ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার: শুনতে ভালো, নতুন কিছু নেই
১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:২৫
।। ইমতিয়াজ নাদভী ।।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে এই ইশতেহারটি পড়ার সুযোগ হয়েছে। তবে এই ইশতেহারে বেশকিছু বিষয়কে অযৌক্তিক মনে হয়েছে। রাজনৈতিক কারণেই এই অযৌক্তিক অংশগুলো নিয়ে ১৩ পয়েন্টে প্রথম ১৪ দফা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
১. একদলীয় শাসন যেন আবার না আসে, সেটা কীভাবে নিশ্চিত করবেন, তারা বলেননি। একদলীয় শাসন মানে কি এই যে, কোনো দল যদি ভালো কাজ করে তাহলেও জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও সরকার গঠন করতে পারবে না? এই বিষয়ে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার করা উচিত।
রাজনৈতিক সমস্যা ও হয়রানি নিরসনে এই মামলাগুলোর কতগুলো হয়রানিমূলক তার সংজ্ঞায়ন জরুরি। একটি যৌক্তিক মামলাকে হয়রানিমূলক বলা যাবে কি যাবে না, সেই ব্যাপারে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
২. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম কীভাবে চলমান থাকবে, সেই ব্যাপারে আসলে আমরা সবাই সন্দিহান। যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রিত্ব দেওয়ার ইতিহাস যে দলের রয়েছে, তারা কীভাবে এই বিচার চালাবে তার সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।
৩. ৭০ অনুচ্ছেদের কী ধরনের পরিবর্তন তারা আনতে চান, তার কোনো আভাস দেওয়া হয়নি। সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য যে সুস্পষ্ট আইন তারা করবেন বলেছেন, এই ব্যাপারেও কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
৪. বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা নিতান্তই অর্থ, শ্রম ও সময়ের অপচয়। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও সিটি গভর্নমেন্টের কথা বলা হলেও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কোন ভিত্তিতে করা হবে এবং কীভাবে করা হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
৫. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যদি থাকে, তাহলে ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়ার হেতু কী? সেটা ‘কর ন্যায়পাল’ নিয়োগ দেওয়ার মতোই অকার্যকর হবে কি না, তা আলোচনার দাবি রাখে। যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়ার কথা বলা আছে, সেগুলো ‘ভেগ ল্যাংগুয়েজ’-এ লেখা। এগুলো ভালো শোনায়, কিন্তু কীভাবে হবে তার কোনো উল্লেখ নেই।
৬. বয়সসীমা যদি না থাকে তাহলে কিসের ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হবে এবং সেই চাকরি কতদিন থাকেব, তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ত্রিশোর্ধ্ব বেকার ভাতা অর্থনীতির ওপর একটি বিরাট চাপ তৈরি করবে। সেটিকে প্রশমিত করবার কোনো কথা বলা নেই।
৭. ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার কতটুকু কমানোর সক্ষমতা ঐক্যফ্রন্ট রাখে, তা বলা হয়নি। চিকিৎসকদের উন্নয়নের জন্য কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে নার্স ও হেলথ অ্যাসিসট্যান্টদের সংখ্যাবৃদ্ধির কোনো আভাস দেওয়া হয়নি। তাদের প্রশিক্ষণের ওপর জোরও দেওয়া হয়নি। ফলে যে সুবিধাগুলোর কথা ৭.১-এ বলা আছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
৮. ন্যূনতম মজুরি জাতীয়ভাবে কত হবে, তা বলা হয়নি। কৃষি ভর্তুকি এখনও যথেষ্ট আছে। সেটা বাড়িয়ে কত করা হবে, সেটা বলা হয়নি। এই ভর্তুকি পণ্যের দামে কেমন ভূমিকা রাখবে, সেটিও স্পষ্ট করা হয়নি। এখানেও প্রতিটি পদক্ষেপে বলা হয়েছে ‘হবে’; কীভাবে হবে তা বলা হয়নি।
৯. বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলাই হয়নি। জ্বালানি নিয়ে কোনো নীতির কথাই বলা হয়নি। শুধু মূল্য কমানোর কথা এবং কুটির শিল্প ও হাসপাতালের বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলা হয়েছে।
১০. প্রবাসীরা এই দেশে তাদের মাল-সামানা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কোনো রকম সুবিধা পাবে কি না, এই ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়নি।
১১. নৌখাতের ওপর জোর দেওয়া হয়নি। রেলখাতের কোথায় কী রকম গুরুত্ব দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট নয়।
১২. তিস্তা ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে, তা বলাই হয়নি। আমরা সবাই জানি, এই দুটি ইস্যু বেশ কঠিন।
১৩. জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাংলাদেশের ভূমিকা ঠিক কোন জায়গায় হবে, তা বলা হয়নি।
সারাবশেষে বলতে গেলে, ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনি ইশতেহার কানে খুব ভালো শোনায় কিন্তু সেটা আবহমান কালের রাজনীতিবিদদের মুখের বুলির মতোই। ইশতেহারে শুধু স্বাস্থ্যখাতে পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দিকনির্দেশনা ঠিক করা আছে। আর বাকি সবকিছুই ‘আমরা করব; কিন্তু কীভাবে করব, কতটুকু করব, জানি না’— এই রকম অনেকটা। তারপরেও কিছু শুভদিক ইশতেহারে এসেছে, যেগুলোকেও ‘খুব অভূতপূর্ব’ বলা যাবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এটি