ভোটে বাংলাদেশ
১২ নভেম্বর ২০১৮ ১৩:৩০
।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।।
অনেকদিন ধরে আলোচনা আর বিতর্ক। কেমন হবে নির্বাচন? নির্বাচন এলে যা হয়, তা এবারও হয়েছে। নানা জোট ও ব্যক্তির তৎপরতায় মুখর হয়ে উঠে রাজনীতির অঙ্গন। এবারের চমক ড. কামাল হোসেন। তিনি হাল ধরেছেন বিএনপির। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা, বর্তমানে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএনপি’র জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে দু’দফা সংলাপের পর দেশে এখন ভোটের উৎসব শুরু হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সাত দফা দাবি দিয়েছিল, তার কোনোটিই আদায় হয়নি। তবুও তারা নির্বাচনে এসেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই।
সংলাপ নিয়ে উৎসাহ ছিল, উৎকণ্ঠা ছিল। অফিস-আদালত, স্কুল কলেজ হাট-বাজারে ব্যস্ততা, ছুটোছুটি ছিল। এখন সব শীতল। এখন অন্যরকম উত্তেজনা। প্রতি পাঁচ বছর বছর এমনটাই হয়, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। বরং এবার একটু বেশিই। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি একটা সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু এবার যেন অনেক বড় এই ভোট। এদেশে ভোট মানে দেশ শাসনের অধিকার পাওয়া। ভোটের দামামা একটু একটু করে বাজতে শুরু করা মাত্রই দলীয় মনোনয়ন কেনার হিড়িক দেখা গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ, সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট, ড. কামাল হোসেন ও বিএনপির ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল – সব শিবিরই এখন ভোটযুদ্ধে।
সেই যুদ্ধে সবচেয়ে আলোচিত নাম জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন। তার ভোট ব্যাংক নেই, কিন্তু তিনি প্রভাবশালী। এবং তাকে ধন্যবাদ দিতে হয় এজন্য যে, তিনি বাংলাদেশের বাতাসে একটা ভোট রোমাঞ্চ ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। তাই পথে ঘাটে অফিস পাড়ায় সর্বত্র এখন ভোটের আমেজ। উৎসবের জমিতে আর অন্য বিষয় নেই এখন।
রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভোটযুদ্ধের প্রস্তুতিতে একটু একটু করে জোর বাড়তে শুরু করেছে তেমনি জনমনে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা বাদ-বিতর্কও শুরু হয়ে গেছে। নতুন সংসদে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন আধিপত্য বজায় থাকবে নাকি, ২০০১-এর পর হাওয়া ভবন কেলেঙ্কারি, একের পর এক জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান, সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা, একুশে আগস্টসহ নানা ঘটনায় খাদের কিনারে চলে যাওয়া বিএনপি-জামায়াত জোট স্বমহিমায় ফিরবে, নাকি দেশের প্রথম সুশীল প্রধানমন্ত্রী হবেন ড. কামাল— পথেঘাটে অফিসে আড্ডায় এমন অজস্র প্রশ্ন উড়তে শুরু করেছে।
বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার দশ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের উন্নযন যেমন ব্যাপক আলোচিত, তেমনি আলোচিত ব্যাংক কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে কোটা ও নিরাপদ সড়ক চাইয়ের মতো আন্দোলনে সরকার ও সরকারি দলের ভূমিকা ও নানা ধরনের কাণ্ড যা সুশানকে অনেক সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আলোচনায় আরও আছে, হেফাজতে ইসলামের মত কট্টর ইসলামী গ্রুপের সঙ্গে মহাবিরোধ, আবার শেষ সময়ে এসে তাদের সঙ্গেই সখ্যতা।
