হাজার হৃদয়ের সামনে খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার
৯ নভেম্বর ২০১৮ ১৭:৪১
ছড়াকার, অ্যাক্টিভিস্ট, প্রকাশক রবিন আহসানের ওয়ালে ছবিটি দেখে আমি আরেকটা সংগ্রামী ছেলের কাহিনী , আরেকটা জীবনযুদ্ধ জয়ের উপাখ্যান, আরেকটা অদম্য মেধাবীর গল্প পড়ার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দ্রুত পেয়ে গেলাম সারাবাংলা.নেট- এ প্রকাশিত খবরের লিংকটিও। কিন্তু পড়তে গিয়ে প্রবল ধাক্কা খেলাম। এত গল্প নয়, ছোট গল্প। তার সংগ্রাম ‘শেষ হইয়াও, হইলো না শেষ’।
নেত্রকোনার হৃদয় সরকার ‘সেরিব্রাল পালসি’তে আক্রান্ত। ছেলেবেলা থেকেই তিনি হাঁটতে পারেন না। তার হাতের সবগুলো আঙ্গুলও কাজ করে না। গ্রামের এমন একটি ছেলের কী করার কথা ছিল? এই ছেলেটি যদি রাস্তার পাশে বসে ভিক্ষা করতেন, সেটাই হতো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় স্বাভাবিক। কিন্তু হৃদয় সরকার অন্যরকম। তিনি যেটা স্বাভাবিক, সেটা না করে খরস্রোতা জীবননদীতে উজানে সাঁতার দেন। হৃদয় এসএসসিতে ৪.০৬, এইচএসসিতে ৪.৫০ জিপিএ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
হৃদয় সরকারের যুদ্ধটা একার নয়। তার মা সীমা সরকারও আছেন তার সাথে। হাঁটতে না পারা ছেলে হৃদয় সরকারকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে গেছেন, কলেজে নিয়ে গেছেন। সেই ছেলেকে নিয়ে দেশের সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছে গেছেন সীমা সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা ছেলেকে মা কোলে করে নিয়ে আসছেন, এমন অসাধারন দৃশ্য অনেকদিন দেখেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর মায়ের কোলে চড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিল হৃদয় সরকার। পরীক্ষায় পাসও করেছে হৃদয়। ৫ নভেম্বর ‘খ’ ইউনিটে কোটায় ৯ জনকে ডাকা হয়। হৃদয়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকারা ডাক পেলেও ডাকা হয়নি তাকে। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে এলো বৈষম্যের এক অন্ধকার অধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী দৃষ্টি, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীরাই কেবল কোটা পায়; অন্য শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতাকে তারা স্বীকার করে না। হতে পারে নিয়মটি যখন করা হয়, তখন প্রতিবন্ধী বিষয়ক ভাবনা এত বিস্তৃত ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাষ্ট্র এগিয়েছে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। সরকার কিন্তু হৃদয় সরকারকে প্রতিবন্ধী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু নিয়মের দোহাই দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেটা মানতে রাজি নয়; কারণ হৃদয় দৃষ্টি, শ্রবণ বা বাক প্রতিবন্ধী নন। হা হা হা। শুনে প্রথমে হাসি পায়, পরে ক্রোধ হয়। একবিংশ শতাব্দীতে দেশের সেরা বিদ্যাপিঠ এতটা কুপমন্ডুক হয় কিভাবে? দেখে তো মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধী। হৃদয় সরকারের মাকে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন জানিয়ে দেন, তার ছেলেকে ভর্তি করা যাবে না। সাংবাদিকদের কাছেও তিনি একই কথা বলেছেন, নিয়ম না পাল্টালে হৃদয় সরকারের মত প্রতিবন্ধীদের কোটা সুবিধা দেয়া সম্ভব নয়। আর এ বছর এটা পাল্টানোর সুযোগ নেই। কলা অনুষদের ডিনের কথা শুনে বিস্মিত হতেও পারছিলাম না। আমার ধারণা ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে বছরের পর বছর ধরে এমন একটি বৈষম্য লালন করছে, জানার সাথে সাথে সেটা গোপনে বদলে ফেলা হবে; যাতে তাদের এই অন্ধকারের কথা কেউ জানতে না পারে। কিন্তু এ দেখি উল্টো। ডিন বুক ফুলিয়ে বলছেন, আমরা শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে স্বীকার করি না। আমরা বৈষম্য করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন অপরাজেয় বাংলার মত, পাথুরে, হৃদয়হীন। নিয়ম তো করা হয় মানুষের সুবিধার জন্য, যোগ্য কাউকে আটকে নাখার জন্য নয়। আমার ধারনা টাইম মেশিনে চড়ে স্টিফেন হকিংও যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসতেন, তখনও বোধহয় ডিন মহাশয় মুখ গম্ভীর করে বলে দিতেন, সরি মি. হকিং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটর নিউরন রোগে আক্রান্তদের জন্য কোটা নেই। ভর্তি হতে হলে আপনাকে দৃষ্টি, বাক বা শ্রবণ প্রতিবন্ধী হতে হবে।
কিন্তু হৃদয় সরকারের ছোটগল্প থেমে যায়নি। গল্পে নতুন মোড়। এ লেখা লিখতে লিখতেই জানলাম ৮ নভেম্বর ডিনস কমিটির সভায় হৃদয় সরকারকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যুদ্ধের একটা পর্যায়ে জিতেছেন হৃদয় সরকার আর তার মা সীমা সরকার। সামনে আরো বড় লড়াই। যুদ্ধের ময়দান আরো বড়, আরো কঠিন। যুদ্ধের এ পর্যায়ের জয়ে হৃদয় সরকারের পাশে পেয়েছে সামাজিক মাধ্যম আর গণমাধ্যমকে। জনমতের প্রবল চাপে মাত্র তিন দিনেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাথর হৃদয় গলেছে; আসলে গলতে বাধ্য হয়েছে। এই ঘটনার জন্য ধন্যবাদ পাবে সারাবাংলাডটনেট। আরো নির্দিষ্ট করে বললে কবির কানন। রবিন আহসানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্রেই হৃদয় সরকারকে নিয়ে কবির কাননের রিপোর্ট দেখি। শুধু একটা রিপোর্ট করে থেমে যাননি কবির। দিনের পর দিন আলো ফেলে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যের অন্ধকারে। শেষ পর্যন্ত সেই আলোয় চোখ খুলেছে, মন গলেছে। কখনো কখনো গণমাধ্যম নিয়ে হতাশার সময়, এমন কিছু কাজ আমাদের আশাবাদী করে। গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে একধরনের তৃপ্তি আসে মনে।
শুধু হৃদয়কে ভর্তি করলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এতদিনের বৈষম্যের প্রায়শ্চিত্য হবে না। হৃদয় যাতে নির্বিঘ্নে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলাফেরা করতে পারে সে জন্য তাকে একটি আধুনিক হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং ক্লাশরুমের সিড়িতে র্যাম্পের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকে বলতে পারেন, একজনের জন্য এতকিছু? হুম, একজনের জন্যই এতকিছু করতে হবে। এটাই ন্যায্য অধিকার। সমান অধিকারের ধুয়া তুলে যেন আমরা হৃদয়দের পিছিয়ে না রাখি। যার যতটুকু দরকার, রাষ্ট্র তাকে ততটুকুই দেবে। হৃদয়ের বেশি সাহায্য দরকার, তাই তাকে বেশি দিতে হবে। জাপানে এক গ্রামের একজন ছাত্র ট্রেনে শহরের স্কুলে যায় বলে সেই রেললাইনটি চালু ছিল। সেই ছাত্রটিই ছিল একমাত্র যাত্রী। সেই ছাত্রটির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই বন্ধ হয়ে যাবে লাইনটি। আধুনিক, ন্যায্য ও সভ্য সমাজে বিষয়গুলো এমনই। আমরা হয়তো জাপানের মত পারবো না। কিন্তু আমরা যেন সর্বস্ব নিয়ে হৃদয়দের পাশে দাড়াই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন হৃদয়কে বোঝা মনে না করে। মায়ের কোলে হৃদয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসার ছবিটিই হতে পারে একটি মানবিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সাইনবোর্ড। হৃদয়ের লড়াই-সংগ্রামের গল্প অনুপ্রাণিত করতে পারে আরো হাজারো ছাত্রকে।
সারাবাংলা বা কবির কিন্তু একজন হৃদয়ের জন্য লড়াইটা করেনি। হৃদয়ের এই জয় আরো অনেক হৃদয়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলে দিতে পারে। আরো অনেক প্রতিবন্ধী কোটা সুবিধা নিয়ে নিজেদের স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে পারবে। তবে এই বৈষম্যমূলক নিয়মের কারণে এতদিন যারা ভর্তির সুযোগ পাননি, তাদের জন্য অাফসোস ছাড়া আর কিছু করার নেই।
হৃদয় সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে, এটা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন তার মা সীমা সরকার। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক সংগ্রামের পর স্বাধীন হলে কেমন লাগে, আমার তেমনই লাগছে, আমার স্বাধীনতার মতো সুখ লাগছে।’ সীমা সরকারকে অভিনন্দন। তার এই স্বাধীনতার সুখ ছড়িয়ে পড়ুক আরো হাজার হৃদয়ের মায়ের মনে। তবে স্বাধীনতার অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। এখন মা- ছেলের এই যুদ্ধ কঠিনতম। তবে মানবিক বাংলাদেশ এই যুদ্ধে তাদের পাশেই থাকবে।
প্রভাষ আমিন
৯ নভেম্বর, ২০১৮