Wednesday 07 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্কুল নাকি নির্যাতন কেন্দ্র?


৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:২০ | আপডেট: ৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:২৯

আমার ছেলে প্রসূন আমিন এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। অরিত্রী অধিকারী ক্লাশ নাইনে পড়তো। তার মানে অরিত্রীও আমার সন্তানের বয়সীই। প্রসূনের মুখটা একটু কালো লাগলে, মনটা একটু খারাপ মনে হলে, চোখে এক ফোঁটা পানি দেখলে আমার পৃথিবী ওলটপালট হয়ে যায়। তাহলে অরিত্রীর বাবা-মা কিভাবে সইছেন? অপমানে-অভিমানে মেয়েটা গলায় ফাঁস দিয়েছে। আহারে সন্তান আমার, এভাবে কি চলে যেতে হয়? যে বাবার অপমানে এতটা অভিমান, আত্মহত্যা করে মেয়েটি কি তার বাবাকে আরো বড় অপমান করলো না। অরিত্রী তার বাবা-মাকে ফেলে অনন্ত বেদনার সাগরে। তবে নিশ্চয়ই অরিত্রীর আত্মমর্যাদায় অনেক বড় আঘাত লেগেছিল, যাতে জীবনটা তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

অরিত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে গিয়েছিল এবং মোবাইলে নকল ছিল। এই অপরাধে তার বাবা-মাকে ডেকে আনা হয়। অরিত্রী প্রিন্সিপালের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েও পায়নি। বরং তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় বাবা সেখানেই কেঁদে ফেলেন। সব মেয়ের কাছেই তার বাবা সুপার হিরো। নিজের অপমান তবু সওয়া যায়। প্রিন্সিপালের পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া যায়। কিন্তু বাবার চোখে জল কোনো মেয়ে সইতে পারে না। অরিত্রীও পারেনি।

বিজ্ঞাপন

পরীক্ষায় নকল করা নিশ্চয়ই অপরাধ। কিন্তু সে অপরাধ নিশ্চয়ই বাবাকে ডেকে এনে অপমান করা বা স্কুল থেকে বের করে দেয়ার মত গুরুতর নয়। আর অরিত্রী যে বিষয়ে নকল করছিল, সে বিষয়ের শিক্ষকের কি কোনো দায় নেই? তিনি নিশ্চয়ই ভালোভাবে পড়াননি, নইলে তার ছাত্রীকে নকল করতে হবে কেন?

অরিত্রী মরে গিয়ে আমাদের সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থার অন্ধকার দিকগুলো। বলবো না, অরিত্রী আমাদের জাগিয়ে দিয়েছে। আমরা আসলে সবাই জেগেই ছিলাম, ঘুমের ভাণ করছিলাম। আমরা সবাই জানি ঢাকার স্কুলগুলোতে কী হয়। কিন্তু প্রতিবাদ করি না, চেপে যাই। স্কুলগুলো আমাদের সন্তানদের জন্য আনন্দের নয়, কারাগারের মত। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মুখ বুজে মানসিক যন্ত্রণা সয়ে যেতে হয়।

গত দুদিনে ভিকারুননিসা নূন স্কুল সম্পর্কে যেসব অভিযোগ শুনেছি, তার অর্ধেক সত্যি হলেও স্কুলটি এক্ষুণি বন্ধ করে দেয়া উচিত। অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের ভিকারুননিসায় ভর্তি করার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাই। ভিকারুননিসায় ভর্তি বাণিজ্যের কথা ওপেন সিক্রেট। ৮/১০ লাখ টাকা হলেই ভিকারুননিসায় ভর্তি হওয়া যায়। অনৈতিকতা দিয়ে যাদের শুরু, তারা কিভাবে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শেখাবে? বাণিজ্য শুধু ভর্তির সময়ই নয়, মর্নিং শিফট থেকে ডে শিফটে যেতে টাকা লাগে। আসলে বাণিজ্য পদে পদে। স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের গরু-ছাগলের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন না। আর শিক্ষার্থীদের মনে করেন গরু-ছাগলের বাচ্চা। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না। করতে গেলে অপমানিত হতে হয়। আর একবার যদি কেউ প্রতিবাদ করে তাহলে সেই ছাত্রীর জন্য স্কুল হয়ে যাবে নরক। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অভিভাবকরা সব অন্যায় মুখ বুজে সয়ে যান। যেখানে শিক্ষার্থীরা নীতি-নৈতিকতা শেখানোর কথা, সেখানে পদে পদে অন্যায়, অনৈতিকতা। শিক্ষার্থীদের রীতিমত ব্ল্যাকমেইল করে কোচিং করতে বাধ্য করা হয়। কোচিং করলে এক ধরনের আচরণ। আর না করলে তাল লাইফ হেল হয়ে যায়। তবে এই আচরণ শুধু ভিকারুননিসায় নয়, ঢাকার অধিকাংশ স্কুলে একই চিত্র।

