শান্তিপূর্ণ ভোটের আহবান, বাতাবরণে সন্ত্রাস
১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ২১:৫৩
।।সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।।
প্রতিশ্রুতি রয়েছে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের। বাতাবরণে রয়েছে সন্ত্রাস। এই দুইয়ের লড়াইতে জয়ী হবে কে? আভাস বোধ হয় দিয়ে দিল নোয়াখালি ও ফরিদপুর। মিছিলে হামলা হয়েছে, জনপদ রক্তাক্ত হয়েছে, প্রাণহানি পর্যন্ত হয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার দ্বিতীয় দিনে গত মঙ্গলবার সারাদেশে অন্তত ১৮ জেলায় সংঘাত ও প্রচারে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালী সদরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষের সময় গুলিতে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা নিহত হয়েছেন। ফরিদপুর সদরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের এক নেতা নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক।
সন্ত্রাস যদি প্রতিযোগিতা হয় তাহলে বলতেই হবে এখন পর্যন্ত বিএনপি ২-০তে এগিয়ে আছে। কিন্তু নিশ্চয়ই এভাবে কেউ ভাবতে চায়না। সন্ত্রাস, সহিংসতা কারও কাম্য নয়। প্রথম দুই দিনে এমন হলে, আমরা জানিনা আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ প্রতিটি নির্বাচনের সময়, ভোটের আগে এবং পরে, আমরা দেখেছি কি আতংক হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে। ২০০১-এ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। নির্বাচনের পর হিন্দু নারী ধর্ষণ আর হিন্দু বাড়ি লুটের যে উৎসব দেখেছে, তা আরেকবার যেন ১৯৭১-এর পাকিস্তানি অত্যাচার ফিরিয়ে এনেছিল। তবে শুরুটা হয়েছিল নির্বাচনের আগেই। তত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার সাথে সাথেই প্রশাসনিক নানা পদক্ষেপের সাথে সাথে শুরু হয়েছিল হিংসার উন্মতত্তা যা চলেছে নির্বাচন পরবর্তী পুরো মেয়াদেই। এবার ব্যতিক্রম যে, দলীয় সরকার থাকলেও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সেই পর্যায়ে যায়নি, হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ বা সন্ত্রাসীদের ঘুরাফেরা শুরু হয়নি।
তবুও নোয়াখালি ও ফরিদপুরের ঘটনা আমাদের শংকিত করে। কেন এমন হয়? এগুলো কি শুধুই রাজনৈতিক উন্মত্ততা? নাকি অন্য কিছু? যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি সহিংসতাই আমাদের রজনৈতিক সংস্কৃতি। আন্দোলন মানেই সহিংস আন্দোলন। ক্ষমতায় যাওযার জন্য সহিংসতাই যদি মূলধন হয় তখন সমগ্র শাসন ব্যবস্থাই হিংসার ফসলে পরিণত হয়। এক হিংসা মোকাবিলা করতে গিয়ে পাল্টা হিংসার আমদানি করে আমাদের রাজনীতি।
কথায় কথায় আমরা পশ্চিমা দৃষ্টান্ত টানি, গণতন্ত্রের কথা বলি। আবার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী সেই রাজনীতিকরাই আবার হুমকিও দিতে থাকেন। তারা জনগণকে ভোটে আহবান জানাননা, সহিংসতা উস্কে দিতে জনগণকে ভোট কেন্দ্র পাহারা দিতে ডাকেন। এর মধ্যেই হিংসার বীজ লুকোনো। আমাদের নেতারা বহুত্ববাদের কথা উচ্চারণ করেন, কিন্তু আত্মস্বার্থরক্ষা ছাড়া আর কোন দর্শন নেই তাদের। এই আত্মস্বার্থের কারণেই যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গি আর তথাকথিত লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী মার্কা এক হয়ে যায়। আর এ কারণেই পরমত সহিষ্ণুতা কমে এবং এটাই হয়ে উঠে সহিংসতার উৎস।
বড় দুটি দলের বিভাজিত রাজনীতির বিপরীতে ভাল কিছু আসবে এমন প্রতিশ্রুতিতে যারা সেনা সমর্থিত অনির্বাচিত তত্বাবাধায়ক সরকারকে আজীবন রাখতে চেয়েছিল তারা হঠাৎ করে এখন খুব বেশি নির্বাচন নির্বাচন করছে। আর এই নির্বাচনী খেলায় তাদের সঙ্গী কারা জনগণ তা দেখছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো এদের মনোজগতে আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতি। আর পাশাপাশি পরিলক্ষিত হয়েছে এক ধরনের হিংসাশ্রয়ী লড়াই। এর মূল লক্ষ্য নেতৃত্বের আত্মকেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক মোক্ষলাভের নীল নকশা।
নতুন কিছু হোক রাজনীতিতে – এমন আশা জনগণের। জনমানসের এমন আকাঙ্খার কথা যারা বলেন তারাও দু:খজনকভাবে দলতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত করতে চান। সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার করে। শুরু হয় আমরা-ওরার বিভাজন। এটি রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা। বলতে বাধ্য হচ্ছি যাদের ভাল ভাবমূর্তি আছে তারাও এই ধরণের ভাবনা থেকে মুক্ত নন।
বাংলাদেশের বিরোধী দল সবসময় শাসক দলের বিরুদ্ধে কারণে অকারণে আন্দোলনে মুখর থাকে। সে আন্দোলনে হিংসা থাকে। বিপরীতে থাকে পুলিশের দমননীতি। কিন্তু গত দশটি বছরে দেখা গেলো জঙ্গি আন্দোলন যার বড় শিকার দেশের অর্থনীতি, সাধারন মানুষকে তাদের সহায় সম্বল যা আছে সেসব সহ পেট্রল বোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারা, দেদারসে পুলিশ হত্যা করা। এমন সহিংসতা এসেছে বার বার।
ধারণা ছিল পুড়িয়ে জ্বালিয়ে সফল আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার বিদায় না নিলেও শিল্প ও বাণিজ্যের বিদায় ঘন্টা বাজানো হবে। কিন্তু সরকার মানুষের মনে যে উন্নয়ন স্পৃহা জাগিয়েছে, তাতে করে তা হয়নি। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বিদ্যুতে দেশ আলোকিত হয়েছে, সমূদ্র বিজয় হয়েছে, মহাকাশে যাত্রা হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড দীর্ঘ সব অবরোধেও স্থবির হয়নি।
সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্র রাজনিতি বাংলাদেশকে হিংসার পথে ঠেলেছে বারবার। গোষ্ঠীজীবনে সংঘাত ও সংঘর্ষ অনিবার্য। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, জাতি বনাম জাতিতে সংঘর্ষ হয়। এসব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে হয় রাষ্ট্রকে। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সহিংসতাকই রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলে তখন রাষ্ট্রকে অনিরাপদ মনে করে আক্রান্তরা। ২০০১-এর পর যে অবস্থা হয়েছিল তা যেন আর না আসে।
দলমত নির্বিশেষে সকলে গণতন্ত্রের আওয়াজ তুলছে। এটা ভাল। প্রকৃত গণতন্ত্রই পারে সহিংসতার সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে। কিন্তু ভাবনার জগতে যদি এই মানসিকতা থাকে যে, প্রতিশোধ নিব, একে সরিয়ে দিয়ে যাকে ইচ্ছা তাকে আনব তাহলে বাংলাদেশ আর বাসযোগ্য থাকবেনা।
সারাবাংলা/এমএম