সংলাপে প্রাপ্তিযোগ কম ঐক্যফ্রন্টের, দায় কার?
২ নভেম্বর ২০১৮ ১৯:০৪
আমিনুল হক পলাশ||
১ নভেম্বর রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপ। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন রাজনীতির ময়দানে উত্তপ্ত লু হাওয়া বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলেন অনেকে ঠিক সেই মূহুর্তে এই সংলাপ নিঃসন্দেহে আগমণী শীতের হিমেল হাওয়ার মতো স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। আরেকটি কারণে এই সংলাপ বিশেষ তাৎপর্যের দাবি রাখে। সেটি হলো- এই আলোচনায় নেতৃত্বদানকারী দুটি পক্ষই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি। সংলাপে যদিও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে দোসর বানানো বিএনপি নেতাদের উপস্থিতি ছিলো তথাপি তাদেরকেও আসতে হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে, এককভাবে নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির গুনগত মান উন্নয়নে এই সংলাপ তাই একটি মাইলফলক হয়েই থাকবে।
সহজেই অনুমেয় যে ঐক্যফ্রন্ট তাদের আন্দোলনের কৌশল হিসেবেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই আহবানে সাড়া না দিলে ঐক্যফ্রন্ট সেটিকে সরকার তথা আওয়ামীলীগের স্বদিচ্ছার অভাব হিসেবে সর্বস্তরে প্রচার করার সুযোগ পেতো। হয়তোবা সেটি তাদের আন্দোলনের পালে কিঞ্চিৎ হাওয়াও জোগাত। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বিদগ্ধ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি তাদেরকে সে সুযোগটুকু পেতে দেয়নি। তাইতো দ্রুততম সময়ে সংলাপের আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি নিজেই সংলাপে বসেছেন ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সাথে। এর মাধ্যমে মূলত সংলাপ শুরু হবার পূর্বেই শেখ হাসিনা সংলাপের মূল নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন যা প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা ব্যাপী চলমান সংলাপ শেষেও অটুট ছিলো।
মিডিয়ার কল্যাণে সংলাপকালে আলোচিত প্রায় সবকিছুই এখন আমাদের জানা। সংলাপ পরবর্তী প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল এবং ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যও আমাদের জানা হয়েছে। সংলাপ শেষে আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সংলাপে উপস্থিত অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অনেকটা খোশমেজাজেই কথা বলেছেন মিডিয়ার সাথে। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের কপালের ভাঁজটুকু যে আরেকটু দীর্ঘ হয়েছে সেটি বুঝতেও কারও সমস্যা হয়নি। গণভবন থেকে বের হয়েই ড. কামাল হোসেন যদিও সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে আলোচনা ভাল হয়েছে। কিন্তু তার কথার সাথে মিল পাওয়া যায়নি ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শক্তি বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুলের বক্তব্যে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মীর্জা ফখরুল বলেছেন, সংলাপে বিএনপি সন্তুষ্ট নয়। ড. কামালের বাসায় অনুষ্ঠিত হওয়া প্রেসব্রিফিংয়েও তিনি বলছেন, চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না। তাদের প্রতিক্রিয়াতেই এটি স্পষ্ট যে আলোচনার টেবিলের দ্বৈরথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতার কাছে ধরাশায়ী হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট।
আলোচনা পরবর্তী আলাপচারিতায় এটা সুস্পষ্ট যে যথাযথ হোমওয়ার্ক ছাড়াই সংলাপে বসেছিলেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। একমাত্র বিএনপি ছাড়া অন্য যেসব নেতৃবৃন্দ ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন তাদেরও জনসম্পৃক্ততার কোন নজির নিকট অতীতে নেই। রাজনীতির অন্ধগলিতে পায়ের তলায় একটু জমিন পাবার আসায় নিত্য ছুটাছুটিতে ব্যস্ত তারা। অন্যদিকে টানা দুই মেয়াদে সরকারের দায়িত্বে থাকা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ১৪ দলের নেতৃবৃন্দের সকলেরই রাজনৈতিক অলিগলির প্রতিটি ধাপ হাতের তালুর মতোই চেনা, বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কেও উনারা সম্যক অবগত। তাই আলোচনার টেবিলটি যে গালিভার আর লিলিপুটের দ্বৈরথে পরিণত হবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।
সংলাপ থেকে যে ঐক্যজোটের প্রাপ্তিযোগ খুব একটা হবে না, সেটা তাদের ৭ দফা দাবিগুলো একটু বিশ্লেষণ করেই আন্দাজ করা গিয়েছিলো। কেননা এই দাবিগুলোরও বেশিরভাগই সংবিধানসম্মত নয়। অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই গৎবাঁধা কিছু কথা দিয়ে সাজানো হয়েছে এই ৭ দফা। এই দফাসমূহকে অযৌক্তিক, অসাড় ও বাস্তবতা বিবর্জিত বললেও অত্যুক্তি হবে। যদিও বলা হচ্ছে ৭ দফা তবে এর মাঝেই মোটামুটি ১৫ টি দাবিকে ঠেসে ঢুকানো হয়েছে। ফলে সুনির্দিষ্ট কোন বিষয়ে আলোচনার সুযোগ সংলাপে যাবার আগেই হারিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। নির্মোহভাবে এই দাবিগুলো একটু আলোচনা করা যাক।
ঐক্যফ্রন্টের প্রথম দফায় রয়েছে অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ সকল ‘রাজবন্দীর’ মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এই দফার প্রথম তিনটি দাবিই সংবিধান সম্মত নয়। তাছাড়া বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশন সমাপ্ত হয়েছে, সংসদ বর্তমানে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া নির্বাচনের পূর্বে আর অধিবেশন ডাকা হবে না। সেই হিসাবে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। একই ভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কোন বিধানও সংবিধানে নেই তাই এটি নিয়ে আলোচনা অবকাশ নেই। সংবিধানের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে সরকার যা করতে পারে তা হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করা। সেটি ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিটি মূলত বিএনপির চাপেই ঐক্যফ্রন্ট যোগ করতে বাধ্য হয়েছে। এটি সম্পূর্ণভাবেই আদালতের এখতিয়ার। উপরন্তু খালেদা জিয়া কোন রাজনৈতিক মামলায় কারাদণ্ড পাননি, উনি দূর্নীতির মামলা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। এই মামলাগুলোও আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে দায়ের হয়নি। উচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত একজন প্রমাণিত অপরাধীর মুক্তি কোন সংলাপের দাবি হতে পারে না।
দ্বিতীয় দফার রয়েছে, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করেই বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। এই নির্বাচন কমিশনে বিএনপি থেকে সুপারিশকৃত ব্যক্তিও জায়গা পেয়েছেন। এই কমিশনের অধীনেই বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে হয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং তাদের মনোনীত প্রার্থীরা জয়লাভও করেছে। তাই কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবির কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। ইভিএমের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে বারবার বলা হয়েছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। ইতোমধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে সফলতাও পাওয়া গিয়েছে। ইভিএম ব্যবহার নিঃসন্দেহে নির্বাচনকে আরো স্বচ্ছ করবে যা গণতান্ত্রিক সকল দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ইভিএম ব্যবহারে সমস্যা কোথায় সেই ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য ঐক্যফ্রন্ট দিতে পারেনি।
তৃতীয় দফায় রয়েছে বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সকল রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্যফ্রন্ট বিশেষ করে বিএনপির নেতারা নিয়মিত টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিচ্ছেন, পত্রিকায় কলাম লিখছেন। তাদের সকল কর্মসূচি প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। তারপরও তারা কিভাবে দাবি করেন যে তারা মতপ্রকাশ করতে পারছেন না? ঐক্যফ্রন্ট তাদের প্রতিটি সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে। সিলেট ও খুলনাতে তারা জনসমাবেশ করছে। বিএনপিও নিয়মিত বাধাহীনভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করছে। বাকি থাকলো নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ব্যাপার। এটা এককভাবে সরকারের দায় নয় বরং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলের দায়িত্ব। গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বিএনপিই নির্বাচন বানচালের সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিলো, হরতাল দিয়েছিলো, জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। তাই বিএনপিই যখন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলে তা কিছুটা হাস্যকর শোনায় বৈকি!
চতুর্থ দফায় ঐক্যফ্রন্ট দাবি করেছে কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়কের আন্দোলন সহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দোলনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তা প্রত্যাহার করতে হবে এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে। একইসাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল কালো আইন বাতিল করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে কোটা সংস্কার কিংবা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করার অপরাধে কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং সরকার ইতোমধ্যেই যৌক্তিক সকল দাবি মেনে নিয়ে সেগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এইসব আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে যারা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টিত পায়তারা করেছে এবং রাষ্ট্রবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠিক তাই করেছে। এই দফার অন্য দাবিটি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল কালো আইন বাতিল করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোন ধারাগুলোর বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের আপত্তি রয়েছে এবং সকল কালো আইন বলতে কোনগুলোকে বুঝানো হয়েছে সেই সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত তারা দিতে পারেনি।
পঞ্চম দফায় রয়েছে নির্বাচনে ১০ দিন পূর্ব থেকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন ব্যতীত অন্যকোন জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের নজির নেই। তাছাড়া দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থির বর্তমান অবস্থার সাথেও এই দাবিটি সংগতিপূর্ণ নয়। তথাপি প্রয়োজন মনে করলে নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতিকে এই ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারে। এতে সরকারের কোন ভূমিকা নেই। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা উচিৎ। ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ডাঃ জাফরুল্লাহ কিছুদিন পূর্বেই সেনাপ্রধান সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে জঘন্য মিথ্যাচার করেছেন যা নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে আহত করেছে, আমাদের গর্বের সেনাবাহিনী সম্পর্কে মানুষকে ভুল ধারনা দিয়েছে। একদিকে তাদের নেতারা সেনাবাহিনী সম্পর্কে মিথ্যাচার করবেন আবার তারাই নির্বাচনে সেনা মোতায়েন চাইবেন, এই দ্বিচারিতা কেন? আর এই দফার শেষ যে দাবিটি তারা করেছেন সেই ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবেই নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। তবুও কেন তারা এটি তাদের আন্দোলনের দফা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, কে জানে!
ষষ্ঠ দফাটি হলো নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে। এই দাবিটিই সবচেয়ে অবাক করার মতো। কেননা নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়ার দায়িত্ব সরকারের নয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যদি কষ্ট করে একবার নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে ঢুকে সেই নীতিমালাটি পড়ে দেখতেন তাহলে এই দফাটি অন্তত কষ্ট করে তাদের আর উল্লেখ করতে হতো না। ওয়েবসাইট থেকে তারা আরো জানতে পেতেন যে ইতোমধ্যেই ১১৮টি দেশি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়েছে। তারা তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী দেশব্যাপী অথবা অঞ্চলভিত্তিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। এর বাইরে আগ্রহী আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাসমূহ নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে সহজেই নির্বাচন পর্যবেক্ষনের দায়িত্ব পালন করতে পারে। সরকার শুধুমাত্র এই ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এখন ঐক্যফ্রন্টের যদি নীতিমালার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য বা আপত্তি থাকে তাহলে সেটি তারা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে পারে। কিন্তু তারা তো তা করেনি। এই দফার দ্বিতীয় দাবিটি হলো নির্বাচনের সময় গণমাধ্যম কর্মীদের উপর যেকোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে। নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের সময়েই গণমাধ্যমকর্মীরা সর্বোচ্চ স্বাধীনভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাচ্ছেন। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচনেও তারা সম্পূর্ণ স্বাধিনভাবেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঐক্যফ্রন্টের শেষ দাবিটি হলো, নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও কোনো ধরনের নতুন মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। ‘রাজনৈতিক মামলা’ টার্মটি একটি হাইপোথেটিক্যাল টার্ম। কোন কোন মামলাকে রাজনৈতিক মামলা বলা যায় তার সুনির্দিষ্ট কোন মাপকাঠি নেই। আন্দোলনের নামে কেউ সহিংসতা করলে, মানুষের জানমালের ক্ষতিসাধন করলে, জননিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটালে সেটার প্রতিবিধান করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাংবিধানিক দায়িত্ব। তাদেরকে এই দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা সরকার প্রদান করতে পারে না।
অতএব ঐক্যফ্রন্টের এই সাতটি দফা আলোচনা করলেই বোঝা তারা অনেকটা লক্ষ্যহীন ও অদক্ষ নাবিকের মতোই ভুলপথে, ভুল উপায়ে জাহাজ চালিয়ে তীরে ভেরাতে চাচ্ছেন। যা কখনোই হবার নয়। তাদের দাবিগুলো অযৌক্তিক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত বলেই এই দাবিগুলোর স্বপক্ষে কোন জনসমর্থন তারা আদায় করতে পারেননি। তারা তাদের সমাবেশে দাবি করছেন এই সাতদফা জনগণের দাবি, কিন্তু এই সাতদফা তৈরির কোন পর্যায়েই তারা তো জনগণের মতামত নেননি। একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজের মুক্তির দাবি তো জনগণের দাবি হতে পারে না। এই কথা বলার মধ্য দিয়ে তো তারা নিজেরাই জনগণের সাথে প্রতারণা করছেন।
এই সংলাপে কার প্রাপ্তিযোগ কতটুকু হয়েছে সেটার ব্যাপারে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে এই সংলাপ সুস্থধারার রাজনৈতিক চর্চার পক্ষে একটি ভাল উদাহরণ তৈরি করেছে। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ফোন করেছিলেন। সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি জ্বালাও পোড়াও এর পথ বেছে নিয়েছিল, জনগণের জানমালের ক্ষতিসাধনে লিপ্ত হয়েছিল। এর ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা যে অন্ধকারের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হয়েছিল তা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই তাদেরকে ড. কামালের নেতৃত্বে সংলাপে যেতে হয়েছে, এতোটাই রাজনৈতিক দৈন্যতায় পতিত হয়েছে তারা। তবুও এই সংলাপ থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি তারা সুস্থধারার রাজনীতিতে ফিরে আসে দেশের গণতন্ত্রের জন্য সেটিই হবে মঙ্গলজনক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ও উদারতার প্রমাণ দিয়েছেন। বল এখন ঐক্যফ্রন্টের কোর্টে। এই সুযোগ যদি তারা কাজে লাগাতে না পারে তাহলে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
আমিনুল হক পলাশ: ছাত্রলীগের সাবেক নেতা
সারাবাংলা/এমএম