হিরো আলম, গণমাধ্যম এবং…
২২ নভেম্বর ২০১৮ ১৩:২২
সাইফুল হাসান ।।
বগুড়ার এরুলিয়া গ্রামের ‘হিরো আলম’ এই মুহুর্তে সত্যিকারের হিরো। তাকে ঘিরে তুমুল আলোচনা। গন্যমান্যরা তার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তর্কের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনের এই মওসুমে বিনে পয়সায় এমন প্রচার পাওয়া সৌভাগ্যের। নিঃসন্দেহে হিরো আলম চরম সৌভাগ্যবানদের একজন।
তিনি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বড় হয়েছেন পালক পিতার পরিবারে। ক্লাস সেভেনে থাকতেই ফুটপাতে সিডি বিক্রি শুরু করেন। সুবিধা করতে না পারায়, পরে ক্যাবল বা ডিস লাইনের ব্যবসায় নামেন। যা তাকে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দেয়। হিরোর স্বপ্ন মিউজিক ভিডিও’র মডেল হওয়া। কিন্তু তার ফিগার, পোশাক পরিচ্ছেদ, অভিনয়, মুভমেন্ট কোনকিছুই মডেল সুলভ নয়। ফলে তাকে দিয়ে কেউ যে মিউজিক ভিডিও বানাবে না, হিরো আলম সেটা জানতেন।
ফলে, স্থানীয়ভাবে নিজেই মিউজিক ভিডিও বানানো শুরু করেন। যেখানে তিনি নায়ক, ভাড়া করা অভিনেত্রীরা তার কো মডেল। নিজের ক্যাবল লাইনে, হাস্যকর, চটুল এসব ভিডিও চালানো শুরু করলে, স্থানীয়ভাবে বেশ পরিচিতি পান তিনি। এরপর, তার কাহিনী নিয়ে একটি টেলিভিশন রিপোর্ট হলে দেশজুড়ে পরিচিতি পান হিরো আলম। ফেসবুকে ট্রল হতে থাকে। তার ভিডিও দেখতে লাখ লাখ মানুষ ইউটিউবে ঢুঁ মারতে থাকে।
এই হচ্ছেন হিরো আলম। দু’বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হয়েছেন। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চান। এজন্য জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়নপত্রও কিনেছেন। যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এবং তা এমন পর্যায়ে যে, জগত-জাতি দুইভাগে বিভক্ত।
হিরো আলম সফল জীবন যোদ্ধা। একই সাথে ভাঁড়। খুব বড় জোর এন্টারটেইনার বলা যেতে পারে। তার নির্বাচনে অংশগ্রহণে জাতির কিছু এসে যাবে না। জাতীয় জীবনে তার কোন কিছু যোগ বিয়োগ করার নেই। দুর্ভাগ্য যে, তারপরও তাকে নিয়ে আমরা অনর্থক মূল্যবান সময় নষ্ট করছি।
টেলিভিশন সাক্ষাতকারে তাকে করা কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের সুত্রপাত। প্রশ্নগুলো এমন, সাংসদ হবার সব যোগ্যতা আছে কি-না? নিজেকে মাশরাফির লেভেলের মানুষ মনে করেন? সংসদ ভবন কি মজা করার জায়গা? ইত্যাদি ইত্যাদি। যার ঝটপট উত্তর দিয়েছেন হিরো আলম। নেটিজেনরা অনেকেই মনে করছেন, এসব প্রশ্ন অমর্যাদাকর, মানহানিকর ও বর্ণবিদ্বেষী। ইউরোপ অ্যামেরিকা হলে সাংবাদিকের জেল জরিমানা হত। সাংবাদিকদের সীমানা কতটা, সে জিজ্ঞাসাও তুলছেন কেউ কেউ।
হিরো আলম প্রান্তিক কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ। একই টিভি আবার ডাকলে তিনি আসবেন বলেই মনে হয়। তাকে নিয়ে যতকথা হবে তত পরিচিতি- হিসেব পরিষ্কার। গণমাধ্যমের কল্যানে দেশজুড়ে তার পরিচিতি বহু তারকা রাজনীতিবিদের চেয়ে বেশি। যাকে পুজি করে তিনি জনপ্রতিনিধি হতে চান। এটা তিনি চাইতেই পারেন। তাই বলে হিরো আলম কি এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যে, টেলিভিশনে তাকে ডেকে সাক্ষাতকার নিতে হবে? কোন কারণ আছে?
