বড় বিজয়ের বড় দায়
৮ জানুয়ারি ২০১৯ ১৬:৪৫
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে বহাল থাকলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো একটি দল টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করলো। একটানা তৃতীয় এবং সব মিলিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে রেকর্ড গড়ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ধারাবাহিক তিন মেয়াদে দেশের শাসনভার গ্রহণ করায় সরকারের পক্ষে পরিকল্পিত উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়া সহজ হবে। তবে বড় জয়ের বড় দায় ও প্রত্যাশা মেটাতে সরকারকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।
নতুন মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ, নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট বিতর্ক রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে বিরোধী দলগুলো। এই অভিযোগের মূল কারণ প্রায় সব আসনেই আওয়ামী লীগ বা তাদের জোট প্রার্থীর একতরফা বিজয়। অধিকাংশ আসনে বিএনপি জোটসহ সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কোথাও কোথাও নৌকার প্রার্থী মোট প্রদত্ত ভোটের ৯৫ শতাংশেরও বেশি পেয়েছে। সব মিলিয়ে ১০টি বাদে সব আসনে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ বা তাদের জোট। মূলত ভোট ও আসনের এই আকাশ-পাতাল ব্যবধানই নির্বাচন নিয়ে সন্দেহের মূল কারণ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১০ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগকে এমনিতেই এগিয়ে রেখেছিল। বিপরীতে নানা কারণে এই সময়ে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হয়েছে। অনেকেই ধারণা করেছিল, নির্বাচনকালীন ব্যাপক তৎপরতা দিয়ে তারা সেই ঘাটতি পূরণ করবে। কিন্তু মামলা-গ্রেপ্তার-হামলার ভয়ে অনেক এলাকায় স্বয়ং প্রার্থীও মাঠে নামেননি। সারা দেশেই নির্বাচনে প্রচারে বিএনপি নেতা-কর্মীদের তৎপরতা ছিল সীমিত। পুরনো ধারা অনুযায়ী সাধারণ মানুষের সরকারবিরোধী মনোভাব কাজে লাগিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চেয়েছে বিএনপি। কিন্তু জনমত সংগঠিত করে ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটাতে যে ধরনের কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ড প্রয়োজন, প্রচারণায় তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। ফলে সামগ্রিকভাবেই পিছিয়ে ছিল বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনে ফলেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। তা সত্ত্বেও প্রধান দুই জোটের প্রার্থীদের ভোটের ব্যবধান এত বেশি হবে, তা কেউই ধারণা করেননি। পাশাপাশি দুই জোটের প্রাপ্ত আসন ও সারা দেশে প্রদত্ত ভোটের হার অনেকের মধ্যেই সন্দেহ তৈরি করেছে।
আগামী পাঁচ বছর সরকারের কাজের মধ্য দিয়েই নির্বাচন নিয়ে ওঠা এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সরকার ও সংসদ সদস্যদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করতে হবে, আসলেই তারা এত বড় ম্যান্ডেট পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কাজের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করতে পারলে এই নির্বাচন নিয়ে ওঠা সব প্রশ্নের অবসানের পাশাপাাশি আগামী দিনেও জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে সহায়ক হবে। বড় বিজয়ের দায়ও অনেক বড়, এই মনোভাব নিয়েই আগামী পাঁচ বছর আওয়ামী লীগকে পথ চলতে হবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, গত ১০ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনকে দূর এগিয়েছে। বিশেষ করে, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অভাবনীয়। স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাংলাদেশ পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে ধাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এখন আগামী পাঁচ বছর সরকারকে এই উন্নয়নের সুফল সর্বজনীন করার জন্য কাজ করতে হবে। প্রবৃদ্ধি অর্জন বা মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে মধ্যম আয়ের শর্ত পূরণ হলেও, এ নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলেবে না। অর্থনৈতিক দিক থেকে মধ্যম আয়ের মান অর্জনের পাশাপাশি আমাদের সমাজ, আমাদের রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বত্রই উন্নতির এই ছোঁয়া দৃশ্যমান হতে হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পুরনো ধ্যান-ধারণার বদল ঘটিয়ে নতুন মানসিকতার প্রমাণ দিতে হবে। রাজনীতিতে সহনশীলতার সংস্কৃতি বাড়াতে হবে। ভিন্নমত গ্রহণের মানসিকতা অর্জন করতে হবে। সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে হবে। বৃহৎ শক্তি হিসেবে এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শক্তি দিয়ে দমন করার সংস্কৃতি পরিহার করে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তথ্য ও যুক্তি দিয়ে সমালোচনার জবাব দিতে হবে।
এই মেয়াদে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ সুশাসন। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাফল্যের পরও গত দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগকে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে। এবার সুযোগ এসেছে সেই সমালোচনার জবাব দেওয়ার এবং তা অবশ্যই কাজের মধ্যে দিয়ে। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাই পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে সুশাসনের উদাহরণ তৈরি করতে। এমনিতেই দল বা দলের বাইরে তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নেতৃত্ব এই সময়ে বাংলাদেশে নেই। এবারের নির্বাচনে বিশাল ম্যান্ডেট তার হাতকে আরো শক্তিশালী করেছে। শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব দল ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। সুশাসনের জন্য প্রয়োজন যেকোনো অন্যায়কারীকে বিচারের মুখোমুুখি দাঁড় করানো এবং প্রভাবমুক্ত বিচার নিশ্চিত করা। নোয়াখালীর ঘটনায় দায়ীদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই একটি ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে এভাবে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতিতে জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুরের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। যেকোনো কারণেই হোক, এত বড় পরাজয়ের পরও বিএনপি জোট এখন পর্যন্ত সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতির পুরনো সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে শক্তি থাক বা না থাক, এই নির্বাচনের পর পরাজিতরা হরতাল-অবরোধে নেমে যেতো। কিন্তু এবার সে রকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দিয়ে এবং নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়েরের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি বিএনপি জোটের আস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকেও এ ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে হবে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথ যেন রুদ্ধ না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে কি না, কিংবা তার মাত্রা কতটুকু ছিল, সেই বিতর্কে না গিয়েই বলা যায়, সামগ্রিকভাবে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর অনেকগুলো রাজনৈতিক দল এবং ভোটারদের একটি অংশের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থা দূর করা না গেলে আগামী দিনে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও বড় সমস্যায় পড়তে পরে। ফলে ভবিষ্যতে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট আস্থাহীনতা দূর করতে সরকারকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অবাধ, নিরপেক্ষ, সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে বিভিন্ন মহল থেকে অনেক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেগুলো ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারলে রাজনীতির অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হবে।
রাজু আহমেদ: চিফ রিপোর্টার, জিটিভি