অভিবাসন ভাবনা: অবদানে শীর্ষে, মর্যাদায় কেন পিছিয়ে প্রবাসীরা?
১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ২০:২২
|| শরিফুল হাসান ||
বীনা সিক্রি তখন মালয়েশিয়ায় ভারতের হাইকিমশনার। একবার মালয়েশিয়ার পুলিশ অবৈধ শ্রমিকদের চিহিৃত করতে বিদেশি শ্রমিকদের বিভিন্ন শিবিরে অভিযান চালায়। অভিযান চলাকালে কোন এক ভারতীয় শ্রমিকের পাসপোর্ট ছুড়ে মেরেছিল এক পুলিশ সদস্য। এ ঘটনায় চরম অপামনিত হন ওই ভারতীয় নাগরিক। তার মনে হয় তার পাসপোর্ট অপমান মানে তার দেশকে অপমান। সব ভারতীয় শ্রমিকরা এই খবর তাদের হাইকমিশনারকে জানান। এই ঘটনায় ভারত এতোটাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যে মালয়েশিয়া আর কখনো ভারতীয়দের সঙ্গে এমন আচরণ করেনি। অথচ আমরা নিশ্চিত করেই জানি, বাংলাদেশিরা প্রায়শঃই দেশটিতে এ ধরনের অপমান ও নিপীড়নের শিকার হন।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশি প্রবাসীদের জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এ বিষয়গুলো নিয়েই কথা হচ্ছিলো এশিয়ার অভিবাসন বিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট কারাম এশিয়ার সাবেক সমন্বয়ক হারুন আল রশিদের কাছ থেকে। দেড়যুগ ধরে তিনি মালয়েশিয়ার অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন। প্রায় সব বাংলাদেশিদের সাধারণ অভিযোগ, প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশে পদে পদে নিগৃহিত হন। মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদেরা বলছিলেন, ভারতের একজনের পাসপোর্ট ছুড়ে মারলে ভারত সরকার তীব্র প্রতিবাদ করে আর বিনা কারণে মালয়েশিয়ায় রতান (এক ধরনের ভয়ঙ্কর বেতের বাড়ি) খায় বাংলাদেশিরা।
২০১৫ সালে সমদুপ্রথে মালয়েশিয়ার পাচার বাংলাদেশিদের কুয়ালালমপুর বিমানবন্দরে পেয়েছিলাম যাদের সবার হাতে হাতকড়া। তারা শিকলে বন্দি। অথচ আইন অনুযায়ী এমনটা হওয়ার কথা নয়। পরের দিন এ নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন করলে শিকল পরানো কিছুটা কমে। তবে বন্ধ হয়ে যায়নি।
তবে মালয়েশিয়া, কাতার, আরব আমিরাত, কাহরাইন যখন যেখানে গিয়েছি, পৃথিবীর যেখানেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের পেয়েছি, তাদের সবার ধারণ অভিযোগ, নিজের দেশে, বিমানবন্দরে, বিদেশে কিংবা দূতাবাসে, কোথাও কেউ তাদের সঙ্গে ভালো ব্যাবহার করে না। মর্যাদা দেয় না।
কথাটি মিথ্যা নয়। এই যে বিদেশিরা বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভালো আচরণ করে না কারণ বাংলাদেশ নিজেই তার নাগরিককে যথার্থ সম্মানটুকু দেয় না। একটা দেশের নাগরিক তার নিজের দেশের নাগরিকদের যেমন সম্মান দেয় ওই দেশও সেভাবেই তাদের দেখে। বিদেশিরা যখন দেখে বাংলাদেশিরা তার নিজের দূতাবাসের ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে কাজেই তারাও নির্যাতন করে। অথচ এই প্রবাসীরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমএইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক কোটি বিশ লাখ লোক বিদেশে গেছেন। গত বছর রেকর্ড পরিমান প্রায় দশলাখ কর্মী বিদেশে গেছেন। এ বছর এখন পর্যন্ত সাত লাখ কর্মী বিদেশে গেছেন।
বাংলাদেশির প্রবাসীরা প্রতি বছর গড়ে ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় দেশে পাঠাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি অর্থ আসে সৌদি আরব থেকে। জিডিপির আট থেকে দশভাগ অর্থ এখন সরাসরি প্রবাসী আয় থেকে। তাদের কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ (রিজার্ভ) কয়েক বছর আগেই ৩০ বিলিয়ন বা তিন হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
এই যে জাতীয় অর্থর্নীতিতে বিশাল অবদান সেই তুলনায় প্রবাসীদের প্রাপ্তি বা মর্যাদার জায়গায় এখনো বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। প্রবাসীদের সাধারণ অভিযোগ, বিদেশে যখন তারা নানা বিপদে পড়ে বা কোন কাজে দূতাবাসে যান প্রায়ই সময়ই তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয় না। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে বিমানবন্দরেও আছে নানা ভোগান্তি। এক বাক্যে, প্রবাসীরা রাষ্ট্রকে শুধু দিচ্ছেন, পাচ্ছেন না তেমন কিছুই। এমন পরিস্থিতিতেই এ বছর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের স্লোগান অভিবাসীর অধিকার-মর্যাদা ও ন্যায়বিচার।
