সাইফুল হাসান ।।
আনিসুল হক পৃথিবী ছেড়ে গেছেন এক বছর হলো।
এই সময়েই কত কিছুই না ঘটে গেছে। উত্থান-পতন হয়েছে। কিন্তু তার অভাব পুরণ হয়নি। আসলে সময়ই শোক, কষ্ট, দুঃখ, বেদনা উপশম করে। মানুষকে জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। সামনে এগিয়ে যাবার তাড়না দেয়। নিত্যদিনের ব্যস্ততা। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন আনিসুল হককে অনুভব করেছি। সংকট, আনন্দ, উপমায় তাকে খুঁজেছি। তার স্মৃতিচারণে কেটেছে অনেকটা সময়।
আনিস ভাই, সময় অপচয় না করার পরামর্শ দিতেন । তিনি বলতেন, ‘অর্থ নয়, জীবনের পেছনে ছোটো। মাথা উঁচু রাখো সবসময়। জীবনে সমঝোতা করে চলতে শেখো। যাই ঘটুক মন ছোট করবে না। সময়কে কাজে লাগাও। টাকা দিয়ে লাক্সারি কিনতে পারবে, সময় নয়। এমনকি টাকা তোমাকে সুখীও করতে পারবে না।’… তার বলা এসব কথা ইদানিং তরুণদের শুনিয়ে উৎসাহ দেই। নিজেও অনুপ্রাণিত হই।
আনিসুল হক এ দেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একজন উপস্থাপক। অসম্ভব সুদর্শন। তার সময়ের লাখ লাখ তরুনীর ক্রাশ। সফল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের নেতা। মেয়র। সাহসী মানুষ। ফ্যাশন আইকন। তার অনেকগুলো কাজের ক্ষেত্র। যার প্রায় সবগুলোই আমার চেনা। তা সত্ত্বেও, লিখতে গেলে ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে বেরুতে পারি না। সব ছাপিয়ে ব্যক্তিগত চেনা, জানা, বোঝাটাই বড় হয়ে ওঠে মনের ক্যানভাসে।
সবাইকে মরতে হবে কিন্তু বেঁচে থাকে ক’জন? আনিস ভাই বেঁচে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। কারণ, তিনি মৃত্যু নয়, জীবন আলিঙ্গন করেছিলেন শক্তভাবে। এমন আত্মবিশ্বাসী, সদালাপী মানুষ কমই দেখা যায়। ভালোবাসতেন মানুষ। তাঁর মতো শ্রোতা এই জীবনে দেখিনি। সবাইকে বলার সুযোগ দিতেন। কিন্তু যখন বলতেন, অন্যরাও ভালো শ্রোতা হয়ে যেতেন। কারণ তিনি বলতেন চমৎকার। এই শহরে তার মতো উচ্চস্বরে, প্রাণখুলে কাউকে হাসতে দেখিনি। ভবিষ্যতে দেখবো এমন আশা করিনা।
আনিসুল হক ছিলেন বহুমাত্রিক মানুষ। অকৃত্রিম ব্যবহার। তার হৃদয় থাকতো মানবিকতা ও উচ্ছ্বলতায় পরিপূর্ণ। ভালোবাসাময় তার জগত। বন্ধু, স্বজন, পরিচিতজনরা যেন ভালো থাকে সেদিকে নজর রাখতেন। যে কোনো সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন। এসব কারণেই তার প্রতি মানুষের এতো মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
তার চলে যাওয়ার ক্ষতি অপুরনীয়। হক পরিবার তো বটেই নগরবাসীর জন্যও। তাকে হারিয়ে, উত্তরহীন ঢাকা উত্তর। বেঁচে থাকতে মেয়র আনিসুল হককে যখন তখন ফোন করা যেতো। সরাসরি অভিযোগ-অনুযোগ জানানো যেতো। ফেসবুক, ই-মেইল, নাগরিক অ্যাপ কার্যকরী ছিলো। অনেক সমস্যার তাৎক্ষনিক সমাধানও মিলতো। এখন মানুষ ঈশ্বরের ঠিকানা খোঁজে।
ডিএনসিসিও যেনো নিজের পুরানো কম্বল গায়ে তুলে নিয়েছে। মেয়র নেই, কোন উদ্যোগ বা তাগিদও নেই। গৎবাঁধা বৃত্তে বন্দী সংস্থাটি। আনিস ভাই, ঢাকা উত্তরকে আধুনিক শহর বানাতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় পুরো শহর বিনির্মাণের কাজ চলছে। তবে, তদারকির অভাবে গতি শ্লথ। খানাখন্দে ভরা ভাঙ্গা রাস্তা, ময়লা-আবর্জনায় উপচে পড়া ড্রেন, মানুষের ক্ষোভ বারবার প্রয়াত মেয়রের অনুপস্থিতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাস্তবতা হচ্ছে, এই শহরটাকে কেউ ভালোবাসে না। ফলে, কেউ কোন দায়ও অনুভব করে না। সবাই টাকা কামানোর জায়গা বিবেচনা করে। আনিস ভাই, এই শহরকে নিজ বাড়ির উঠোন মনে করতেন। শহরের প্রতি তার মমত্ববোধ ছিলো অতুলনীয়। এ কারণেই বিশ্বাস করতেন মানবিক, গতিশীল, সবুজ, স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন, সুখী ও ছায়াশীতল ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব।
তিনি ডিএনসিসিকে অল্প সময়ের মধ্যেই মোটামুটি শৃংখলার মধ্যে আনতে পেরেছিলেন। ঘুষ, দুর্নীতি এবং লাল ফিতার দৌরাত্ন্য খানিকটা কমাতে পেরেছিলেন। সংস্থাটির প্রতি জনআস্থা তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর মৃত্যুর পর? থেমে গেছে সমাধানযাত্রা। ইউল্যুপ সহ আরো অনেক উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা বন্ধ। দেয়াল জুড়ে পোষ্টার। উত্তর ঢাকার অলিগলি জুড়ে শুন্যতা।
আনিস ভাই ছিলেন সাধারন কিন্তু ব্যতিক্রমী মানুষ। আগে লক্ষ্য ঠিক করে প্রস্তুতি নিতেন, শেষে কাজ করতেন। অভিভাবকের মতো, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের পিঠে হাত রেখে কথা বলতেন। যতদিন দায়িত্বে ছিলেন, সামর্থ্যের সবটুকু নিয়ে নাগরিকদের পাশে দাড়িয়েছেন। গঁৎবাধা জিনিসে আস্থা ছিলো না। যা করতেন তাতেই ভিন্ন মেজাজ, বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব থাকতো। তার এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রুবানা হকসহ আরো কিছু মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হলেও, কাজটা ভালো হতো।
আনিস ভাইয়ের সকল সফলতা, কৃতিত্ব ও অর্জনের পেছনের কারিগর রুবানা হক। তাকে ছাড়া আনিসুল হক অসম্পুর্ণ। দু’জন দুজনকে আগলে রাখতেন। এখন রুবানা ভাবী, ছেলে নাভিদুল হক মিলে আগলাচ্ছেন ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, পরিবার এবং শোক। আর ওপার থেকে ছায়া দিচ্ছেন আনিসুল হক।
তিনি তরুণ এবং তারুণ্যকে ভীষন পছন্দ করতেন। পরিবার-স্বজনদের কিভাবে আগলে রাখতে হয়, তার কাছ থেকেই শিখেছি। বাবা-মাকে সম্মান করা, তাদের খুশী রাখার পরামর্শ দিতেন সর্বদা। তার ‘মায়ের ফু’ দেবার গল্প তো বিখ্যাত। স্ত্রী রুবানা হককে নিয়ে গর্ব করতেন। পরিবার বিশেষত সন্তানদের বিষয়ে ছিলেন ভীষণ সংবেদনশীল। তাদের ভালো ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
২০০৬ সালের এক দুপুরে, একমাত্র ছেলে নাভিদের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, দেখে রেখো। হ্যাংলা পাতলা ইয়া লম্বা নাভিদ। আনিস ভাই জানালেন, ‘নাভিদ জন্মসুত্রে কোম্পানীর পরিচালক হলেও কর্মসুত্রে তা অর্জন করতে হবে। আমরা এমন অভিভাবক নই যে, মালিকের ছেলে বলে প্রতিষ্ঠানের চূড়ায় বসিয়ে দেবো। শ্রমিকদের সাথে থেকে কাজ শিখে তাকে উপরে উঠতে হবে। আমাদের সাথে থাকে, বিএমডব্লিউতে অফিসে আসে। এতটুকুই তার লাক্সারী। বেতন মাত্র ১০ হাজার টাকা। এটাই তার সারা মাসের হাত খরচ।’
সাংবাদিকদের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন আনিসুল হক। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কাছের মানুষ। রাজধানীর বেশীরভাগ পরিচিত সাংবাদিক, শিল্পী, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ ছিলেন তার বাসার নিয়মিত অতিথি। আপ্যায়নে আনিসুল হক ছিলেন সেরা। মানুষকে সম্মান দেবার ক্ষেত্রে ছিলেন সবচেয়ে আদর্শ। উপহার দিতে ভালোবাসতেন। অতিথি বিদায়ের সময় ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে দরজা পর্যন্ত পৌছে দিতেন। তার এই নির্ভেজাল হৃদত্যাই আকর্ষণ করতো বেশীরভাগ মানুষকে।
