।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।।
বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের সমর্থন করেন কিংবা কিছুটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন—এমন যার সাথেই দেখা হচ্ছে, তিনিই বলছেন ‘কেন এমন হল?’ আমিও বোঝার চেষ্টা করছি যে, কেন এমন হয়। নির্বাচনের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ফেসবুকের নিউজ ফিডে একের পর এক বার্তা ভেসে উঠছিল—বিএনপি, জামায়াত বা ঐক্যফ্রন্ট সমর্থক বা পরিবর্তন চায় এমন মানুষদের স্ট্যাটাস আপডেট এবং একেবারে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রত্যেকেই জানিয়েছিল যে—এবার নিরব ভোট বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও ছিলেন প্রত্যয়ী যে, তাদের দল ক্ষমতায় থাকছে। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ শুভাকাঙ্ক্ষীরা দূরস্থান, খোদ দলের হাই কমান্ডও সম্ভবত ভোটের এমন একটা ফলাফল আঁচ করতে পারেননি। মহাজোট জিতবে, বড় ব্যবধানে জিতবে এমন একটা আশাবাদই ছিল নানা জরিপের কারণে। কিন্তু একটা ভোট সুনামি এসে ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপিকে এমনভাবে আঘাত করে যাবে এমন একটা উদ্দাম আশাবাদ সত্যিকার অর্থে ছিল না। এই ঝড় সব প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ধ্বজা ওড়া দলের পক্ষে, দেশের পক্ষে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কিন্তু জাতীয় রাজনীতি আপাতত একটি প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে—২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের রাজনৈতিক তাৎপর্য কী? তবে প্রথমেই আসি সেই প্রশ্নে যে, কেন এমন হল? ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় এমনই একটা জনসমর্থন পেয়েছিল। সেই বিবেচনায় এবারও প্রত্যাশিত ফলই পেয়েছে মহাজোট। যারা ভেবেছেন দশ বছরের শাসনের নানা ত্রুটির কারণে মানুষ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকে ব্যালট বিপ্লবে উৎখাত করে ফেলবে, তারা বুঝতে পারেননি যে, নির্বাচনের লড়াই কেবল দুটো দল বা জোটের আধিপত্যের যুদ্ধ নয়। জনগণ তার চাইতে বেশি কিছু ভেবেছে ফেসবুককেন্দ্রিক নাগরিক রাজনীতি সচেতন মানুষ থেকে।
দশ বছরে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে অনেক বেশি উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যাকে ছোঁয়ার কোনো ব্যক্তিত্ব এ মুহূর্তে তার দলে বা বিরোধী শিবিরে নেই। দশ বছরের শাসন উন্নয়ন দিয়েছে, উন্নয়নের বড় স্বপ্ন মানুষের মনে তৈরি করেছে, আরও বড় কিছু শেখ হাসিনার কাছ থেকেই আসবে এমন একটা বিশ্বাস মানুষের মনে পাকাপোক্ত হয়েছে। একথা সত্য এই দশ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতি অনেক বেশি উচ্চারিতও হয়েছে। কিন্তু জামায়াত, দুর্নীতি ও তারেক রহমান নির্ভর বিএনপি তার বিকল্প নয়, এ কথা মানুষের মনে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়েছে। ফলে নাগরিক সমাজের কিছু লোক ভাড়া করে সেই ঘাটতি আর পূরণ করা যায়নি। বরং ড. কামাল হোসেনের নানা বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে। তিনি জামায়াত প্রশ্নে দেশি সাংবাদিকদের গালি দেন আবার ভারতীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন, জামাত থাকবে জানলে তিনি বিএনপির সাথে যেতেন না। এমন কাণ্ডে ভোটাররা বিভ্রান্ত হয়েছেন, ঐক্যফ্রন্ট কর্মীদের মধ্যে কোনো লড়াকু মনোভাবই জন্মাতে দেয়নি।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের কাছে তারুণ্যের চাওয়া ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার। শেখ হাসিনা তা করেছেন। এই দাবি সব মানুষের দাবিতে পরিণত হয় ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু বিএনপি তার জামাত প্রীতির কারণে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে সরাসরি গোটা দেশের আবেগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আস্তিক-নাস্তিকের মতো সহিংস সাম্প্রদায়িক খেলায় নেমেছিল। সে কথা এদেশের মানুষ আর ভোলেনি, যদিও কতিপয় কপট নাগরিক বুদ্ধিজীবী বারবার বলার চেষ্টা করেছেন জামাত ইস্যুটি এখন আর বড় কিছু নয়। কিন্তু ভোটের ফলাফল বুঝিয়ে দিয়েছে, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে জামাতকে সঙ্গে নিয়ে দেশ জুড়ে পেট্রোল বোমা দিয়ে আগুন সন্ত্রাস করে মানুষকে পুড়িয়ে মেরে তারা মানুষ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