জাতীয় জীবনে, সুশাসন, ভালো নির্বাচন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, মানবাধিকার, দুর্নীতি বন্ধে রাজনৈতিক অঙ্গিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, যানজট অপসারণ, বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি, উন্নয়ন-অপচয় সহ বহু জরুরি ইস্যু রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সামনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে সব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনা, জনমত গঠন ও সমাধান প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরই মূল ভূমিকা রাখার কথা। তা না করে, যখন একজন ভাড়কে লাখ লাখ টাকার অনএয়ার স্পেস দেয়া হয়, তখন গণমাধ্যমের দুর্বলতাই ফুটে ওঠে।
সংবিধান অনুযায়ী হিরো আলমের জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। জনগণ চাইলে নির্বাচিতও হতে পারেন। এতে আফসোসের কিছু নেই। কেননা, বিগত সংসদগুলোতে এমন অনেকেই ছিলেন যাদের বিুরদ্ধে সন্ত্রাস, চাদাবাজি, দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তাদের তুলনায় হিরো আলম ভালো। সে শুধুই ভাড় ও বোহেমিয়ান। লুটেরা বা সন্ত্রাসী নয়। কিন্তু সুযোগ থাকলে কি তাকে ভোট দিতেন? ফেসবুক নয় প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে ক্যাম্পেইন করতেন? সত্যিই মনে করেন, ইচ্ছেকৃত তাকে অপমান করা হয়েছে? ধারণা করি, বেশীরভাগই গণমাধ্যম ও সাংবাদিক বিদ্বেষ থেকে একটা অবস্থান নিয়েছেন মাত্র।
হিরো আলম কে নিয়ে মাতামাতি করছেন তাদের জন্য একটি খবরের দুটো অংশ তুলে ধরতে চাই। যেখানে তার বাবা ও এলাকার চেয়ারম্যান কথা বলেছেন। হিরো আলমের বাবা বলছেন, ‘কিসের সেলিব্রিটি, ভাইরাল? এগুলা কি? হামরা তো অতো কিছু বুঝি না। বাড়ির, ছোলপোলের খোঁজ লেয় না আবার এমপির ভোট করিচ্চে। অক কাহালু নন্দীগ্রামের কে চেনে? আসলে এগলা অর ট্যাকা খাওয়ার জন্য কিছু মানুষ ভুল বুঝে অক ল্যাচা (নাচা) লিয়্যা বেড়াচ্চে।’ (জাগো নিউজ, ২০ নভেম্বর)
চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মণ্ডল বলেন, ‘এক বছর আগে ওর শালি (স্ত্রীর ছোট বোন) বিলকিসকে নিয়ে পলাসলো। সেই বিচার করে দেয়া লাগছে। আর বিচার তো হামার মাঝে মধ্যেই করা লাগে। ট্যাকা লিয়্যা দু-একদিন পরপরই ঝামেলা লাগায়। তারপরও এলাকার ছোল, ভালোই আছলো। শুনলাম আবার নির্বাচন করিচ্ছে। আসলে মাতাপাগলা হলে ইংকাই হয়। এটি মেম্বরত উটবার পারেনি। আবার জাতীয় লির্বাচন। আসলে এনা ট্যাকা হচে তো। গরমে থাকপার পারিচ্চে না।’
এই হচ্ছেন হিরো আলম। যাকে আপনারা ভোলাভালা গ্রামের মানুষ মনে করছেন। আসলে তিনি তা নন। উপরের বক্তব্য দুটি থেকেই তা প্রমাণিত।
সংবিধান, নির্বাচন কমিশন আইনেও সংসদ সদস্য হবার জন্য ন্যুনতম যোগ্যতা কি হবে তা উল্লেখ নেই। যার সুযোগ পাড়ার বখাটে থেকে লুটেরা ব্যবসায়ী সবাই নেন। আর বঞ্চনার শিকার হন সৎ রাজনীতিকরা। রাজনীতিতে আসতে নিরুৎসাহিত হয় ভালো মানুষ। সাংসদ হবার ক্ষেত্রে ন্যুনতম যোগ্যতার মাপকাঠি রাজনীতিবিদদেরই ঠিক করা উচিত। এ লক্ষ্যে একটি আইন হওয়া প্রয়োজন। গণমাধ্যম এ লক্ষ্যে রাজনীতিবিদদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে জনমত গঠন করতে পারে।
পাশাপাশি, সংসদ সদস্য হবার যোগ্যতা বিষয়ক সংবিধানের ৬৬(২) ধারা সংশোধন করে, সেখানে যোগ্যতা বিষয়ক কিছু শর্তারোপ করা যায় কি না, তা রাজনীতিবিদরা ভেবে দেখতে পারেন।
