স্বার্থের গোলাম রনি
২৭ নভেম্বর ২০১৮ ২০:৩৭
গোলাম মাওলা রনি টেলিভিশন টক শো’তে দারুণ বলেন, লেখেন তারচেয়ে ভালো। তার সব বলা বা লেখার সাথে আমি একমত নই। কিন্তু তার বলার স্টাইল, লেখার ধার আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি তার নিজের বক্তব্যটা দারুণ যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে পারেন। তার বলায়, লেখায় যুক্তি থাকে, তথ্য থাকে, ইতিহাস থাকে। আমি সবসময় সবার কাছে এই স্টাইলটাই আশা করি। ভিন্নমতেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতান্ত্রিক সমাজে মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে; যুক্তি থাকবে, পাল্টা যুক্তি থাকবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা যুক্তিতে হেরে পাল্টা যুক্তির বদলে গালি দেই; সুযোগ পেলে গায়ের জোর খাটাই। গোলাম মাওলা রনি সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তার মতের সাথে না মিললেও, কখনো কখনো তার যুক্তির কাছে হেরে যাই। যুক্তি দিয়ে ভিন্নমতের মানুষকে জব্দ করা বা পক্ষে টানার আনন্দই আলাদা। তার মত শিক্ষিত, জ্ঞানী মানুষের রাজনীতিতে আসা আমাদের আশাবাদী করেছিল। তিনি শুধু রাজনীতি নিয়েই লেখালেখি করেন তা নয়; তার লেখালেখি ও পড়াশোনার পরিধি ব্যাপক। আমি তার লেখা পড়ি আর মুগ্ধ হই।
তবে গোলাম মাওলা রনির কাছ থেকে আমি প্রথম ধাক্কা খাই সম্ভবত ২০১৩ সালে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের দুজন সাংবাদিককে মারধোরের পর। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, যেভাবে তিনি দুজন সাংবাদিক লাথি দিচ্ছিলেন, তাতে তাকে মাস্তানের চেয়ে কম কিছু মনে হয়নি। তার আগের সব লেখালেখি, টক শো’র বক্তব্যকে আমার কাছে মুখোশ আর ভণ্ডামি মনে হয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর রাজনীতিবিদদের হামলার ঘটনা সেটিই প্রথম নয়। তারপরও আমি অবাক হয়েছিলাম, আক্রমনকারীর নাম গোলাম মাওলা রনি বলে। আরো বেশি বিস্ময়কর ছিল, কারণ রনি একজন সাংবাদিকও বটেন। ৯০ দশকের শুরুতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বদলে দেয়া দৈনিক আজকের কাগজ দিয়েই শুরু হয়েছিল তার পেশাজীবন। কিন্তু পরে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্যবসা করেন, পরে রাজনীতিতে যোগ দেন। তবে একবার সাংবাদিকতা করলে, তিনি নাকি সারাজীবনই সাংবাদিক। তো রাজনীতিবিদে বদলে যাওয়া একজন সাংবাদিক যখন অপর দুজন সাংবাদিককে লাথি মারেন, তখন আমরা একটু বেশি কষ্ট পাই।
একটা কথা আছে, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। গোলাম মাওলা রনি রেগে গিয়ে হেরেই গিয়েছিলেন। সে ঘটনায় তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। দল থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছে, পরের নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত থাকতে হয়েছে।
গোলাম মাওলা রনির আরেকটা বিষয় আমার খুব ভালো লাগে। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায়ও তার লেখায় ও বলায় সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। এটা অবশ্যই সাহসী পদক্ষেপ। একটা দলের ভুল হতেই পারে। কিন্তু আমাদের দেশে নেতা ও এমপিরা অন্ধের মত, যুক্তি ছাড়া দলের সব সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন। অথচ ভুল স্বীকার করে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই একটি দল আরো সামনে এগিয়ে যেতে পারে। দলের সমালোচনা করতে গিয়েও বারবার বিপাকে পড়েছেন তিনি।
এমনিতে গোলাম মাওলা রনি ভাগ্যের বরপুত্র। তাদের পৈত্রিক বাড়ি ফরিদপুরের সদরপুরে। কিন্তু সত্তরের দশকে তার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পিতা ভাগ্য ফেরী করতে পটুয়াখালীর গলাচিপায় শেকড় গাড়েন। সেই পরিবার থেকে তিনি নিজের যোগ্যতায় শিক্ষায়, অর্থে, বিত্তে সমাজের উচ্চ আসনে তুলে আনেন নিজেকে। রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা গো ছিলই, পেয়েছেন ভাগ্যের সহায়তাও। প্রথমে তিনি তাদের আদি নিবাস ফরিদপুর থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে সুযোগ না পেয়ে মনোযোগ দেন পটুয়াখালী-৩ আসনে। সেখানে সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। কারণ সে আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন। কিন্তু ১/১১এর