নতুন এক বিরাট জনগোষ্ঠী এবার ভোট দিচ্ছে। গবেষণা ও উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান কলরেডি বলছে, তরুণ প্রজন্মের ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ চায় বর্তমান সরকার আবার ক্ষমতায় আসুক। তরুণদের ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তবে জরিপে অংশ নেওয়া ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ এই সরকারের দুর্নীতি নিয়ে অসন্তুষ্ট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন ভোটারদের ভাবনা’ শীর্ষক এক গবেষণা জরিপের ফলাফলে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া ৩০ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ আসন্ন নির্বাচনে পরিবর্তন দেখতে চায় এবং ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ নির্বাচন বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেননি। তরুণদের ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ চায় একটি দুর্নীতিমুক্ত সরকার, আর ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ চায় সুশাসনের সরকার।
এমন জরিপ, বিবাদ-বিতর্ক যাই থাকুক, এই মুহূর্তে পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে হয়ে আছে যে অতি বড় রাজনৈতিক বিশ্লেষকও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছেন না। তবে, নির্বাচনে শেখ হাসিনার প্রাধান্য কিছুটা হলেও বজায় থাকবে এমন ইঙ্গিতই উঠে এসেছে প্রায় সব আলোচনায়।
শেখ হাসিনার এই দশটি বছর নিয়ে নানামুখী আলোচনা হতে পারে। উন্নয়ন হয়েছে, মানুষের আয় ও ব্যয় সক্ষমতা বেড়েছে, বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারের নানা কারণে ইতিবাচকভাবে আলোচিত এটা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি ব্যাংক কেলেঙ্কারি, অনেক ক্ষেত্রেই সুশাসনের অভাব, নির্বাচনী সংস্কৃতির মান নিচে নেমে যাওয়া ইত্যাদি। পুরো দশটি বছরই শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি মোকাবেলা করতে হয়েছে সন্ত্রাস ও সহিংসতা। যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে তাকে যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে, তা ছিল আরেক ১৯৭১। রাজনৈতিক সহিংসতা কত ভয়নাক হতে পারে তার নজির দেখেছে মানুষ যখন তারা মাসের পর মাস পুড়েছে পেট্রল বোমা নামের আগুন সন্ত্রাসে। এই যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা থেকেই শুরু হয় জঙ্গি উত্থান, যার বড় আক্রমণ ছিল গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে হামলা করে বিদেশি হত্যা অবশ্য এর আগে থেকেই মুক্তমনা লেখকদের হত্যার পাশাপাশি চলছিল বিদেশি নাগরিক পুলিশ প্রশাসনে অত্যন্ত দক্ষতায় শেষ পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। শেখ হাসিনার প্রশাসন ও পুলিশের নামে যারা অহোরাত্র বদনাম করেন তাদেরও মুখ কার্যত বন্ধ হয়েছিল একের পর এক জঙ্গি খতমে।
তবুও আসন্ন ভোটযুদ্ধের আগে নিশ্চিত হতে পারছে না, সমীক্ষার এসব ফল ইতিবাচক হবে কিনা সে বিষয়ে। মানুষের মন ইতিবাচক বিষয যত মনে রাখে, নেতিবাচক বিষয় লালন করে তার চেয়ে বেশি। তার ওপর যদি যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তার ওপর ক্ষোভ থাকে অনেক বেশি।
ডিসেম্বরের মধ্যেই মানুষ রায় দেবে নৌকা না ধানের শীষ তারা চায়। অনেকের ধারণা, ২০০৮-এর মতো না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মহাজোটের আধিপত্য থাকবে। এই ধারণার পেছনে আছে বাস্তবতা। গত দশ বছরের শাসনে দেশে তিনি দেশের সর্বস্তরে যে বিপুল উন্নয়ন ঘটিয়েছেন সে সব তো কেউ আজ অস্বীকার করতে পারছে না। আর এই উন্নয়নের সুবাদে ব্যাক্তি শেখ হাসিনা যে বিপুল জনসমর্থন পেয়েছেন এবং পেয়েই চলেছেন সেটাই নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে ভোটে।
তারপরও ড. কামাল হোসেন হাল ধরার পর আরেক প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াত ধরে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তারা দেশব্যাপী লড়াই দিতে পারবে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি। ড. কামাল নিজে কোন কেন্দ্র থেকে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন তা এখনও জানানি, শুধু একবার বলেছেন তিনি নির্বাচন করবেন না। তবে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার কোনো আসন থেকে নির্বাচন করলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ সারাবাংলা.নেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি