ধানের শীষে ভোট দেওয়া কি অপরাধ?
৫ জানুয়ারি ২০১৯ ১৬:১৫
দেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা চলে আসছে অনেকদিন ধরেই। ভোটের হিসাবে দুই দলের সমর্থনের পাল্লাও প্রায় সমান ছিল। এক্ষেত্রে মূলত দোদুল্যমান ভোটাররাই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিতেন। যে দুইবার আওয়ামী হেরেছিল, সেই ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে বসেছিল, দশমিকের ভগ্নাংশের ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে। কোনো কোনো নির্বাচনে আসন ব্যবধান বড় হলেও ভোটের ব্যবধান তত বড় ছিল না। এবারের নির্বাচন সেই দ্বিদলীয় ব্যবস্থার মূলে আঘাত হেনেছে। যে দ্বিদলীয় ধারার কথা, তা আসলে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামীবিরোধী ধারা। স্বাধীনতার আগে থেকেই প্রবহমান ছিল ধারাটি। ৭০-এর নির্বাচনের ক্ষীণ সেই ধারাটি স্বাধীনতার পর গতি পায় জাসদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে।
৭৫-এর আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায়। বিএনপির মোহনায় মিলিত হয় বিভিন্ন রঙের ধারা। আওয়ামী লীগবিরোধী মূলধারায় আসলে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তবে বিভিন্ন সময়ে তাতে মিশেছে বাম, মুক্তিযোদ্ধা, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিভিন্ন ধারা। সবমিলিয়ে অবস্থাটা জগাখিচুরির। তবে আওয়ামী লীগবিরোধী ধারার বিচিত্রতম মিশেল ছিল এবারের নির্বাচনে। বরাবরের মতো আওয়ামী লীগবিরোধী ধারার মূল নেতৃত্ব ছিল বিএনপির হাতেই। কিন্তু ধানের শীষ নিয়ে জামায়াতের মতো কট্টর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যেমন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, তেমনি ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব, কাদের সিদ্দিকীর মতো পরীক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের শক্তির লোকজনও ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এই মহামিশেলও তাদের মহাবিপর্যয় ঠেকাতে পারেনি। নির্বাচন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আমলে নিয়েও বলা যায়, নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির এরচেয়ে বড় কোনো বিপর্যয় কল্পনাও করা যায়নি। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগও কল্পনা করেনি।
একাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ভোট পেয়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ। জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য মিলে আরও ৮ শতাংশ ধরলে নিট আওয়ামী লীগবিরোধী ধারার ভোট ১৫ শতাংশের বেশি নয়। এই বিপুল রায় একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তি ও শঙ্কার। গ্রহণ করার সক্ষমতা থাকলে এই রায় তাদের আরও দায়িত্বশীল করতে পারে, আবার এই রায় তাদের দায়ও হতে পারে। এতকিছুর পরও দেশের অন্তত ১৫ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করে, এটা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। জয় যত বিপুলই হোক, আওয়ামী লীগ কিন্তু এই ১৫ শতাংশ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে না। দেশ থেকে বের করে দিতে পারবে না। সবাইকে কারাগারে রাখতে পারবে না। তাদের আস্থায় নিয়েই এগুতে হবে। বিপুল রায়ের দায় না দায়িত্বশীলতার উপলক্ষ হবে, তা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের ওপরই। জয়ের পরপরই দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের সংযত থাকতে বলেছেন, বিজয় মিছিল না করারও নির্দেশ দিয়েছেন।
