প্রার্থীর ভুলে ‘দোষী’ ইসি
৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৫:৪৯
একাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে রেকর্ড ৭৮৬ মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। ৩০৬৫ মনোনয়ন জমার বিপরিতে এই সংখ্যা নেহায়েত কম না। এনিয়ে আলোচনা চলছে। এই আলোচনা স্রেফ আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না, রীতিমত অভিযোগ ওঠেছে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ মনোনয়নপত্র বাতিলের। একপাক্ষিক এই অভিযোগের তীর নির্বাচন কমিশনের দিকে। তবে বাতিলের কারণ ও ধরণ দেখে অভিযোগের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
অভিযোগ মূলত বিএনপির শতাধিক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার কারণে। ৩০০ আসনের বিপরিতে বিএনপির ৬৯৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এক আসনে একাধিক প্রার্থী দেওয়ার কারণ মূলত বিকল্প প্রার্থী রাখা। কারণ বিএনপি আগে থেকেই জানত তাদের অনেকের মনোনয়নপত্র বাছাইপ্রক্রিয়ায় টিকবে না। মামলা ও রায়জনিত কারণে তারা যে শঙ্কা করেছিল সেটা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী হিসেবে বিএনপির অনেক নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিলেও বাছাইপ্রক্রিয়ায় তারা অনুমিতভাবেই টিকতে পারেন নি। যেমনটা টিকতে পারেন দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির জানা থাকা সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার জন্যে তারা তিনটি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিল, সেগুলোও টিকে নি। এমন অগণন বাতিল ঘোষিত মনোনয়নপত্রের কথা বিএনপিও আগে থেকে জানত, তবু তারা সেগুলো জমা দিয়েছে; এবং একই সঙ্গে তারা বিকল্প প্রার্থীও রেখেছে। ফলে এটা যে তাদের কৌশল ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিনে ৬৯৬-এর বিপরিতে বিএনপির বাতিলের সংখ্যা ১৪১; অর্থাৎ তাদের ৫৫৫টি মনোনয়নপত্র বৈধ বলে ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ২৬৪ আসনে আওয়ামী লীগের ২৮১ জন প্রার্থীর বিপরিতে বাতিল মনোনয়নের সংখ্যা ৩। স্বতন্ত্র হিসেবে জমা দেওয়া ৪৯৮ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিলের নিকাশ শেষে এসে দাঁড়িয়েছে ১১৪ জন। এই বাতিলের খাতায় আবার রয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৫০ জনও যারা স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
কী প্রক্রিয়ায় এই মনোনয়নপত্র যাচাইবাছাই হয় এ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জেলা প্রশাসক ও দুজন বিভাগীয় কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত প্যানেল যাচাই করেন মনোনয়নপত্রে প্রার্থীর নাম, পিতা-মাতার নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, প্রস্তাবকের নাম, সমর্থকের নাম, প্রস্তাবক ও সমর্থকের স্বাক্ষর, তিনি হলফনামা যথাযথভাবে পূরণ করেছেন কিনা, প্রার্থীর নামে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কিনা। এ ছাড়া প্রার্থী ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণ সংযুক্ত করতে হয় মনোনয়নপত্রের সঙ্গে।
প্রার্থিতা বাতিল যেসব কারণে হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে বিল ও ঋণখেলাপি; তথ্য গোপন; ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া; নথিপত্রে গরমিল; সাক্ষর না করা; স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অন্য কোন পদে থাকলে সেসব জায়গা থেকে পদত্যাগ না করা; এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সাক্ষর জমা না দেওয়া। তবে এই বাতিল মানেই নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে অযোগ্য হয়ে যাওয়া নয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে বাতিল ঘোষিত প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারেন, সেখানে তারা আপিলে না জিতলে হাই কোর্টে আপিল করতে পারেন। হাই কোর্ট ওই আপিল মঞ্জুর করলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।