অভিবাসন খাতের লোকজন জানেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতে যে অভিবাসন খরচ সেটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সরকার প্রত্যেকটা দেশের জন্য নির্ধারিত খরচ বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু কাগজে কলমেই সেটা আছে। যারা বিদেশে লোক পাঠায় তারা অনেক সময়েই বহুগুন বেশি টাকা নেন। এর কারণ, বিদেশে যেমন মধ্যসত্ত্বভোগী আছে, দেশেও তেমনি নানাস্তরে দালালদের দৌরাত্ম। ফলে আট থেকে দশলাখ টাকাও লাগে বিদেশে যেতে। এছাড়া পদে পদে আছে ভোগান্তি-হয়রানি।
পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র—সবক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত কি। এতো ভোগান্তির পরেও মানুষ ছুটছে বিদেশ নামক সোনার হরিণের পেছনে।
একদিকে লোকজন যেমন প্রতদিন এয়ারপোর্ট ছাড়ছে আরেকদিকে প্রতিদিন আট থেকে দশজন প্রবাসীর লাশও আসছে। কফিনে করে কার্গো গেট দিয়ে অসে বলে অনেকেরই সেটা চোখে পড়ে না। এদের কেউ মারা যাচ্ছেন স্ট্রোকে কেউ বা হার্ট অ্যাটাকে। ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে এভাবে ৩৬ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে। এদের অনেকেই ২৮ কিংবা ৩০ বছরেও মারা গেছেন।
বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত কত লোক কাজের ভিসায় বিদেশে গেছেন সেই তথ্য সরকারের কাছে থাকলেও কতজন ফেরত এসেছেন সেই তথ্য নেই। তবে শুধুমাত্র ট্রাভেল পাস নিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার প্রবাসী ফিরে আসেন। গত আট বছরে অন্তত দুই লাখ প্রবাসী ফিরে এসেছেন।
বাংলাদেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় কেউ বিদেশে যাচ্ছেন শুনলে পরিবার, আত্মীয় স্বজন সবাই খুশি হয়। তখন তাকে ধার দেওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। কিন্তু একই মানুষ যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন তাকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। আবার অনেক বছর বিদেশে থেকে টাকা পয়সা নিয়ে এসেছেন এমন মানুষও দেশে ফিরে কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। এসব কারণে বিদেশে যাওয়ার সময় যেমন তার পাশে থাকা জরুরি তেমনি কেউ ফিরে এলেও তার পাশে সবার থাকা জরুরি।
সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব ফেরত অসহায় নারীদের কান্না অনেকেই দেখেছেন। তাদের অনেক সময়েই জরুরি চিকিৎসা সহায়তার প্রয়োজন হয়। অনেকের বাড়ি যাওয়ার টাকা থাকে না। অথচ তাদের পাশে দাঁড়ানোটা খুব জরুরি। একইসঙ্গে নারীদের বিদেশে যাওয়াটাও নিরাপদ ও মর্যাদার করতে হবে।
স্বীকার করতেই হবে, সরকার অভিবাসন খাতে নানা ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। তবে অভিবাসন খাতের পরিস্থিতি উত্তরণের বহু পথ বাকি। সবার আগে সোনার হরিণের জন্য অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করে জেনে বুঝে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম ও খরচ কমাতে হবে। দরকার নতুন শ্রমবাজার, নারীদের সুরক্ষা। তবে রাষ্ট্র-দূতাবাস-স্বজন সবাইকে মনে রাখতে হবে প্রবাসীরা শুধু টাকা পাঠোনোর যন্ত্র নয়। তারা মানুষও। কাজেই সবসময় তাদের মানবিক মর্যাদা দিতে হবে। আর সে কারণেই ‘অভিবাসীর অধিকার-মর্যাদা ও ন্যায় বিচার’- এই প্রতিপাদ্যটি যথাপযুক্ত।
আমরা চাই মানুষ হিসেবে সকল অভিবাসীর মর্যাদা ও সম্মান সমুন্নত থাকুক। তবে সেটি শুধু বছরের একটি দিন নয়, সারাবছর। ১৮ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে স্যালুট এক কোটিরও বেশি প্রবাসীকে যারা দেশের অর্থনীতি সচল রাখার পাশাপাশি অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন লাল সবুজের জন্য ভালোবাসা। বিজয়ের মাসে ও আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা। যতো দূরেই থাকেন আপনারাই বাংলাদেশ।
শরিফুল হাসান, ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান
সারাবাংলা/এমএম