নিরপেক্ষ, নাকি দায়িত্বশীল
২৭ নভেম্বর ২০১৮ ১২:১৮
নির্বাচন এলেই কিংবা নির্বাচনের আলোচনা ওঠলে যে শব্দ সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে সে ‘নিরপেক্ষ’। আমরা দল নিরপেক্ষ সরকার চাই, দল নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন চাই, নিরপেক্ষ প্রশাসন চাই; অর্থাৎ লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে সকল কিছুকেই নিরপেক্ষ দেখতে চাই। এবং এই নিরপেক্ষ শব্দের ব্যাখ্যাও যার-যার তার-তার, সর্বজনীন নয়।
কে নিরপেক্ষ, নিরপেক্ষতা মানে কী- এনিয়ে আলোচনা খুব বেশি হয় না; তবে এই শব্দ আলোচনার ঝড় তুলে মাঝেমাঝে, এবং এটা নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ঝড় তোলা শব্দ। যদিও শেষমেশ এনিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না, এবং যতখানি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তার বেশিরভাগই একপাক্ষিক। তাই নিরপেক্ষতা বিষয়ক পালটাপালটি বক্তব্যে যথারীতি রয়েছে অনুযোগ-অভিযোগের তীর।
একাদশ সংসদকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ‘নিরপেক্ষ সরকার’ চেয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের প্রসঙ্গ উল্লেখে সরকার নিরপেক্ষ সরকারের সেই ধারণাকে পাত্তা দেয়নি। সংবিধান অনুযায়ী চলমান রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোটের দাবির মুখেও সংবিধানের বাইরে যায়নি। এবং নানা আপত্তি, আন্দোলনের হুমকি, নির্বাচনে না যাওয়ার হুমকি সত্ত্বেও হুমকিদাতাদের সকলেই নির্বাচনে যাচ্ছে। কেবল নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাই নয় নির্বাচন কমিশনকে প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ নয় বলে দাবি করে আসছে বিএনপি; এবং বিএনপির জোটের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। যদিও নির্বাচন কমিশন নিজেদেরকে প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ বলে দাবি করে আসছে।
নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়, সিইসি নিরপেক্ষ নন, প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না- এমন অভিযোগ বিএনপির দীর্ঘদিনের। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকে তফসিল ঘোষণার পরেও বিএনপি একই দাবি করে যাচ্ছে। ইসিকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার এই আহবান তাদের চলমান। তাদের দাবিমত অনেক কিছু ইসি বাস্তবায়ন করলেও এনিয়ে তারা সন্তুষ্টি প্রকাশে কোন মন্তব্য অদ্যাবধি করেনি। উপরন্তু নির্বাচন কমিশনকে আওয়ামী লীগের কার্যালয় হিসেবেও মন্তব্য করেছে বিএনপি। ফলে ধরে নেওয়াই যায় ইসির কোন পদক্ষেপ তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না, এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেও শঙ্কা।
সংসদ নির্বাচন সেনা মোতায়েনের যে দাবি ছিল বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সে সম্পর্কে ইতিবাচক ছিল না নির্বাচন কমিশন, এবং সরকার। কিন্তু ইসির সঙ্গে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকের পর ইসি জানিয়েছে নির্বাচনের দুই থেকে দশ দিন আগে থেকেই সেনা মোতায়েন করা হবে। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা জানিয়েছেন ১৫ ডিসেম্বর থেকে পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর একটা ছোট টিম মাঠে থাকবে। নির্বাচন ও নির্বাচনের আগে থেকে সেনা মোতায়েনের এই দাবি বিএনপির দাবির চাইতেও বেশি। তারা যেখানে ১০ দিন আগে থেকে সেনাবাহিনী চেয়েছিল ইসি সেখানে ১৫ দিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। এরপরেও এনিয়ে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ইসির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়নি, কিংবা সামান্য ‘ধন্যবাদ’ শব্দটাও উচ্চারণ করা হয়নি। অথচ এই দাবিটা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির অন্যতম প্রধান দাবি ছিল।
কেবল সেনামোতায়েনের আশ্বাসের ব্যাপারই না, গত ৮ নভেম্বর ইসির নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি ছিল নির্বাচনের তারিখ পেছানোর। তারা বলেছিল নির্বাচন এক মাস পিছিয়ে দেওয়ার। প্রথম দফা ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর বিএনপিজোটের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে ইসি পুনঃতফসিল ঘোষণা করে যেখানে নির্বাচন এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর পুনঃনির্ধারিত হয়। নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিকেও ইসি মেনে নিয়েছে। এই তারিখ পেছানোর আগে সিইসি স্বয়ং নির্বাচনের তারিখ না পেছানো বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তি দিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ইসি নির্বাচনের তারিখ পেছায়। এখানেও নির্বাচন কমিশন বিএনপির দাবিকে গুরুত্ব দিলেও সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে দেখছে না বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
নির্বাচনে ‘লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির দাবি জানাচ্ছে বিএনপি। এই লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড মানে সকল দলের জন্যে সমসুযোগ। ইসির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে তারা এর প্রক্রিয়ায় আছে। ইসি এও বলছে প্রতীক বরাদ্দের আগ মুহূর্তে এটা পুরোপুরি দৃশ্যমান হবে। তবে ইসির এই বক্তব্যকে আমলে নিচ্ছে না বিএনপি; তাদের অভিযোগ চলছেই।
নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ইসি যেখানে তাদের ভূমিকা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে সহায়ক হচ্ছে বলে মনে হয়। ইসি ইতোমধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে নির্বাচনের আগে যাতে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করা না হয়। ইসি সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দিয়েছে যেখানে উল্লেখ রয়েছে অর্থের যোগ রয়েছে এমন কোন কর্মসূচিতে যাতে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীগণ উপস্থিত না হন। ইতোমধ্যেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বিষয়ে ইসি আপত্তি জানিয়েছে, নরসিংদীর সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থমন্ত্রী উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ইসির আপত্তিতে সেখানে যেতে পারেন নি মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীকে ইসি বলেছে তিনি যেন কোন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন না করেন। এগুলো নিশ্চিতভাবেই ইসির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা, যা আলোচনার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে ইসি যে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতি মনোযোগী সেটারই প্রমাণ হয়।
সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একাধিক মামলায় দণ্ডিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান- এনিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আপত্তির জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছিলেন, ‘এটা বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিষয়, অন্যদের এখানে কথা বলার অধিকার নাই’। মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যকে যৌক্তিক মেনে নেওয়া যেত যদি দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার বাইরে আইন-আদালতকে অগ্রাহ্য-অমান্য না করে পলাতক না থাকতেন তারেক রহমান। তাছাড়া এই তারেক রহমানের বক্তব্য, উপস্থিতি কোনো কিছুই প্রচার করা হাই কোর্টের রায়ের আলোকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বিএনপি কেবল অভ্যন্তরীণ ভাবেই তারেককে উপস্থাপন করেনি, তাদের নেতাদের বক্তব্যে তারেকের বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের বিষয়টিও স্বীকৃত হয়েছে। এছাড়া বিএনপি তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থিরচিত্র প্রকাশ করেছে। সে হিসেবে আইনত নির্বাচনের অযোগ্য তারেক রহমান নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সেই অংশগ্রহণও প্রচার করেছে খোদ বিএনপি। এটা হাই কোর্টের রায়কে অমান্য করার পর্যায়ে কি পড়ে না? তারপরেও ইসি তারেকের এই বিষয়টিকে আমলে নেয়নি। যা বিএনপির পক্ষ গেছে; তবু লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি কিংবা নিজেদের অবস্থান প্রমাণের ইসির এই উদ্যোগ নিয়ে খুব বেশি কথা হয়নি; সবাই বেমালুম চেপে গেছে।
ইসি নিরপেক্ষ নয়, প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়- এমন অভিযোগের বাইরে প্রকৃত অবস্থা নিয়ে কেউ আলোচনায় আগ্রহ দেখায় না। অভিযোগটাই কেবল শক্তিমান হয় দিনেদিনে; কিন্তু এইসব অভিযোগের বাইরে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিয়ে ইতিবাচক আলোচনার অভাব রয়েছে। সরকারবিরোধী দল হিসেবে বিএনপির অভিযোগই যেন শেষ কথা- এমন এক পূর্বসিদ্ধান্তে আটকে আছে অধিকাংশ লোক। এখানে কেউ আলোচনা করেনা এখানে নিরপেক্ষতার পরিমাপক কী, নিরপেক্ষতার সূচকই বা কী?
স্মরণ করা যেতে পারে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এক মন্তব্য-বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো যখন আন্দোলন করছিল তখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পাগল ও শিশু ছাড়া দেশে কেউ নিরপেক্ষ নেই’। নিয়তির ফেরে বাস্তবতা এমন এক জায়গায় যেখানে খালেদা জিয়ার দলই কথায়-কথায় অন্যের কাছে নিরপেক্ষ আচরণ, নিরপেক্ষ সরকার, নিরপেক্ষ প্রশাসন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দাবি করছে। তবে তাদের এই নিরপেক্ষ শব্দটা প্রকৃত অর্থ কী, এই নিরপেক্ষতার সীমা-পরিসীমা কতখানি- এনিয়ে খোলাসা করছেন না। ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটা তাই এখানে অনির্দিষ্ট কোনো প্রপঞ্চকে নির্দেশ করছে। তাই এই নিরপেক্ষ কিংবা নিরপেক্ষতা শব্দে(দ্বয়) আদতে প্রাপ্তিযোগের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ ও সংজ্ঞা যখন সীমা-পরিসীমাহীন অনির্দিষ্ট এবং এই আওয়াজ যখন একপাক্ষিক তখন এ থেকে কার্যকর কিছু আশা করাটা উচিত হবে না। তাছাড়া নিরপেক্ষ শব্দের উচ্চারণ যখন অভিযোগের তীর দাগানোর প্রপঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত তখন সেটা চলমান থাকবে। এই উত্তরহীন এই প্রশ্নের জবাব তাই নাই কারও কাছে।
এক্ষেত্রে তাই নিরপেক্ষতা শব্দ নয়, দায়িত্বশীলতা শব্দটাই প্রাসঙ্গিক। নিরপেক্ষ শব্দের বিপরিতে চাওয়া হোক দায়িত্বশীল। কারণ নিরপেক্ষ ও নিরপেক্ষতার দাবি যখন যার-যার তার-তার ব্যাখ্যার এবং অনির্দিষ্ট চাওয়ার সেখানে দায়িত্বশীল ও দায়িত্বশীলতার অর্থটা ব্যাপক ও সুনির্দিষ্ট। নিরপেক্ষ ইসি-সিইসি, নিরপেক্ষ প্রশাসন- হাওয়াই শব্দের চাইতে অংশীজনেরা দায়িত্বশীল ইসি-সিইসি, দায়িত্বশীল প্রশাসন চাইতে পারে। আর এই দায়িত্ব ও দায়িত্বশীলতা বিধিবদ্ধ এবং অবশ্যপালনীয় দায়িত্বশীলদের জন্যে।
কবির য়াহমদ
সারাবাংলা/এমএম