এবারের আগে বিএনপির সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনে। সেবার তারা ৩০টির মতো আসন পেয়েছিল। ওই নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিরোধী দলকে আমি সংখ্যা দিয়ে গুনবো না। সেবার তবু সংখ্যাটা আঙুলে গোনার মতো ছিল, এবার তো একদম গুনে ফেলা যায়। তাই এবার ক্ষুদ্র বিরোধী শক্তিকে আরও বেশি আস্থায় নিতে হবে। তাদের জন্য আরও বেশি গণতান্ত্রিক স্পেস নিশ্চিত করতে হবে। যেন তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে না করে। এবারও নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি সবার প্রধানমন্ত্রী। এটাই গণতান্ত্রিক চেতনা। নির্বাচনে আগে যাই হোক, পরে তিনি সবার নেতা, সবার প্রধানমন্ত্রী। এমনকি সেই ১৫ শতাংশ আওয়ামীবিরোধী মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, মৌলিক মানবাধিকার, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শেখ হাসিনারই।
যেহেতু এবার সংখ্যাটা কম, তাই শেখ হাসিনাকে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশেষ নজর দিতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তবু পাশের দেশে পালিয়ে রক্ষা পায়; রাজনৈতিক সংখ্যালঘুরা কোথায় যাবে? বাংলাদেশ হোক সব ধর্মের, সব মতের, সব বর্ণের মানুষের নিরাপদ আশ্রয়।
কিন্তু সমস্যা হলো শেখ হাসিনা, এইচ টি ইমাম বা ওবায়দুল কাদেরের ভালো ভালো কথা তৃণমূলের সবার কানে পৌঁছায় না। পৌঁছালেও তারা হয় সেসব কথা বোঝেন না, না হয় পাত্তা দেন না। নির্বাচনের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ‘ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অপরাধে’ এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনা ম্লান করে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিশাল বিজয়কেও। রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে কাউকে গণধর্ষণ করা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমান্তরাল নয়। সরকারকে ধন্যবাদ। তারা তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ ঘটনার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ও এজাহারের বাইরে থাকা সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করেছে। এবার চাই, দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, যেন আর কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়।
‘সুবর্ণচরের কুবর্ণ’ ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে যখন তোলপাড়, তখন আরেকটি ঘটনা দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। রাজশাহী থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে তানোরের একটি গ্রাম কলমা। সেই গ্রামের কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থী ব্যারিস্টার আমিনুল হক পেয়েছিলেন ১ হাজার ২৪৯ ভোট আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬৫৩ ভোট। ব্যস, ধানের শীষ ভোট বেশি পাওয়ার অপরাধে কলমা এখন বিচ্ছিন্ন গ্রাম। এই গ্রামে বাস বা অন্য কোনো যানবাহন ঢুকতে দেওয়া হয় না, কলমার যানবাহনও বাইরে যেতে দেওয়া হয় না, ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে, গভীর নলকূপ দখল করে নেওয়া হয়েছে। কলমা গ্রামটাই যেন অভিশপ্ত। এমনকি এই গ্রামের আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও হামলার শিকার হয়েছেন। কলমা কেন্দ্রে হারলেও রাজশাহী-১ আসনে বিশাল জয় পেয়েছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। তারপরও কার সমর্থকরা তৃপ্ত নন। তারা কি শতভাগ ভোট পেতে চেয়েছিলেন? ওমর ফারুক চৌধুরী কি জানেন, তার সমর্থকরা তার নির্বাচনি এলাকার একটি অংশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন? এতে কি তার সমর্থন আছে? সেই গ্রামের লোকজনেরও তো তিনিই প্রতিনিধি। সেই অসহায় মানুষগুলো কার কাছে যাবে?
যারা ধানের শীষের হয়ে নির্বাচন করে, ধানের শীষে ভোট দেয়; তাদের আপনি অপছন্দ করতে পারেন, তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার কৌশল ঠিক করতে পারেন; কিন্তু তাদের মেরে, গ্রাম বিচ্ছিন্ন করে, ধর্ষণ করে তো আপনি তাদের ধ্বংস করতে পারবেন না। গায়ের জোরেই যদি ভিন্নমতকে দমন করবেন, তাহলে আর নির্বাচনের নামে প্রহসনের কী দরকার ছিল?
লেখক: প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক