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নৃশংস আক্রমণ কখনোই বিচারের আওতামুক্ত থাকা উচিত নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার ও সহযোগীদের নৃশংসভাবে হত্যার ফলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েছিল। সেই নৃশংস হত্যার মাত্র একচল্লিশ দিন পর একটি Indemnity Ordinance (ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ) ঘোষণা করা হয়, যার ফলে খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে এই অধ্যাদেশ অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয় এবং ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা’র রায়ের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতি বেরিয়ে আসে এবং সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হয়।
রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের নিকৃষ্ট উদাহরণ হলো যখন একটি রাষ্ট্র বা ওই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকার তার রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী আচরণ শুরু করে। বিদেশি অথবা নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কর্তৃক এই ধরনের সন্ত্রাসবাদকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ আদতে খুবই হতাশাজনক। কেননা নাগরিকদের জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মূলত একটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। আর সেখানে কিনা রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকদের জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা হরণ করে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে?
‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা’ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের নগ্ন উদাহরণ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বিরাজনীতিকরণের জন্য তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং দলের অন্যান্য সদস্যদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালায়। শুধু তা-ই নয়, সেই বর্বর গ্রেনেড হামলার পরে তৎকালীন বিএনপি সরকার মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত উধাও করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। একইসঙ্গে গ্রেনেড হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা রাজনৈতিক নাটকও সাজায়। এ কারণেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদকে রুখে দেওয়ার জন্য এবং সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
আবার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় কেবল বাংলাদেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এই রায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সমগ্র দক্ষিণ-এশীয় রাষ্ট্রগুলোর জন্যও হয়ে উঠবে একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। আমরা দেখেছি, দক্ষিণ-এশীয় রাষ্ট্রগুলো নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের উর্বর আবাসভূমি। পাকিস্তানের লিয়াকত আলী খান হত্যাকাণ্ড (১৯৫১), মুহাম্মাদ জিয়াউল হক হত্যাকাণ্ড (১৯৮৮) অথবা বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ড (২০০৭); ভারতের মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী হত্যাকাণ্ড (১৯৪৮), ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড (১৯৮৪) অথবা রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড (১৯৯১); শ্রীলঙ্কাতে বান্দারনেয়েকে হত্যাকাণ্ড (১৯৫৯), ভিজায়া কুমারানাতুঙ্গা হত্যাকাণ্ড অথবা রানাসিংহে প্রেমাদাসা হত্যাকাণ্ড (১৯৯৩); ভূটানের জিগমে পালডেন দর্জি হত্যাকাণ্ড (১৯৬৪) কিংবা মালদ্বীপের ড. আফরাশিম আলী হত্যাকাণ্ড (২০১২) ইতিহাসের পুনারাবৃত্তি ঘটিয়েছে বার বার। এর সবই ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের’ নগ্ন উল্লাস। সুতরাং, গণতান্ত্রিক সমাজ রক্ষায় ও এসব জঘন্য ধারাবাহিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের ইতি টানতে এবং প্রকৃত অপরাধী ও তাদের মদতদাতাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা অপরিহার্য।
অবশেষে ১৪ বছর পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হলো! মামলার জীবিত ৪৯ আসামির মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, মাওলানা তাজউদ্দিন, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এছাড়াও মামলায় সরাসরি সংশ্লিষ্টতার দায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-১-এ রায় ঘোষণার সময় ৩১ জন আসামি আদালতে হাজির ছিল। মামলার পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
মামলাতে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য মোট ১৪টি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে ৭ নম্বর বিবেচ্য বিষয় ছিল— “গুলশান থানার লালাসরাই মৌজার ১৩ নম্বর রোডের ব্লক-ডি, বাড়ি নম্বর-৫৩, বনানী মডেল টাউনের জনৈক আশেক আহমেদ, বাবা-আবদুল খালেক; তার বাসাটি ‘হাওয়া ভবন’ নামে পরিচিত। ওই ‘হাওয়া ভবন’ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কিনা? ওই ঘটনাস্থলে পলাতক আসামি তারেক রহমান অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্রমূলক সভা করে কিনা ও জঙ্গি নেতারা তারেক রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন সময় মিটিং করে কিনা?”
নিঃসন্দেহে আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে হাওয়া ভবনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আর সে কারণেই আসামি তারেক জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন আদালত। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও তারেক জিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো না কেন?
আদালতের ১০ থেকে ১৩ নম্বর বিবেচ্য বিষয় ছিল—
১০. অভিন্ন অভিপ্রায়ে ও পূর্বপরিকল্পনার আলোকে পরস্পর যোগসাজশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটনায় জড়িত আসামিদের গ্রেনেড আক্রমণ চালানোর সুবিধার জন্য ও অপরাধীদের রক্ষার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা।
১১. অভিন্ন অভিপ্রায় ও পূর্বপরিকল্পনার আলোকে প্রশাসনিক সহায়তা দিয়ে মামলার ঘটনায় ব্যবহৃত অবিস্ফোরিত সংরক্ষণযোগ্য তাজা গ্রেনেড আলামত হিসেবে জব্দ করার পরও তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে এবং আদালতের অনুমতি না নিয়ে অপরাধীদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংস করার ও আলামত নষ্ট করায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা।
১২. অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত সভা ও পূর্বপরিকল্পনার আলোকে পরস্পর যোগসাজশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মূল আসামিদের সহায়তা করার লক্ষ্যে আসামিদের নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে ও পরবর্তী সময়ে আসামিদের অপরাধের দায় থেকে বাঁচানোর সুযোগ করে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা।
১৩. প্রকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের রক্ষা করার জন্য প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে অন্য লোকের ওপর দায় বা দোষ চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার লক্ষ্যে মিথ্যা ও বানোয়াট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা।
ওপরের সবগুলো বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সচেষ্ট ষড়যন্ত্রের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা এটাও জেনেছি, তদন্তে ও আসামিদের জবানবন্দিতে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে শুধু তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর-ই নন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা খালেদা জিয়াও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি নিজেও হামলার আলামত নষ্ট করার আদেশ দিয়েছিলেন এবং ডিজিএফআইকে এ হামলা সম্পর্কে তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। তাহলে আমার প্রশ্ন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সচেষ্ট ষড়যন্ত্রের কারণে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেগম জিয়াকে ছাড় দেওয়া হলো কেন?
আশা করছি, পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে।
লেখক: প্রসিকিউটর, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল
সারাবাংলা/টিআর