অভিযোগ উঠেছে, নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে বলেই লাইভ অনুষ্ঠানে হিরো আলমকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। যদিও, এমন অভিযোগ মানার কোন কারণ নেই। কেননা, টেলিভিশনের কল্যানেই সবাই তাকে চেনে। এর পেছনে বেঁচাবিক্রির হিসাবও ছিলো। এদিক থেকে হিরো আলম সুপুার ডুপার হিট। কিন্তু কি বেঁচতে হয় আর হয় না, তা বুঝতে অনেক ক্ষেত্রেই গণমাধ্যম ব্যর্থ- এটা মেনে নেয়াই ভালো।
হিরো আলম নেতা নয়, টিআরপির জন্য ভালো-এটাই সাধারণ বিবেচনা। এর বাইরে কিছু নেই। সাফল্যের জন্য তার সংগ্রামকে সম্মান করলেও, তার কাজে মানুষ কৌতুক বোধ করে। এটাই তিক্ত সত্য। হিরো আলমকে প্রশ্ন করার স্টাইলকে কেউ ঔদ্ধত্য মনে করতে পারেন। কিন্তু তা বর্ণবাদী এমন অভিযোগ অবান্তর। কেননা, এই গণমাধ্যমই দেশের বহু প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের সম্ভাবনাকে জাতীয় ক্ষেত্রে তুলে ধরেছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। সফল হতে সহায়তা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।
হিরো আলমকে হেয় করতে টিভিতে ডাকা হয়েছে এমন অভিযোগ ফেসবুকীয় হতে পারে, বাস্তব নয়। কিন্তু জনগণের পক্ষে তাকে প্রশ্ন করার অধিকার অবশ্যই সাংবাদিকের আছে। শুধু তাকেই নয়, আরো অনেককেই অনেক কঠিন প্রশ্ন প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে টেলিভিশন-পত্রিকাগুলো। এটাই গণমাধ্যমের কাজ। যে অনুষ্ঠান নিয়ে এতো আলোচনা, সেই অনুষ্ঠানেই রোকেয়া প্রাচীকেও অনেক অপ্রত্যাশিত ও কঠিন প্রশ্ন শুনতে হয়েছিলো। যদিও, তা কেউ খেয়ালই করেননি, প্রয়োজনও মনে করেননি।
নাগরিক হিসেবে চাই না হিরো আলমের মতো কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন। তা তিনি যত জনপ্রিয়ই হন না কেনো। যেমন আসলাম, বদি, পিন্টু, বাবর সহ আরো অনেককেই দেখতে চাই না। নিজ নিজ এলাকায় বিপুল জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও, এসব নেতা নেতিবাচক রাজনীতির ব্র্যান্ড। এটাই সাধারণ ধারণা। নাগরিক চাওয়া হচ্ছে ভালো এবং যোগ্য মানুষ রাজনীতিতে আসুক।
কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার না হলে, ভালো মানুষদের জায়গা পাওয়া কঠিন। চলমান রাজনীতিতে যত ভালো মানুষ বা নেতাই আসুক তার পক্ষে ভূমিকা রাখা কঠিন। বরং দুষ্টু ব্যবস্থার দাসত্ব মানতে না পারলে রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে চলে যাবেন। এ অবস্থায়, ফেসবুকীয় আলোচনা আর টিআরপি, না রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারে ভূমিকা রেখে জনশ্রদ্ধা অর্জন করবে- সেই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমকেই নিতে হবে।
সবশেষ, ব্যক্তি হিরো আলমের প্রতি ভালো-মন্দ লাগা নেই। কিন্তু মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা আছে। সেটা জানিয়ে উল্লেখ করতে চাই, এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে তার মতো প্রান্তিক ও নিম্নরুচির একজন ভাড়কে মূলধারায় মেনে নেয়া কঠিন। বিপুল অর্থবিত্ত, বিনিময়ের কাজে লাগতে পারে সত্য। সেখানেও হিরো আলম অনেক পিছিয়ে। ফেসবুক ইউটিউবের হিট, মূলধারায় বিকশিত হবার একমাত্র নিশ্চয়তা নয়। আরো অনেক মৌলিক গুনাবলীর প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত তেমন কিছু তার মধ্যে দেখা যায়নি। এখানে শ্রেনী বৈষম্য, অবজ্ঞার কিছু নেই।
অনেক দূর্বলতা সত্ত্বেও গণমাধ্যম তার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ফেসবুকে কুতর্ক, গলাবাজি ছাড়া আপনি কি করছেন, ভেবে দেখেছেন কি?
সাইফুল হাসান: সাংবাদিক