মেয়র হবার পর কিছু সাংবাদমাধ্যম অনেক বাজে কথা লিখেছে। মন খারাপ করেছেন কিন্তু সাংবাদিকদের প্রতি ভালোবাসা কমেনি। বরং বিপদে-আপদে, গোপণে সাংবাদিকদের পাশে থেকেছেন। বা থাকতে ভালোবাসতেন। উপলক্ষ পেলেই বাসায় দাওয়াত। হৈ-চৈ আড্ডা। এতো আন্তরিক হোষ্ট শহুরে জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। কিন্তু উচিত কথা বলতে কাউকে ছাড়েননি।
গণজাগরণ মঞ্চ হয়েছে, গোপনে সেখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। রানা প্লাজায়, হাজারো শ্রমিকের মৃত্যু দেখে যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন। গার্মেন্টস খাতের ভবিষ্যত ভেবে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। শ্রমিকদের উদ্ধার তৎপরতায় সহযোগিতা করতে গোপনে লোক ও সাহায্য পাঠিয়েছেন। জীবিত কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বন্যায় আক্রান্ত মানুষের কাছে খাদ্য, কাপড়সহ অন্য সহযোগিতা গেছে। শীতে আক্রান্ত মানুষের জন্য হাজার হাজার সোয়েটার গেছে উত্তরাঞ্চলে। এগুলো একেবারেই নিয়মিত ঘটনা ছিলো।
কারো চিকিৎসা, কারো পড়াশোনা, কারো চাকরি, কারো নগদ সাহায্য- সাধ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। আনিসুল হক ফিরিয়েছেন কম মানুষকেই। ভাগ্যগুণে এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি। এসব ঘটনা কেউ জানুক সেটা চাননি কোনদিন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। দেশের কল্যাণ হয় এমন যে কোনো উদ্যোগের সাথে থাকতে পছন্দ করতেন। এজন্য অর্থ খরচে দ্বিধা করতেন না। সবসময় এমন কিছু করার কথা ভাবতেন, যা একেবারে নতুন। যা দেখে মানুষ চমকে উঠবে।
নাগরিক টেলিভিশন করার সময় বারবার বলতেন, ‘ব্যাটা, আউট অফ দ্য বক্স চিন্তা করো। তোমাদের টিভি কেন মানুষ দেখবে সেটা খুঁজে বের করো।’
মানুষটা জীবনভর শুধু কাজই করেছেন। পরিশ্রান্ত হতেন কমই। এতো প্রাণশক্তি কোথায় পেতেন, সেটা একমাত্র তিনিই জানতেন। মাঝে মাঝে আমরাই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তাল মেলাতে। তবে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেন এমন নয়। যে জন্য ব্যাপক আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে। কিন্তু কারো প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হননি। বরং আরো বেশী পরিশ্রম করে সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছেন বা ওঠার চেষ্টা করেছেন।
আনিসুল হকের ব্যক্তিত্বই রাজকীয়। যে কোনো জায়গায় তার উপস্থিতিতে বদলে যেতো পরিবেশ। জীবন এবং মৃত্যুতে এমন রাজসিক আর কাউকে দেখিনি। ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে আমার অনেক ঋণ। বেকারত্বকালীন ৮ মাসে তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘যেভাবে আছো, যেখানে আছো জীবনকে উপভোগ করো। কান্না বা বিষাদে সমাধান নেই। একটাই জীবন, তাকে ভালোবাসো। জীবনের পাশে জীবনই থাকে। তা উপভোগ করো। স্বপ্ন দেখো। এগিয়ে যাও। যদি কিছু চাইতেই হয় তবে জীবনের কাছে চাও।’
ভাবছি শোক নয়। শুধু জীবনের গল্প বলবো। যা আনিস ভাই শিখিয়ে গেছেন।
চিরনিদ্রায় ভালো থাকুন আনিস ভাই। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় সবসময় থাকবেন আপনি।
[গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সফল ব্যবসায়ী এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ৩০ নভেম্বর]
সাইফুল হাসান : সাংবাদিক।
সারাবাংলা/পিএম