সময় সংস্কারপন্থি হওয়ায় ২০০৮ সালে মনোনয়ন পাননি তিনি। তাতেই কপাল খুলে যায় রনির। কিন্তু বারবার বিতর্কে জড়িয়ে নিজের অবস্থান নিজেই দুর্বল করেন তিনি। পাননি ২০১৪ সালের মনোনয়ন। এরপর দলের সাথে তার দূরত্ব আরো বাড়ে, বাড়ে দলের সমালোচনার ধার। একটা সময় হচ্ছিল গোলাম মাওলা রনির আওয়ামী লীগ অধ্যায় বুঝি শেষ। কিন্তু সম্প্রতি আবার লেখায়-বলায় আওয়ামী লীগের পক্ষাবলম্বন করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, হাল ছাড়েননি তিনি। পটুয়াখালী-৩ আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কেনেন তিনি। ১৪ নভেম্বর অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদদের সাথে তিনিও গণভবনে গিয়েছিলেন। ২৪ নভেম্বর রাতেও এক টেলিভিশন টক শো’তে আওয়ামী লীগের পক্ষে দারুণ বক্তব্য রাখেন। কিন্তু ২৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোনো চিঠি পাননি তিনি। ২৬ নভেম্বর দুপুরে তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘আমি আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাইনি এই সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার এক কট্টর সমর্থক হার্ট এ্যটাক করে মারা যায়, যা আমাকে নিদারুণ ভাবে আহত করেছে। আমার নির্বাচনী এলাকার হাজার হাজার নারী- পুরুষের কান্নায় গলাচিপা-দশমিনার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছে। অনেকে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন। উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে আমি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের মাঠে নামবো। দেখা হবে সবার সঙ্গে- এবং দেখা হবে বিজয়ে।’
সেদিন সন্ধ্যায় তাকে দেখা যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। সেখানে তিনি ‘সজ্ঞানে, সুস্থ শরীরে চিন্তাভাবনা করে’ বিএনপিতে যোগ দিয়ে পটুয়াখালী-৩ আসনে মনোনয়ন বাগিয়ে বেড়িয়ে আসেন।
১৪ নভেম্বর গণভবন থেকে ২৬ নভেম্বর গুলশান। মাত্র ১২ দিনে আওয়ামী লীগ কতটা খারাপ হলো, বিএনপি কতটা ভালো হলো। কো বদলালো? নাকি বদলে গেলেন গোলাম মাওলা রনি?
তিনি বলেছেন, মনোনয়ন পেলে তিনি আওয়ামী লীগেই থাকতেন। তার মানে আসলে তার বদল হয়েছে রাতারাতি। গোলাম মাওলা রনি আবারও প্রমাণ করলেন, রাজনীতিতে নীতি আদর্শ বলে কিছু নেই; স্বার্থটাই আসল। যতই বড় বড় কথা বলুন আর লিখুন, যতই জাতির বিবেক সাজার চেষ্টা করুন না কেন; বুঝিয়ে দিলেন যাহা এস এ খালেক, তাহাই গোলাম মাওলা রনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরকম শেষ মূহুর্তে দলবদলের অনেক নজির আছে। তবে গোলাম মাওলা রনির এই ডিগবাজি আমাদের বেশি হতাশ করেছে, কারণ তিনি রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তির যে চর্চা শুরু করেছিলেন, তা আমাদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, শিক্ষা নয়, প্রজ্ঞা নয়, আদর্শ নয়, নীতি নয়; তিনি আসলে স্বার্থের গোলাম।
সংসদে, টক শো’তে তিনি দিনের পর দিন বিএনপির সমালোচনা করেছেন। ইউটিউবে তা আছে। তিনি এখন কিভাবে তা অস্বীকার করবেন। বিএনপির রাজনীতির অসারতা প্রমাণ করে তার অসংখ্য লেখা আছে। এখন তিনি কিভাবে বিএনপির হয়ে ভোট চাইবেন?
কেউ কেউ ভাবতে পারেন, গোলাম মাওলা রনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন বলেই, আমি তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছি। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। ঐক্যফ্রন্টে জায়গা না পেয়ে বি চৌধুরী-মাহি বি চৌধুরীদের মহাজোটে যোগ দেয়া যেমন অসততা, রনিরটাও তেমনি। নিছক মনোনয়ন না পেয়ে কেউ যদি বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন; তার জন্য এই ঘৃনাটুকু বরাদ্দ থাকলো।
গোলাম মাওলা রনি যদি আওয়ামী লীগের আদর্শিক বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে, বিএনপির আদর্শিক উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে তার দলবদলের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতেন; তাহলে আমি বোঝার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন, স্রেফ মনোনয়ন না পেয়েই তিনি দল বদলেছেন। অথচ এখানে নীতি-আদর্শের কোনো ব্যাপার নেই। অথচ চাইলেই তিনি আওয়ামী লীগ ছাড়ার ১০টি যৌক্তিক কারণ তুলে ধরতে পারতেন।
প্রভাষ আমিন
২৭ নভেম্বর, ২০১৮
সারাবাংলা/এমএম