বাছাইয়ে এত অধিক সংখ্যক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণার পর বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ উত্থাপন করে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এটা উদ্দেশ্যমূলক নিঃসন্দেহে, কারণ যেসব অভিযোগে মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে সে সম্পর্কে তারা আগে থেকেই জানত। খালেদা জিয়াসহ আরও অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে, গোলাম মাওলা রনির মনোনয়নপত্র বাতিল সাক্ষর না করার কারণে, ড. রেজা কিবরিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয় ক্রেডিট কার্ডের অর্থ পরিশোধ না করে ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে, হিরো আলম কিংবা ইমরান এইচ সরকারের মনোনয়নপত্র বাতিল হয় ১ শতাংশ ভোটারের সাক্ষরে গরমিল থাকার কারণে। এগুলোর কারণে যে প্রাথমিকভাবেই তারাসহ আরও অনেকেই আটকে যাবেন সেটা সকলেই জানত, কিন্তু সেই জানা বিষয়কেই সামনে এনে নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে। এবিষয়গুলো সত্যি এড়ানো যেত যদি খালেদা জিয়াসহ দণ্ডপ্রাপ্ত নেতারা মনোনয়নপত্র দাখিল না করতেন, যদি রনিসহ আরও অনেকেই মনোনয়নপত্র যথাযথভাবে পূরণ করে সাক্ষর ঠিকমত করতেন, যদি রেজা কিবরিয়াসহ অন্যরা ঋণখেলাপি না হতেন বা দেনা সময়মত পরিশোধ করতেন; এবং হিরো আলম কিংবা ইমরান এইচ সরকারসহ অন্যরা প্রয়োজনীয় ১ শতাংশ সাক্ষর ঠিকমত জমা দিতেন।
যেসব প্রার্থী মনোনয়নপত্র, হলফনামা ও অন্যান্য কাগজপত্রে সাক্ষর না করে বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছেন তাদের পক্ষ নিয়ে অনেকেই বলছেন এটা ‘ছোটখাটো’ ভুল। বুঝতে পারিনি কোনো কাগজে সাক্ষর না করা ছোট ভুল হয় কেমনে? কারণ সাক্ষর অফিসিয়ালি ব্যক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করে। আজ যিনি বলছেন সাক্ষর না করলেও সেই কাগজ গ্রহণযোগ্য হয় তিনি কি তার সমীপে হাজির করা সাক্ষরবিহীন কোনো কাগজকে গ্রহণ করবেন? করবেন না! এছাড়া প্রার্থীর হলফনামায় যেখানে প্রার্থীর আয়ব্যয়ের বিবরণি, মামলামোকদ্দমা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণিসহ অন্যান্য তথ্য দেওয়া থাকে সেখানে সাক্ষর না করা প্রার্থী যদি সামনে এটা অস্বীকার করেন তখন নির্বাচন কমিশনেরই বা কী করার থাকবে? এবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে তারা প্রার্থীদের বিবরণি যাচাই করে দেখবে। যদি সেখানে প্রার্থী সাক্ষরই না করে থাকেন তাহলে ওই কাগজটা যে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সেটা আইনত কীভাবে প্রমাণ হবে? তবে এই বিষয়টির সুরাহা সম্ভব আপিলে, এবং প্রার্থী ইসিতে উপস্থিত হয়ে যদি সাক্ষর করে দেন। এছাড়া যেসব প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে বিএনপি মহাসচিবের সাক্ষরে মিল না থাকার কারণে সেগুলোরও সমাধান সম্ভব সঠিক সাক্ষরে নতুন প্রত্যয়নপত্র দাখিলের মাধ্যমে।
মামলা, বিল-ঋণখেলাপসহ অন্য যেসব কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে সেগুলোর জন্যেও আপিলের বিধান রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যা হচ্ছে সেটা একপাক্ষিকভাবে ইসিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। প্রার্থীর ভুলে মনোনয়নপত্র বাতিলের কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে। এটা যে রাজনৈতিক কৌশলের একটা অংশ তা বলা যায়।
বিএনপি প্রথম থেকেই এই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনে সেনামোতায়েনসহ তাদের আরও দাবি ইসি মেনে নিলেও তারা ইসিকে মানতে পারছে না। দণ্ডিতদের নির্বাচনের প্রার্থী করে আবার একই সঙ্গে বিকল্প প্রার্থীও রেখে তারা মনোনয়নপত্র বাতিলের ফর্দ লম্বা করতে চেয়েছে, এবং সেখানে সফলও হয়েছে। কী কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল হলো এই আলোচনার চাইতে এখন কেবলই আলোচনা বিএনপির কতজন বাতিল ঘোষিত হলেন। এটাই চেয়েছিল বিএনপি।
প্রার্থীর দোষে নির্বাচন কমিশনকে দোষী হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। বরং সংশ্লিষ্টদের লজ্জিত হওয়াই উচিত তাদের ভুলের জন্যে; বাতিল হবে জেনেও দণ্ডপ্রাপ্তদের মনোনয়নপত্র দাখিলের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করার কৌশলি খেলার জন্যে।শুদ্ধ রাজনৈতিক চর্চার জন্যে এটাই জরুরি।
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এমএম