আমাদের ছেলেবেলায় অভিভাবকরা স্কুলে সন্তানকে দিয়ে বলতেন, মাংস আপনার, হাড্ডি আমার। শিক্ষকরাও মনের সুখে পিটিয়ে আমাদের মত গাধা-গরুদের মানুষ বানিয়েছেন। স্কুলে মার খেয়ে বাসায় সে মারের দাগ লুকিয়ে রাখতাম। নইলে বাসায় আরেকদফা মার খেতে হতো, নিশ্চয়ই কিছু করছিস, নাইলে মারলো ক্যান। তবে সেই শিক্ষকেরা আবার আদরও করতেন। সবার প্রতি তারা সমান আচরণ করতেন। কোচিং দিয়ে আচরণ নির্ধারিত হতো না। তবুও শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার সেই অমানবিক দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। তবে এখনও স্কুলে স্কুলে চলে ভয়াবহ মানসিক নির্যাতন। ফেসবুকে দেখলাম রাজউক উত্তরা মডেল স্কুলের বোর্ডে নাকি ভালো ছাত্র আর খারাপ ছাত্রদের তালিকা ঝোলানো থাকে ছবিসহ। যার নাম ও ছবি খারাপ ছাত্রের তালিকায় থাকে, তাকে প্রতিদিন অপমানিত হতে হয়। সেই শিশুর মনে তা কি ভয়ঙাকর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি।

গত দুদিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের অভিভাকদের অভিভাবকদের অভিজ্ঞতা শুনেছি। ফেসবুকে পড়েছি অনেকের কথা। শুনে-পড়ে আমি রীতিমত আতঙ্কিত। আমাদের সন্তানদের আমরা কোখায় পাঠাচ্ছি? স্কুলে না নির্যাতন কেন্দ্রে? এসএসসি বা এইচএসসির ফল প্রকাশ হলে আমরা ভিকারুননিসার ছাত্রীদের উল্লাসের ছবি দেখাই। সেই হাসির পেছনে কত শিক্ষার্থীর কান্না, কত অভিভাককের অপমানের ইতিহাস লুকিয়ে আছে; আমরা জানি না, জানতে চাইওনা।

জীবন অমূল্য। আত্মহত্যা সেই অমূল্য জীবনের নিদারুণ অপচয়। অরিত্রী তার বাবা-মার প্রতি খুব অন্যায় করেছে, এমনকি স্কুলের শিক্ষকের চেয়েও বেশি। তবে সবার মানসিক গঠন একরকম হয় না। আর আমরা আমাদের সন্তানদের সবসময় আগলে রাখতে রাখতে তাদের শক্ত মানসিকতায় বেড়ে উঠতে দেই না। তারা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে। আর ১৩ থেকে ১৯- এই বয়সটা খুবই সংবেদনশীল। তাদের মমতা দিয়ে বোঝাতে হবে, শোধরাতে হবে। শাসন করে খুব ভালো ফল পাওয়া যাবে না। শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে।

আমরা আমাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাই, তাদের মানুষের মত মানুষ করতে। তারা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়; নীতি-নৈতিকতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, বিনয়, আত্মমর্যাদা সবই শিখবে। তার লুকানো প্রতিভার বিকাশ হবে স্কুলে। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রচলিত স্কুলিং ব্যবস্থায় এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। স্কুলে গেলে ভয়ে তারা সব ভুলে যায়। আত্মমর্যাদার কথা বলতে গেলেই অমানবিক নির্যাতন সইতে হয়। উপায়হীন হয়ে আমরা সব মুখ বুজে সয়ে যাই।

অরিত্রী আসলে জীবন দিয়ে প্যান্ডোরার বাক্স ওপেন করে দিয়ে গেছে। অরিত্রীর জীবনের বিনিময়ে হলেও স্কুলগুলো আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ হোক,আনন্দের হোক, আতঙ্কের নয়।

প্রভাষ আমিন
৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর