আত্মহত্যা ও জীবনকড়চা
২৪ নভেম্বর ২০১৮ ১১:৪৩
“জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুনাধারায় এসো”- আমাদের এই ধূলায় ধূসরিত পৃথিবীতে মায়া, মমতা, ভালবাসা এই বিষয়গুলোর নিশ্চয় বড্ড অভাব পড়েছে। তা যদি নাই হবে তাহলে সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা এত বেড়ে যাবে কেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতো এতো লাইক ইমো, লাভ ইমো এগুলো কতটা মূল্যহীন সেটা এই শিক্ষার্থীগুলোর অকালে অভিমান করে চলে যাওয়া থেকেইে বোঝা যায়। আমাদের শিক্ষার্থীগুলোর মনের মাঝে এমন কী তীব্র অভিমান ছিল?
শিক্ষার্থীদের জীবনে পোর্টফলিও থেকে জানা গেল কেউ প্রেমে ব্যর্থ, কেউ চাকুরী পাচ্ছে না, কেউ নিজের জীবন যাত্রার মান নিয়ে হতাশ এ কারণে তাদের অকাল চলে যাওয়া, কী অদ্ভূত!!!
মানব জীবন অনেকগুলো মানবীয় সম্পর্কের হাত ধরে এগোয়। নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক তার মাঝে একটি। প্রেম নিয়ে কবি সাহিত্যিকগণ অনেক কিছু বলে গেছেন। প্রেম শাশ্বত, প্রেম চিরন্তন। প্রেম-ভালবাসা বিষয়ক অনুভূতি সবার মাঝে জাগ্রত। যদি কখনো দুজন মানুষের মাঝে অনুভূতির এই উষ্ণতা কমে যায়- সেক্ষেত্রে বিচ্ছেদ হতেই পারে। তাই বলে বিচ্ছেদ বিরহ বেদনায় কাতর হয়ে মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করতে হবে? জীবনতো কারোর জন্য থেমে থাকে না। যে শিক্ষার্থী ভালবাসার মানুষটার উপর অভিমান করে চলে গেল তাতে কী হলো? মুত্যু ভালবাসার সম্পর্ক কে মহিমান্বিত করে-এ ধরণের তাত্ত্বিক কথাগুলো গল্প উপন্যাসে পঠিত মোহ ব্যতীত আর কিছু নয়। কারণ এ পৃথিবী থেকে যে মানুষগুলো চলে যায় তারা শুধু চলেই যায়,- হারিয়ে যায় স্মৃতির গহ্বরে। আর কখনোই ফিরে আসে না। এটাই ধ্রুব সত্য। আমার চলে যাওয়ার কথা ভেবে আমার প্রাক্তন ভালবাসার মানুষ চোখের পানি ফেলবে-সেই আকাঙ্খায় এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামো ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, শিক্ষার্থীটি তার ভালোবাসার মানুষের কাছে আগেই প্রাক্তন হয়ে গেছে, আর “প্রাক্তন” হয়ে যাওয়া মানুষের অনুপস্থিতি ব্যক্তি জীবনে কোন ক্ষতিবৃদ্ধি করে না। চাকুরী না পাওয়া মৃত্যুর আরেকটি কারণ শোনা যায়। আচ্ছা, মানুষ চাকরি কেন করে? জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য তাইনা? এই জীবনই যদি না থাকে তাহলে কেন চাকরি দরকার? বেকারত্বেও যন্ত্রণা তীব্র যন্ত্রণা। যারা বেকার তাদের উপর পারিবারিক, সামাজিক চাপ থাকে। পাশাপাশি নিজের সাথে নিজের যুদ্ধটাও চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু বেকারত্বেও অভিশাপে আত্মহত্যা করা, সেটাতো লড়াইয়ের ময়দানে শক্রকে নিধন না করে নিজেকে হত্যা করার নামান্তর।
চাকরিই কেন করতে হবে? স্বপ্রণোদিত হয়ে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির সাধে সমাজের আরো কয়েকজনকে উদ্বুদ্ধ করা যায় না? আরো কজন শিক্ষার্থী তার জীবনযাত্রার মান নিয়ে হতাশ ছিলো। সেজন্য আত্মহত্যা করেছে, আচ্ছা, জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করার কর্তাব্যক্তিটি কে? ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম? যেখানে দামি রেস্টুরেন্টে চেক ইন আর সেল্ফি দিতে না পারার জন্য মনে হয়েছে যে শিক্ষার্থীটির জীবনযাত্রা নিম্নমানের? আমাদের সামাজিক মাধ্যমের যথেচ্ছা ব্যবহার কি বর্তমানে অন্যের মনোপীড়ার কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে? সেক্ষেত্রে আমি বলবো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী এবং সমাজে মনোপীড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি উভয়ের মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। সমাজ বিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যার ধরন নিয়ে কাজ করেছিলেন। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাকে এমিল ডুর্খেইমের ভাষায় “নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা” হিসেবে অভিহিত করা যায়। সমাজে যখন সামাজিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সব ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করে তখন যে আত্মহত্যা হয় তাকে নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা বলে অভিহিত করা হয়। সমাজে নানা ধরণের আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের কারণে মানুষের মধ্যে বিতৃষ্ণার উদ্ভব হয়। মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবন বিঘ্নিত হয়। এ বিতৃষ্ণা থেকে বাচার জন্য মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আমার মনে হয় এখন আমাদের আর্থিক উন্নতি অপেক্ষা মানসিক উন্নতির দিকে বেশী মনোনিবেশ করা উচিত। বর্তমান বাংলাদেশে সমাজে মানুষে মানুষে যে সম্পর্কের ধরণ, নিজেকে অধিকতর শ্রেয় মনে করার যে ভাবনা, অন্যকে হেয় করার যে প্রচেষ্টা এ ধরণের আচরণগুলোর বিপক্ষে কথা বলা উচিত।
সমাজে শ্রেণি বৈষম্য থাকবেই। আর বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির কল্যাণে শেণি বৈষম্যের এই প্রকটরূপ আরো প্রকটতর হয়ে ধরা পরে। শেণি বৈষম্যহীন সমাজ যদি আমারা তৈরি করতে না পারি, তাহলে মানবিক একটা সমাজতো তৈরি করতে পারি- তাইনা? যে মানুষগুলো পৃথিবী থেকে নিজেকে শেষ করে দেয়, সে মানুষগুলো কিন্তু একবুক অভিমান নিয়ে চলে যায়। আমাদের উচিত তাদের সেই অভিমানের জায়গাটা খুঁজে বের করা। মানুষগুলোর প্রতি সমানুভূতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আমরা সমাজের মানুষেরা যদি একটু কোমল হই, অন্যের অনুভূতিগুলোর প্রতি দায়িত্বশীল হই-তাহলে হয়তো এই মৃত্যুর মিছিল অনেকখানি থামানো সম্ভব হবে। পৃথিবীটা এতো সুন্দর, পৃথিবীতে এতো কিছু করার আছে, অথচ এই বোকা মানুষগুলো কোন কিছু না ভেবেই অকালে ওপাড়ে পাড়ি জমায়। একবারও পরিবারের কথা চিন্তা করেনা। যারা তাদের ভালবাসে তাদের কথা চিন্তা করে না। তাই একটাই প্রত্যাশা- সমাজ মানবিক হোক। দুর আকাশে পাড়ি জমানো মানুষগুলো ভালো থাকুক, আর ভালো থাকুক সকল মৃত্যু ব্যথিত প্রাণ।
আমিনা রিংকি
শিক্ষক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
সারাবাংলা/এমএম