সরকারকে, সরকারি দলকে সমালোচনা করার নানা উপাদান নগদে পাওয়া যায়। কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি জনমনে কোনো প্রত্যাশাই জাগাতে পারেনি। কোনো ফলপ্রসূ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, মাঠের কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে সমর্থ হয়নি। জঙ্গি মদতদাতা হিসেবে দল ও দলের নেতা তারেক রহমানের নাম বহুল আলোচিত হওয়ায় মধ্য ও বয়ষ্ক জনতা এবং নারীদের মনে এই দলের একটি পাকিস্তানি ও আফগানি ভাবমূর্তি তৈরি করেছে।
মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বাধীন বিএনপির রাজনৈতিক শাখা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চয়েছে। তাই তারা ভোটে এসেছে এবং শেষ পর্যন্ত থেকেছে। কিন্তু তারেক রহমানের হুকুমে যারা চলে সেই অংশটি অনেক বড় এবং তারা অরাজনৈতিক শাখা হিসেবে নির্বাচনকে আন্দোলন হিসেবে প্রচার করে নির্বাচনে কখনোই তেমন সিরিয়াস হয়নি। নির্বাচনের দিন ভোটের মাঝ পথে নির্বাচন থকে সরে যাওয়ার যে প্রথা এই দল চালু করেছে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নতুন সিলেবাস প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। নির্বাচনে আসা না আসা, নির্বাচন বয়কট করা না করার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট ছিল নেতৃত্বের নানা স্তরে যা দলের শক্তি ক্ষয় করেছে নানাভাবে।
গুজব বা অসত্য তথ্য ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচার করে তরুণ সমাজের কাছে আরও খেলো হয়েছে দলটি। কারণ এসব কায়দা জামাতের যার কোনো বড় গ্রহণযোগ্য নেই। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, তবুও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ভারত বিরোধিতার কার্ড খেলতে পারেনি এবার বিএনপি ও জামাত। বিএনপি নাগরিক সমাজে কেন্দ্রিক রাজনীতি করে এমন কিছু অভিজাত ব্যক্তির কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় ফিরে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু নাগরিক সমাজই তাদের গ্রহণ করেনি।
নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়, ঢালাওভাবে বললে মানুষ তা নেয় না। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা জিতেছেন কিন্তু বেশি জিতেছে এদেশের মানুষ। ২০০১-এর নির্বাচনের দিন ফলাফল আসতে শুরু করা মাত্র সারাদশে হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর যে অত্যাচার নেমে এসেছিল, মানুষ সেই ধর্ষণের উৎসব, লুটের উৎসব মনে রেখেছে এবং নিজেদের জয় নিজেরাই নির্ধারণ করেছে।
সবাই যা চেয়েছিল, সেই অংশগ্রণমূলক ও সুষ্ঠূ নির্বাচন, সেটা শেখ হাসিনা নিশ্চিত করেছেন। গুজব বা ফেসবুকীয় কাব্যে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। প্রমাণ লাগবে এবং সেটাই করা দরকার। কিন্তু তার চেয়ে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট আত্মজিজ্ঞাসায় নিমগ্ন হোক কেন তাদের স্বপ্নের নিরব ভোট বিপ্লব সরবে তাদের ছিটকে ফেলল ময়দান থেকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে মৌলিক শর্তগুলো আছে, তা মানুষের সামনে আনতে না পারলে নিরাশ হতেই হবে। ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে, বা ধর্ম কার্ড দেখিয়ে সবকিছু লুটবার যে খেলা এত দিন জামাত-বিএনপি খেলেছে, সাধারণ নাগরিক তাতে অসহায় ক্রীড়নক মাত্র ছিল। এখন সময় বদলেছে। এটাই রাজনীতির চরিত্রে একটি বড় প্রকৃত পরিবর্তন। গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ পরিবর্তন।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ সারাবাংলা.নেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি